Thank you for trying Sticky AMP!!

নারীর প্রতি বৈষম্য এখনো বড় চ্যালেঞ্জ

>

*নারীর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জন অনেক
*সুযোগ ও অধিকারের বৈষম্যগুলোও বড়
*নারীর আয় এখনো পুরুষের তুলনায় কম
*নারীর সমতার চ্যালেঞ্জ সবখানেই

উচ্চশিক্ষা, দক্ষতা, জীবিকা, সম্পদ, রাজনৈতিক ক্ষমতা, পরিবার ও সমাজে অবস্থান—এ ক্ষেত্রগুলোতে বাংলাদেশের নারীরা এখনো পুরুষের তুলনায় অনেকটা পিছিয়ে আছেন। নারী-পুরুষের সমান সুযোগ, অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করা এখনো গোড়ার সমস্যা।

গত কয়েক দশকে নারীর আর্থসামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সাফল্য আছে। সাফল্য আছে স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ সামাজিক পরিস্থিতিতেও। পাশাপাশি কিন্তু বড় সমস্যা হয়ে আছে নারীর প্রতি সহিংসতা, যা কিনা অর্জনগুলোকে ঝুঁকিতে ফেলছে। নারী অধিকার–কর্মী ও গবেষকেরা আরও বলছেন, বৈষম্য এবং বৈষম্যের মানসিকতা দূর করে নারীর অবস্থান শক্তিশালী করা না গেলে এ সহিংসতা প্রতিরোধ করা যাবে না।

উচ্চতর শিক্ষা ও দক্ষতা, মানসম্মত জীবিকার সুযোগ, আয় ও সম্পদ, রাজনৈতিক ক্ষমতা—এসব ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের বৈষম্য কমানো আগামী দিনগুলোতে তাই সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে। বিশেষ চ্যালেঞ্জ হবে পারিবারিক আইনের সংস্কার এবং সার্বিকভাবে সমাজে বিদ্যমান বৈষম্যের দৃষ্টিভঙ্গি দূর করার কার্যকর কৌশল ঠিক করা।

বাংলাদেশের অর্জনগুলো বিশ্বে স্বীকৃত। বিশ্বে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য বিষয়ে প্রতিবছর প্রতিবেদন প্রকাশ করে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম। বৈষম্যগুলো কমানোর ক্ষেত্রে গত বছর দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ছিল শীর্ষে। সে বছর বিশ্বের ১৪৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ছিল ৪৮তম। ২০১৭ সালের তুলনায় এটা ছিল ২৮ ধাপ অগ্রগতি। প্রতিবেদনটি বলছে, এমনটা সম্ভব হয়েছে অর্থনৈতিক সুবিধা এবং অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ার কারণে।

নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন এবং জঁ দ্রজ তাঁদের ভারত: উন্নয়ন ও বঞ্চনা (২০১৫ সালে প্রকাশিত) বইয়ে লিখেছেন, ভারতের চেয়ে বাংলাদেশে নারীর অগ্রগতি অনেক বেশি। বাংলাদেশে ৫৭ শতাংশ নারী কর্মজীবী। ভারতে এ হার ২৯ শতাংশ। তাঁরা দেখিয়েছেন, নারীর সাক্ষরতা ও শিক্ষাতেও বাংলাদেশ এগিয়ে।

এই দুই অর্থনীতিবিদের কথা, ‘দুনিয়াজুড়ে এ সত্য এখন সুপ্রতিষ্ঠিত যে এই ব্যাপারগুলো মেয়েদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অর্জনের পথে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সমাজ পরিবর্তনের এই প্রকরণগুলো বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে অনেক বেশি কাজে লাগিয়েছে।’

তবে এসব অর্জনের সীমাবদ্ধতা আছে। বাংলাদেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় পুরুষের চেয়ে নারীর অংশগ্রহণ কিছু বেশি। কিন্তু উচ্চশিক্ষায় নারীরা অনেকটাই পিছিয়ে থাকছেন। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) ২০১৮ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রাথমিক স্তরে মেয়েরা সামান্য এগিয়ে আছে। মাধ্যমিক স্তরে মেয়ে আরেকটু বেড়েছে। উচ্চমাধ্যমিকে গিয়ে মেয়েদের পেছানো শুরু হচ্ছে, তবে তখনো ছেলে-মেয়ে প্রায় সমান।

তারপরই উচ্চশিক্ষা আর পেশাগত শিক্ষার স্তরে নারীর সংখ্যা ধপ করে পড়ে যাচ্ছে। ব্যানবেইসের সর্বশেষ হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নারী মাত্র এক-তৃতীয়াংশের কিছু বেশি। চিকিৎসা ও আইনসহ পেশাগত শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণের হার এর সামান্য বেশি।

একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ২০২০ সাল নাগাদ উচ্চপর্যায়ের শিক্ষায় নারী-পুরুষের অনুপাত সমান করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।

