Thank you for trying Sticky AMP!!

নির্বাচন করার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের!

গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালক নির্বাচন পরিচালনা করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আগে কোনো ব্যাংকের মালিকদের পর্ষদ নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সম্পৃক্ততা ছিল না।
সরকারের দাবি অনুযায়ী, গ্রামীণ ব্যাংকে ২৫ শতাংশ মালিকানা সরকারের, আর বাকি ৭৫ শতাংশ মালিকানা ঋণগ্রহীতা সদস্যদের। এত দিন গ্রামীণ ব্যাংকের তত্ত্বাবধানেই ঋণগ্রহীতা সদস্যদের মধ্য থেকে পরিচালক নির্বাচন করা হতো। এখন তা বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে গেল। নির্বাচন বিধি পরিবর্তনের বিষয়ে গ্রামীণ ব্যাংক তথা পর্ষদ সদস্যদের কোনো মতামত নেওয়া হয়নি।
সরকার এ জন্য গ্রামীণ ব্যাংক (পরিচালক নির্বাচন) বিধিমালা, ২০১৪ প্রণয়ন করেছে। এর ফলে গ্রামীণ ব্যাংকে রাজনীতি প্রবেশের সুযোগ করে দেওয়া হলো। এর মধ্যে সম্প্রতি গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মচারী সমিতির নির্বাচনে এমনটা হয়েছে। ভোটদাতাদের অপহরণ, মারধরের ঘটনাও ঘটে। গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের আদলেই কর্মচারী সমিতির নির্বাচন হয়।
রাজনীতিকরণের এ আশঙ্কার কথা বললেন সরকারের নিয়োগ দেওয়া গ্রামীণ ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যান খন্দকার মোজাম্মেল হকও। যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘নতুন বিধিমালায় নির্বাচন হলে রাজনীতি ঢুকে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে রাজনীতি ঢুকতে সময় লাগবে। নতুন বিধিমালা সম্পর্কে গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে আমার কোনো মতামত নেওয়া হয়নি।’ উল্লেখ্য, খন্দকার মোজাম্মেল হক গত বছর চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করলেও অর্থমন্ত্রী তা গ্রহণ করেননি।
৬ এপ্রিল বিধিমালাটি কার্যকর করে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। এর ফলে আগামী ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে।
সাধারণত বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকে বার্ষিক সাধারণ সভায় (এজিএম) পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা নির্বাচিত হন। আর শতভাগ
রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকে সরকারের পক্ষে অর্থ মন্ত্রণালয় পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের নিয়োগ দেন। পরিচালক নির্বাচনের কোনো পর্যায়েই বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্পৃক্ততা নেই।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার গত মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই নোবেল বিজয়ী গ্রামীণ ব্যাংক ও এর প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি বিরূপ আচরণ শুরু হয়। ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে বয়স পেরিয়ে যাওয়ায় আদালতের নির্দেশে ২০১১ সালে ড. ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এর পরও গত তিন বছরে পছন্দের কাউকে নতুন এমডি পদে নিয়োগ দিতে পারেনি পরিচালনা পর্ষদ। ভারপ্রাপ্ত এমডি দিয়েই চলছে গ্রামীণ ব্যাংক।
প্রথম থেকেই গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে সরকারের বিভিন্ন নিয়োগের বিরোধিতা করে আসছেন বোর্ডের নারী সদস্যরা। ফলে গ্রামীণ ব্যাংকের নীতিনির্ধারণী অনেক বিষয়ে উচ্চমহলের ইচ্ছার প্রতিফলন হচ্ছিল না। এমন প্রেক্ষিতে পরিচালক বা বোর্ড সদস্য নির্বাচন বিধিমালাই বদলে ফেলা হলো।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম মনে করেন, সরকারের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নতুন বিধিমালা করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারবে কি না সন্দেহ রয়েছে। সরকারের পছন্দের লোককে পাস করিয়ে আনতে নির্বাচন কমিশন মরিয়া হয়ে উঠতে পারে। তাঁর মতে, বাংলাদেশের মতো দেশে জাতীয় নির্বাচনেও নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না। গ্রামীণ ব্যাংকে কীভাবে করা সম্ভব হবে সেটাই দেখার বিষয়।
নতুন বিধিমালায় নির্বাচনপদ্ধতির মৌলিক পরিবর্তন না হলেও নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব পুরোপুরি বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে দেওয়া হয়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন নির্বাহী পরিচালক এবং দুই কমিশনার হিসেবে গ্রামীণ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক ও ক্ষুদ্রঋণ নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের (এমআরএ) পরিচালককে নিয়োগ দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। রিটার্নিং কর্মকর্তাও থাকবেন বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা। তফসিলি ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা, প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ও সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হবে।
