Thank you for trying Sticky AMP!!

নিখোঁজ স্বজনের খোঁজে মিছিল

মেয়ের ছবি নিয়ে রানা প্লাজার সামনে এসে সজল চোখে তাকিয়ে ছিলেন রাশেদা বেগম। মেয়ে নাসিমা আক্তার ধসে পড়া ওই ভবনের তৃতীয় তলায় কাজ করতেন। ৪০ দিনেও মেয়ের খোঁজ পাননি তিনি। রাশেদা বেগম সাভারের বক্তারপুরে থাকেন। স্বামী আবুল কালাম আজাদের চায়ের দোকান। কাজল আক্তার আর রাজন নামের আরও দুটি ছেলেমেয়ে আছে তাঁর। কিন্তু বড় মেয়ে নাসিমাকে ভুলতে পারেন না রাশেদা। প্রতিদিনই একবার চলে আসেন রানা প্লাজার সামনে। ব্যথাভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে ফেলার পর খাদের মতো জায়গাটির দিকে।

গতকাল দুপুরে কথা হলো তাঁর সঙ্গে। জানাই তো আছে এখানে এসেও কোনো লাভ নেই। তবু কেন আসেন? বললেন, ‘আসি, চাইয়া চাইয়া দেহি। মনে একটু শান্তি পাই। এইখানে মাইয়া কাম করত। মনে হয় এই বুঝি মা বইলা ডাইক্যা ওঠে।’

এদিকে গতকাল রানা প্লাজার সামনে থেকে বেরিয়েছিল মিছিল। বেলা তখন সাড়ে ১১টার মতো। লোক বেশি নয়, বড়জোর শ খানেক। মুখে স্লোগান ‘নিখোঁজ শ্রমিক গেল কই, জবাব চাই, জবাব চাই’। কে দেবে জবাব, কার জানা আছে উত্তর? মিছিলে অংশ নেওয়া স্বজনহারা মানুষগুলো তা জানেন না।

সেই প্রশ্নের উত্তর জানতেই মিছিল করে তাঁরা গিয়েছিলেন সাভার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে। রানা প্লাজা ধসের ৪০ দিন পরও কয়েক শ মানুষ স্বজনের খোঁজ পাননি। পাননি আর্থিক সহায়তাও। এদিকে উদ্ধার তৎপরতা শেষ হয়েছে ঢের আগেই। আহত ব্যক্তিদের বেতনও দেওয়া হয়েছে। নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের কেউ কেউ সরকারি সাহায্য পেয়েছেন, কেউ পাননি। কিন্তু নিখোঁজদের পরিবার একেবারেই কিছু পায়নি—না বেতন, না অন্য কারও সাহায্য।

মানিকগঞ্জের দৌলতপুর গ্রামের লাকি বেগম মিছিলে এসেছেন মেয়ে কাঞ্চনমালার ছবিসংবলিত ‘সন্ধান চাই’ লেখা বিজ্ঞপ্তি নিয়ে। কাঞ্চনমালা রানা প্লাজার তৃতীয় তলায় নিউওয়েভ বাটন লিমিটেডে কাজ করতেন। ডিএনএ পরীক্ষার জন্য লাকি ঢাকা মেডিকেল কলেজে রক্ত দিয়ে এসেছেন। সেখান থেকে বলা হয়েছে, পরে জানানো হবে। কত দিন পর, তা বলা হয়নি। কোনো সাহায্য, ক্ষতিপূরণ বা মেয়ের বেতন কিছুই পাননি তিনি।

রানা প্লাজায় নিহত-আহত-নিখোঁজ শ্রমিকদের স্বার্থে গত ১৮ মে নিউওয়েভ স্টাইলের লাভলী খাতুনকে সভাপতি ও নিউওয়েভ বাটন স্টাইলের আকাশ শেখকে সাধারণ সম্পাদক করে গঠন করা হয়েছে ‘রানা প্লাজা গার্মেন্ট শ্রমিক ইউনিয়ন’। তারাই গতকাল নিখোঁজ ও নিহত ব্যক্তিদের স্বজনদের নিয়ে এই মিছিলের আয়োজন করে। রানা প্লাজার সামনে থেকে মিছিলটি উপজেলা পরিষদে গিয়ে সেখানে মানববন্ধন করে।

লাভলী খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, এখানে অনেকেই আছেন, যাঁরা ভবনধসের খবর পেয়ে দূরদূরান্ত থেকে এসেছেন। তাঁরা স্বজনদেরও পাননি। পাননি অর্থসাহায্যও। উদ্ধারকাজের সময় তাঁরা ছিলেন অধরচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে। সেখানে বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তির তরফ থেকে দুবেলা খাবার দেওয়া হতো। থাকতেন স্কুলের বারান্দাতেই। উদ্ধারকাজ শেষ হওয়ায় এখন এই সুবিধাগুলো নেই। ডিএনএ পরীক্ষার জন্য রক্ত দিয়েছেন। বলা হয়েছে, যোগাযোগ করা হবে। এদিকে এঁদের হাতে টাকাপয়সাও নেই। চরম অনিশ্চিত অবস্থায় আছেন এসব মানুষ।

তাঁরা মানববন্ধন করে বেতন ও ক্ষতিপূরণ চাইছেন, নিখোঁজদের সন্ধান চাইছেন। ইউএনও তাঁদের আশ্বাস দিয়েছেন, তাঁদের কথা ওপর মহলে জানাবেন।

নিখোঁজের সংখ্যা নিয়ে সন্দেহ: ইউএনও কার্যালয়ে রানা প্লাজা ধসে আহত-নিহত-নিখোঁজদের বিষয়ে একটি তথ্যকেন্দ্র খোলা হয়েছে। এখানে নিখোঁজের তালিকায় নাম আছে ৩১৬ জনের। ইউএনও মোহাম্মদ কামরুল হাসান মোল্যা প্রথম আলোকে বলেন, মর্গে অশনাক্ত মৃতদেহ ছিল ৩০১টি। আর ডিএনএ পরীক্ষার জন্য রক্তের নমুনা দিয়েছেন ৩৭৬ জন। হয়তো একই পরিবারের একাধিক জন নমুনা দিয়েছেন, সে কারণে নমুনাদাতার সংখ্যা বাড়তে পারে। তিনি বলেন, স্বজনহারাদের জন্য স্থানীয়ভাবে তাঁদের কিছু করার নেই। বিষয়টি তিনি তাঁদের বুঝিয়ে বলেছেন, ওপরে জানাবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন।

এই আশ্বাসে সান্ত্বনা খুঁজে পাননি স্বজনহারা মানুষ। তাঁদের করারও কিছু ছিল না। ইউএনও অফিসের সামনে খানিক অপেক্ষা করে হতাশা নিয়ে যে যার মতো ফিরেগেছেন।