জেন্ডার বিশেষজ্ঞ ফেরদৌসী সুলতানা মনে করেন, এ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে দেরি হতে পারে। তবে তা অর্জন করা সম্ভব। তবে এর জন্য কিছু শর্তের কথা বলেন তিনি। এর মধ্যে আছে মেয়েদের স্কুল থেকে ঝরে পড়া কমানো। ভয়ভীতি উপেক্ষা করে মেয়েরা যেন কলেজ বা উচ্চশিক্ষার কেন্দ্রে যেতে পারে সেই পরিবেশ তৈরি। শিক্ষা ব্যয় বহন করতে অক্ষমদের সহায়তা করা। কারিগরি ও বিজ্ঞানশিক্ষায় মেয়েদের আরও উৎসাহিত করতে হবে। আর প্রত্যন্ত এলাকার মেয়েশিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে।

ফেরদৌসী সুলতানা বলেন, ‘এসব বিষয়ে সরকারের সহযোগিতা দরকার। আর মেয়েকে নিয়ে বাবা–মাকেও বিয়ের বাইরে অন্য স্বপ্ন দেখেতে হবে।’

গত কয়েক বছরে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদে নারীদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ এবারের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, প্রশাসন ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের উচ্চ পদে নারীদের নিয়োগ আরও বাড়ানো হবে।

নারী সংগঠন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম অবশ্য মনে করেন, এটা যথেষ্ট না। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘পদায়ন হচ্ছে কিন্তু ক্ষমতায়ন হচ্ছে না। দুটোর মধ্যে পার্থক্য আছে। প্রতীকী ক্ষমতায়নের চেয়ে প্রকৃত ক্ষমতায়ন দরকার।’

এদিকে বাংলাদেশের অর্থনীতির মূলধারার কর্মক্ষেত্রগুলোতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েই চলেছে। সরকারি-বেসরকারি উভয় চাকরিতেই নারীর আসা বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী ২০০০ সালে শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ ছিল এক-চতুর্থাংশের মতো। এখন নারী এক-তৃতীয়াংশের কিছু বেশি।

তবে প্রযুক্তিগত কাজে নারীর চেয়ে পুরুষ অনেক বেশি। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাময়িকী বাংলাদেশ উন্নয়ন সমীক্ষায় গত মাসে একটি গবেষণা প্রতিবেদন বেরিয়েছে। তাতে দেখা যায়, ২০১৭ সালে কারিগরি পেশায় নিয়োজিত ১ হাজার ৪৬৯ জনের তিন-চতুর্থাংশের বেশিই পুরুষ।

তার ওপর নারীর আয় এখনো পুরুষের তুলনায় কম। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছর পুরুষেরা নারীদের চেয়ে আড়াই গুণ বেশি আয় করতেন। এ বছরে নারীর মাথাপিছু গড় আয় ছিল দুই হাজার ডলারের মতো আর পুরুষের ছিল পাঁচ হাজার ডলারের বেশি।

আবার জাতিসংঘের নারীবিষয়ক সংস্থা বলছে, দেশের উদ্যোক্তাদের মধ্যে নারী ১০ ভাগের কম। স্বীকৃত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে যতজন হিসাব খোলেন, তাঁদের মাত্র এক-চতুর্থাংশ নারী।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান বলছেন, মধ্য ও নিম্ন আয়ের নারীদের জন্য পেশায় প্রবেশ এবং উদ্যোক্তার ভূমিকা নেওয়াটা জরুরি। কিন্তু তা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাঁর মতে, এর একটি কারণ ভীতি। আরেকটি হলো অন্যায্য পরিবেশ, যেখানে সুশাসনের অভাব এবং পেশিশক্তির প্রভাব আছে। কাজে ঢোকার আগেই এসব বাধার সঙ্গে যুঝতে হয় নারীকে। কর্মক্ষেত্রে পরিবেশের সমস্যা তো আছেই।

নারীদের রাজনৈতিক নেতৃত্বে না যেতে পারার পেছনেও একই ধারার কারণ আছে। ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের সংখ্যা ৪৫ থেকে বাড়িয়ে ৫০ করা হয়েছিল। গত বছর সংরক্ষণের মেয়াদ আরও ২৫ বছর বাড়ানো হয়।

নারী অধিকারকর্মীরা বরাবরই অন্তত এক-তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষণ এবং সেগুলোতে সরাসরি নির্বাচনের দাবি করে আসছেন। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ইশতেহারে আওয়ামী লীগও এ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তবে দলটি তা পূরণ করেনি।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহান বলেছেন, সরকার এখনো সরাসরি নির্বাচনের উদ্যোগ নিচ্ছে না। তাঁর মতে, এ ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা আছে। সংসদে নির্বাচিত হয়ে আসতে অর্থ, পেশিশক্তি এবং পারিবারিক অবস্থান বড় বিবেচ্য বিষয়। বেশির ভাগ সময়েই নারীরা পুরুষের মতো অর্থ ও পেশিশক্তির প্রমাণ দেখাতে পারেন না।

রওনক জাহান বলেন, ‘একমাত্র পারিবারিক পরিচিতির মাধ্যমেই নারীরা রাজনীতিতে সাফল্য লাভ করতে পারছেন বা সংসদে নির্বাচিত হতে পারছেন।’ তিনি প্রশ্ন করেন, যে নারীর পেছনে শক্তিশালী পরিবার নেই, তিনি রাজনীতিতে ঢুকবেন কীভাবে?

এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মতে, সরাসরি নির্বাচন না হলে নারীরা মনোনয়ন পান দলের প্রতি আনুগত্যের বিচারে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘মনোনীত নারীদের নিজের এলাকায় জনসাধারণের ভোট অর্জন করার প্রতিযোগিতা করতে হয় না। সেই অর্থে তাঁরা জনপ্রতিনিধি হিসেবে অন্য সাংসদদের মতো সম্মান পান না।’

২০০৮ সালে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করে নির্বাচন কমিশন। কমিশন তখন বিধান দিয়েছিল, ২০২০ সালের মধ্যে দলগুলোর সব স্তরের কমিটিতে নারী প্রতিনিধিত্ব ৩৩ শতাংশ করতে হবে।

এ পর্যন্ত ৪০টি দল নিবন্ধন নিয়েছে। সময়সীমা আগামী বছর শেষ হচ্ছে। এখন পর্যন্ত প্রায় কোনো দলই এ বিধান পালন করতে পারেনি।

কমিশন প্রতিবছর জুলাই মাসে দলগুলোর কাছে এ বিষয়ে অগ্রগতি জানতে চায়। গত জুলাই মাস নাগাদ আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির মতো বড় দলগুলো বলেছিল, তারা সব স্তরে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্ব আনতে পেরেছে। এই দলগুলোর শীর্ষ নেতৃত্বে রয়েছেন নারীরা।

ইসি সচিবালয়ের নির্বাচন সমন্বয় ও সহায়তা শাখার উপসচিব আবদুল হালিম খান প্রথম আলোকে গত বৃহস্পতিবার বলেন, ‘সব দলই ২০২০ সালের মধ্যে শর্ত পূরণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে তারা এটা পারবে কি না, সেটাই দেখার বিষয়।’

নারী অধিকারকর্মীরা বলছেন, সব রকম বৈষম্যের মূলে আছে পরিবার এবং সমাজে নারীর অধস্তন অবস্থান এবং সেটার সমর্থক দৃষ্টিভঙ্গি। সম্পদে সমান অধিকার না থাকলে নারীর অধস্তন অবস্থান বা এ দৃষ্টিভঙ্গির বাধাগুলো কাটবে না। আর তাই তাঁরা চাইছেন, উত্তরাধিকারসহ পারিবারিক আইনগুলোর অসম বিধানের সংস্কার।

এখন একেক ধর্মের জন্য পারিবারিক আইনের বিধান আলাদা, অধিকারগুলো অসম। নারী অধিকারকর্মীরা অনেক দিন থেকেই একটি সর্বজনীন ও সম-অধিকারভিত্তিক পারিবারিক আইন দাবি করে আসছেন।

জাতিসংঘের নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ (সিডও) সনদের ২ ও ১৬ (১) (গ) ধারাতে বিষয়গুলোর উল্লেখ আছে। বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৪ সালে সনদটি অনুমোদন করেছে, তবে উল্লিখিত ধারাগুলো বাদে। ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ এ ধারাগুলো থেকে আপত্তি তুলে নেওয়ার অঙ্গীকার করেছিল। কিন্তু ক্ষমতায় এসে দলটি ধর্মীয় ও সামাজিক অনুভূতিতে আঘাত না করার যুক্তিতে পিছু হটে যায়।

এবারও একই দল ক্ষমতায়। দলটির আন্তর্জাতিক-বিষয়ক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি, নিজস্ব মূল্যবোধের ওপর নির্ভর করেই আইন হবে। সরকার নারী-পুরুষের সমতা আনতে সচেষ্ট। পারিবারিক আইনের সংস্কারের বিষয়টি নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আলোচনার বিষয়।’

পরিবারে ও সমাজে সম–অধিকার আর মর্যাদা নিশ্চিত না হলে নারীর প্রতি সহিংসতা ঠেকানোও কঠিনতর হবে। মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম যেমনটা মনে করেন, বিষয়গুলো এক সুতোয় বাঁধা। তাঁর কথায়, এ সহিংসতা নারীদের কষ্টার্জিত অর্জনগুলো নষ্ট করে দিচ্ছে। তিনি বলেন, ‘সামাজিক অগ্রগতি বজায় রাখতে হলে সহিংসতা বন্ধ করতেই হবে। আর এ জন্য চাই সমতাভিত্তিক সমাজ। আর তার জন্য দরকার উদার আইন এবং এর প্রয়োগ।’

আগামী পর্ব: মতপ্রকাশের স্বাধীনতা