Thank you for trying Sticky AMP!!

নির্বাচনকে অধিক গুরুত্বে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে গণতন্ত্র

সংকটকবলিত রাজনীতির দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই সমাধানের লক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি পদের পূর্ণ স্বাধীনতা, প্রধানমন্ত্রীর কর্তব্য ও দায়িত্ব পুনর্নির্ধারণ করাসহ সংবিধানের কয়েকটি ধারা এবং সাংবিধানিক বিধিবদ্ধ সংস্থাগুলোর সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছে উদ্বিগ্ন নাগরিক সমাজ। নাগরিক ওই সংগঠনের প্রতিনিধিরা বলেন, দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল নির্বাচনের ওপর অত্যধিক গুরুত্ব দেওয়ায় পূর্ণ গণতন্ত্রের পথে বাংলাদেশের অভিযাত্রা অনেকটাই বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
গতকাল রোববার জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের প্রতিনিধিরা এসব কথা বলেন। ‘পূর্ণ গণতন্ত্রের পথে অভিযাত্রা: কিছু প্রস্তাবনা’ শীর্ষক ওই সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান উদ্বিগ্ন নাগরিক সমাজের আহ্বায়ক ও সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ টি এম শামসুল হুদা।
বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের হরতাল-অবরোধ চলাকালে সহিংস ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিশিষ্ট কয়েকজন নাগরিক একত্র হয়ে এই প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেন। তাঁরা পরিস্থিতির ভয়াবহতা তুলে ধরে সংলাপের উদ্যোগ নিতে রাষ্ট্রপতি এবং সংলাপে বসতে প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসনকে চিঠি লেখেন। সেই চিঠির জবাব তাঁরা পাননি বলেও জানান সংবাদ সম্মেলনে।
তবে উদ্বিগ্ন নাগরিকেরা মনে করেন, রাজনীতিতে যে গুণগত পরিবর্তন তাঁরা প্রত্যাশা করছেন, সেটা আনতে পারেন রাজনীতিবিদেরাই। এ প্রসঙ্গে তাঁরা ১৯৯০ সালে তিন জোটের রূপরেখার কথা উল্লেখ করে বলেন, অতীতে বিভাজিত রাজনীতি থাকলেও দেশের স্বার্থে তাঁরা একমত হয়েছেন।
উদ্বিগ্ন নাগরিকেরা বলেন, প্রতিটি নির্বাচনের আগেই আন্দোলন, সন্ত্রাস ও সহিংসতা হয়। এ অবস্থার পুনরাবৃত্তি হোক, এটা কেউ চায় না। বিদ্যমান সরকারের ওপর বিরোধী দলেরও আস্থা থাকছে না। এ অবস্থায় জোড়াতালি দিয়ে একটা নির্বাচন হয়ে গেলেও একই সমস্যা ঘুরেফিরে আসছে। নির্বাচিত সরকার সুশাসন নিশ্চিত করা, দুর্নীতি বন্ধ করা, নির্বাচন কমিশন ও বিচার বিভাগের সংস্কার করার বিষয়গুলো ভুলে যাচ্ছে।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, ‘দুর্ভাগ্যবশত আমাদের নেতারা সজ্ঞানে কিংবা অজ্ঞানে এটা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছেন যে জাতীয় নির্বাচনের পাশাপাশি সাংবিধানিক ও বিধিবদ্ধ সংস্থাগুলোকে শক্তিশালী ও জবাবদিহিমূলকভাবে গড়ে তুলতে হবে। দায়িত্বশীল বিরোধী দলের উপস্থিতি এবং জাতির বৃহত্তর স্বার্থে অতীত ও বর্তমানের বিষয়ে আপস-মীমাংসার মানসিকতা থাকা যে গণতন্ত্র বিকাশের জন্য অপরিহার্য, সেটাও উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছেন।’
সংবাদ সম্মেলনে দুঃসহ রাজনৈতিক সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধানে ঐকমত্য সৃষ্টির লক্ষ্যে কিছু প্রস্তাব তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে সাংবিধানিক সংস্কারের মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রপতি পদের পূর্ণ স্বাধীনতা; রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের ভারসাম্য আনা; রাষ্ট্রপতির অনুমোদন ক্ষমতা, ঐচ্ছিক ক্ষমতা ও ভিন্নমত প্রদানের ক্ষমতা থাকা; প্রধানমন্ত্রীর কর্তব্য ও দায়িত্ব পুনর্নির্ধারণ করা; সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা রেখে নারীদের জন্য নির্দিষ্টসংখ্যক সংসদীয় আসন সংরক্ষণ; জাতীয় ও স্থানীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে গণভোট চালু করা; বাজেট ও দলের বিরুদ্ধে অনাস্থার পরিস্থিতি ছাড়া দলের বিরুদ্ধে সাংসদ ভোট দিতে পারবেন না মর্মে সংবিধানের ৭০ ধারা রহিত করা প্রভৃতি।
