Thank you for trying Sticky AMP!!

নিরাপত্তাহীনতা এখন ভয়াল ও সর্বগ্রাসী

শাহদীন মালিক

মনে পড়ে গেল বহু দশক আগে নির্মল সেনের একটা কলামের শিরোনাম, ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’। আর এ মাসের ১৪ জুলাই প্রথম আলোতে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক খুবই অল্প কথায় দেশের বর্তমান চিত্র অদ্ভুত সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। ফজলুল হকের কাছে প্রথম আলোর প্রশ্ন ছিল, ‘আপনার দৃষ্টিতে দেশ কেমন চলছে’। উত্তরে বলেছিলেন, ‘ভালো-মন্দ মিলিয়ে। তবে মন্দের কর্তৃত্বই বেশি। জনসাধারণ মনোবলহারা, নেতৃত্বহীন। বাংলাদেশ পরিণত হচ্ছে ধর্ষণের দেশে। মাদকাসক্তি, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু বেড়েছে, বাড়ছে। সরকারের পক্ষ থেকে ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ ইত্যাদি বলে বিনা বিচারে সন্দেহভাজনদের হত্যা বেড়ে চলেছে। সরকারি দলের অনেক লোকের ও পুলিশের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। বিচারব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ। প্রশাসনব্যবস্থাসহ রাষ্ট্রীয় সব ব্যবস্থাই দারুণভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত। শিক্ষাব্যবস্থা রাষ্ট্রগঠনের ও জাতিগঠনের পরিপন্থী। রাজনীতি দারুণভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত। রাজনৈতিক দলের রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য নেই। দুর্বৃত্তায়িত।’

তাঁর প্রতিটি শব্দ ও বাক্য যে নির্ভুল, তার একটা প্রমাণের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছিল মাত্র এক দিন, ১৫ জুলাই পর্যন্ত। ওই দিন বিকেল থেকে যে খবরটা সারা দেশে ছড়িয়ে গেছে, তা হচ্ছে আদালতকক্ষে এবং পরে বিচারকের খাসকামরায় এক আসামির ছুরিকাঘাতে অন্য এক আসামির খুন হওয়ার ঘটনা।

আদালতে দিনদুপুরে বহু ব্যক্তির উপস্থিতিতে ঘটে এ হত্যাকাণ্ড। তবে প্রশংসা করতে হয় আদালতে সাক্ষ্য দিতে আসা পুলিশের এএসআই ফিরোজ আহমেদের, তিনি ঘাতক হাসানকে জাপটে ধরে ফেলেন। এত কালো আঁধারের মধ্যে একটু হলেও আলোকরশ্মি।

২) আমাদের এই ভয়াল ও ভয়ংকর নিরাপত্তাহীনতার মধ্যেও কিছু লোক নিরাপদে আছেন। কিছুকাল আগে সামাজিক অনুষ্ঠানে একজন ওসির সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই টের পেয়েছিলাম তাঁর একজন গানম্যান আছে। গানম্যান এখন ক্ষমতা ও স্ট্যাটাসের পরিচায়ক। সরকারি দলের বেশ কিছু আইনজীবী সুপ্রিম কোর্টের বারান্দায় আজকাল চলাফেরা করেন সামনে–পেছনে গানম্যান নিয়ে। আরেকটু উঁচু দরের হলে তাঁর পেছনে থাকে একগাড়ি পুলিশ। আরও উঁচুতে উঠলে সামনে–পেছনে উভয় দিকেই থাকে পুলিশের গাড়ি। তারপরও আছে এই প্রচণ্ড যানজটে ঢাকা শহরে ১০০ কিলোমিটার বেগে যাত্রা নিশ্চিত করার জন্য রাস্তা খালি করে দেওয়ায় নিয়োজিত বহু বহু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গর্বিত সদস্য। মুষ্টিমেয় এই যে কয়েক শ ব্যক্তি অথবা হাজার দুয়েক, যাঁরা সারাক্ষণই পুলিশের বেষ্টনীর মধ্যে আছেন। তাঁরা নিশ্চয়ই তাঁদের নিরাপত্তাব্যবস্থায় থাকেন প্রফুল্লচিত্তে।