এ সম্পর্কে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আকবর আলি খান প্রথম আলোকে বলেন, কোনো ব্যাংকের মালিকানা পর্ষদের নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব পালন করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক—এ ধরনের নজির নেই। তবু তারা এ আইন করেছে। এভাবে নির্বাচন করা হলে গ্রামীণ ব্যাংকে রাজনীতি ঢুকে পড়বে। গ্রামীণ ব্যাংকের বড় ক্ষতি হবে। যেভাবে চলছে, সেভাবেই চলতে দেওয়া উচিত।
বিধিমালায় যা আছে: আগের মতো কেন্দ্রপ্রধানেরা ভোটের মাধ্যমে তাঁদের মধ্য থেকে একজন শাখা প্রতিনিধি নির্বাচিত করবেন। একই প্রক্রিয়ায় শাখা প্রতিনিধিদের ভোটের মাধ্যমে একজন এলাকা বা এরিয়া প্রতিনিধি নির্বাচিত হবেন। এরপর এলাকা প্রতিনিধিদের মধ্য থেকে অঞ্চল প্রতিনিধি নির্বাচিত করা হবে। এভাবেই ৪০টি অঞ্চল প্রতিনিধি থেকে নয়জন পরিচালক নির্বাচিত হবেন। নির্বাচনের প্রতিটি স্তরে আগের মতোই ভোটের ব্যবস্থা করা হবে।
বিধিমালার ৮(১) ধারায় রিটার্নিং কর্মকর্তাকে ভোটকেন্দ্র কোথায় হবে তা নির্ধারণের বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীদের এলাকাবলয়ের মধ্যে ভোটকেন্দ্র স্থাপিত হলে দরিদ্র নারী ভোটারদের পক্ষে প্রভাবমুক্ত হয়ে ভোট দেওয়া সম্ভব নয় বলে একাধিক সদস্য প্রথম আলোকে জানিয়েছেন।
এ ছাড়া বিধিমালার ২০(৬) ধারার (ক) উপধারায় ভোটারকে অবশ্যই সই করে ব্যালটপত্র নিতে হবে। দরিদ্র ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই এমন নারীরাই গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্য। তাই স্বাক্ষর দিয়ে ভোটারদের ব্যালটপত্র নেওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। জাতীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রেও টিপসই দিয়ে ব্যালটপত্র নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
নির্বাচনে প্রচার-প্রচারণা করার ক্ষেত্রে কোনো নির্দেশিকা বিধিমালায় নেই। ভয়, হুমকি বা প্রলোভনের জন্য কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও বলা হয়নি বিধিমালায়। এমনকি ভোট গ্রহণের দিনে ভোটারদের নিরাপত্তা প্রদানের বিষয়টিও উপেক্ষিত রয়েছে।
সাবেক সচিব মামুন উর রশিদের নেতৃত্বে গঠিত গ্রামীণ ব্যাংক অনুসন্ধান কমিশনের সুপারিশে পরিচালক নির্বাচনের এ বিধিমালা পরিবর্তন করা হয়।
নতুন বিধিমালা সম্পর্কে গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য তাহসিনা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, নতুন বিধিতে রাজনৈতিক প্রভাবে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালক হতে রাজনৈতিক পরিচয়ে বা প্রভাবে এর সদস্য হবেন। আর আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন তাঁদের পাস করিয়ে দেবে।
রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের নমুনা: গ্রামীণ ব্যাংকের মাঠপর্যায়ে ইতিমধ্যেই রাজনীতি ঢুকে পড়েছে। কর্মচারী সমিতির নির্বাচন, বদলিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে প্রভাব খাটানোর অভিযোগ উঠেছে।
গত বছরের ৩০ এপ্রিল গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মচারী সমিতির নির্বাচনে রংপুর অঞ্চলে ছয়টি এলাকায় তৎকালীন একজন উপজেলা চেয়ারম্যানের পছন্দের প্রার্থী ছাড়া আর কাউকে মনোনয়নপত্র তুলতে ও জমা দিতে দেওয়া হয়নি। এ নিয়ে রংপুর, মিঠাপুকুর এরিয়া বা এলাকা কার্যালয়ে মারধরের ঘটনাও ঘটেছে। হুমকির মুখে ওই ছয় এলাকায় একক প্রার্থীদের একতরফাভাবে নির্বাচিত ঘোষণা দেওয়া হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেলে ওই সব এলাকায় পরে ভোট বাতিল করে সেপ্টেম্বর মাসে নেওয়া হয়েছে।
একই নির্বাচনে ভোটের দিন ব্যাংকের ময়মনসিংহ গফরগাঁও এলাকা কার্যালয়ে (এরিয়া অফিস) ভোটকেন্দ্র থেকে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর লোকজন চারজন ভোটারকে অপহরণ করেন। এক দিন পরে ছেড়ে দেওয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, বর্তমান সরকারের একজন প্রতিমন্ত্রীর মদদে তাঁর ক্যাডার বাহিনী চারজন ভোটারকে অপহরণ করে। পরে সেই কেন্দ্রের ভোটও বাতিল করা হয়।
এ ছাড়া গ্রামীণ ব্যাংকের মাঠপর্যায়ে বদলি-তদবির নিয়ে স্থানীয় প্রভাবশালী ছাত্রসংগঠনের নেতারাও এখন কর্মকর্তাদের হুমকি বা চাপ দেন বলে অভিযোগ রয়েছে।