এ ছাড়া সাংবিধানিক বিধিবদ্ধ সংস্থাগুলোর মধ্যে জাতীয় সংসদ, সুপ্রিম কোর্ট, নির্বাচন কমিশন, সরকারি কর্মকমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, তথ্য কমিশন, মানবাধিকার কমিশন ও আমলাতন্ত্রের সংস্কারের প্রস্তাব দেওয়া হয়।
পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চা, দলগুলোর আর্থিক স্বচ্ছতা, রাজনৈতিক দলগুলোর বিদেশি শাখা বিলুপ্ত করা এবং ছাত্র-পেশাজীবী সংগঠনগুলোকে দলের কাঠামো থেকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে এ টি এম শামসুল হুদা জানান, তাঁরা মনে করেন সংস্কার নিয়ে তাঁদের প্রস্তাবগুলো সম্পর্কে আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক ও চর্চা চলতে থাকলে সত্যিকার গণতান্ত্রিক পরিবেশ কোনো না কোনো সময় ফিরে আসবে।
গণতন্ত্র ছাড়া উন্নয়ন হতে পারে কি না—সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের মানুষের ডিএনএতে জড়িয়ে আছে গণতন্ত্র। আরেক প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক চৌধুরী বলেন, দুর্নীতি থাকলেও উন্নয়ন হতে পারে। কিন্তু দুর্নীতি না থাকলে উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, দুর্নীতির কারণে মানুষের দুর্ভোগ হয়। গণতন্ত্র ছাড়া উন্নয়ন হতে পারে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, উন্নয়ন মানে রাস্তাঘাট, সেতু-কালভার্ট শুধু নয়। সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা ও আইনের শাসন ছাড়া কোনো উন্নয়নের সুফল মানুষ পাবে না।
কলামিস্ট ও সাংবাদিক সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ‘দেশে অন্তত তিন ধরনের নাগরিক সমাজ আছে। একটি সরকারপন্থী নাগরিক সমাজ, যাদের সেমিনার ও গোলটেবিল বৈঠকে সরকার পৃষ্ঠপোষকতা করে। বিরোধী দলপন্থী নাগরিক সমাজের পৃষ্ঠপোষকতা করে বিরোধী দল। ওই দুই গ্রুপের বাইরে উদ্বিগ্ন নাগরিক সমাজ চায় বসবাসযোগ্য বাংলাদেশ, যেখানে ন্যায়বিচার, সামাজিক মূল্যবোধ ও মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার সমুন্নত থাকবে।’
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আফগানিস্তানে তালেবানদের উত্থানের বড় কারণ ছিল দুর্নীতি ও নির্বাচনে কারচুপি। তাঁর মতে, মানুষ যখন ন্যায়বিচার পায় না, তখন ধর্মাশ্রয়ী হয়। অসুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ, দুর্নীতি ও দুঃশাসন ধর্মীয় উগ্রবাদকে উৎসাহিত করে।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহম্মেদ বলেন, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহের কাছে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং ক্ষমতা ও সম্পদ হস্তান্তর করা উচিত। স্থানীয় সরকার সংস্থাসমূহের কাঠামো ও নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কার এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া স্থানীয় সরকার সংস্থাসমূহের অধিক্ষেত্র অন্য কর্তৃপক্ষের আগ্রাসন থেকে মুক্ত রাখতে হবে।
সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্স লিগ্যাল অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের নির্বাহী পরিচালক মনজুর হাসান বলেন, দুর্নীতি থাকলে উন্নয়ন ভালো হয়, এ কথা বলা হলেও গবেষণায় দেখা যায়, দুর্নীতির কারণে প্রবৃদ্ধি কমে যায়। পরিণামে দেশের ক্ষতি হয়, বিত্তবান ও বিত্তহীনের ব্যবধান বেড়ে যায়। সর্বোপরি দুর্নীতি গণতন্ত্রকে খাটো করে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান মনসুর।