বাকি ১৬ কোটির বেশি মানুষের অনেকেই প্রতিদিন মরছে ক্রসফায়ারে, বন্দুকযুদ্ধে, হত্যায়, ধর্ষিত হয়ে, লুণ্ঠিত হয়ে, চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসীর শিকারে পরিণত হয়ে, বাসে-ট্রাকে-মাইক্রোবাসে-রিকশায়-মোটরসাইকেলে-ট্রেনে-লঞ্চে তথাকথিত দুর্ঘটনার শিকার হয়ে। শিশুরা মরছে বিষাক্ত দুধপানে, মরছে ডেঙ্গু জ্বরে, মরছে বড়রাও অ্যান্টিবায়োটিকের বিষক্রিয়ায় আচ্ছন্ন হাঁস-মুরগি-গরু খেয়ে।

বেশ কিছুদিন আগে অনেক উঁচু দরের এক ব্যক্তির বাসায় দাওয়াতে গিয়ে খুব সুস্বাদু একটা মাছ খেয়েছিলাম। কী মাছ কোথায় পেলেন গোছের জবাবে উত্তর এসেছিল, সকালে ব্যাংকক থেকে আনিয়েছি। তাঁরা কেবল এই দেশের বিষাক্ত বায়ুতে শ্বাস নেন আর বাকি সব হিসাবেই তাঁরা নিরাপদ।

আমরা এখন কোথাও নিরাপদ নই। প্রকাশ্য আদালতেও না।

৩) আদালতে, স্কুলে-কলেজে, রেস্টুরেন্টে, দোকানে মেটাল ডিটেক্টর, পুলিশ আর পাহারাদার বসিয়ে নিরাপত্তা বৃদ্ধির উদ্ভট চেষ্টার প্রস্তাব অনেকেই হয়তো এখন দেবেন। ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৩০ কোটির কিছু বেশি জনগণের হাতে বন্দুকের সংখ্যা অনুমান করা হয় কমবেশি ২০০ কোটি। আর সে দেশেই বন্দুক দিয়ে মানুষ খুন হয় সবচেয়ে বেশি। দুর্বৃত্তায়িত, রাজনীতি প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দেশে জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রায় অসম্ভব। কারণ সোজা, নিরাপত্তার হুমকি আর নিরাপত্তাহীনতা আসছে দুর্বৃত্তায়িত, লুটেরা ও দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং এমনকি রাজনৈতিক চুনোপুঁটির দাপটে। দায়িত্ব ও আদর্শবিহীন দলীয় ক্যাডারে পরিণত হওয়া প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের কাছ থেকে আর ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার, গুম ও ঘুষে সিদ্ধহস্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বদৌলতে। ক্ষমতার লোভে ও পাপে এ রকমভাবে দুর্বৃত্তায়িত, দুর্নীতিগ্রস্ত এবং এর ফলে নিরাপত্তাহীনতায় ছেয়ে গেছে বহু দেশ। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় অজানা নয়। কিন্তু যাঁরা ঘি আর ক্রিম, হালুয়া-রুটি, বিদেশের ব্যাংকে কাঁড়ি কাঁড়ি ডলার এবং নিজেদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য গানম্যান ও হালি হালি পুলিশ পান, তাঁরা সমাজকে ভালো, সভ্য ও নিরাপদ করতে দেবেন না। ফলে ক্রমান্বয়ে এই সমাজ আরও বর্বর, আরও অসভ্য আর আমাদের সবার জন্য আরও নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়বে। তবু আমরা, নাগরিকেরা আশা ছাড়ব না। পরিত্রাণের একটা উপায়, একটা পথ আমরা খুঁজে পাবই পাব।

ড. শাহদীন মালিক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের আইনের শিক্ষক।