Thank you for trying Sticky AMP!!

নূর হোসেনের গায়ে কে লিখেছিল ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’

রাজধানীর আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দো ঢাকায় ১৪ জুন শুরু হয় সব্যসাচী হাজরার প্রদর্শনী ‘ব্রাহ্মী থেকে বাংলা’। একই সময়ে প্রকাশিত হয়েছে হরফ নিয়ে তাঁর গবেষণাধর্মী বই ‘অ: ইন দ্য কোয়েস্ট অব বাংলা টাইপোগ্রাফি’। বই ও হরফ নিয়ে গবেষণা এবং নিজের ভ্রমণ নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন এই শিল্পী। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাসেল মাহ্‌মুদ।

সব্যসাচী হাজরা
প্রশ্ন

প্রদর্শনী থেকে কেমন সাড়া পেলেন?

সব্যসাচী হাজরা: অভূতপূর্ব। যদিও আমাদের চেষ্টা ছিল, প্রদর্শনী যেন বইকে ছাপিয়ে না যায়। যে ভয়টা পেয়েছিলাম, সেটাই হয়েছে। অবশ্য বইও শেষ হয়ে গেছে এক দফা।

প্রশ্ন

হরফ নিয়ে প্রদর্শনী। লোকে সেটা দেখতে আসছে, এটা কেন আপনার ভালো লাগবে না?

সব্যসাচী হাজরা: ভালো লেগেছে। সরাসরি সংযোগের একটা আলাদা আবেদন তো আছেই। বিশেষ করে যখন তরুণেরা নিজের আগ্রহে এসেছেন, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছেন, প্রশ্ন করেছেন। অনেকেই এসেছেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে, আমার সরাসরি শিক্ষকসহ। তাঁদের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া অনুপ্রাণিত করেছে। আমি আসলে বইটাতেই ফোকাসের চেষ্টা করেছিলাম। প্রদর্শনী নিয়ে দর্শকদের উচ্ছ্বাসটা বাড়তি পাওনা।

শিশুদের হরফের প্রতি মায়া শুধু শুধু জন্মাবে না। আমি যদি এক শ বার বলি যে এই হরফের জন্য আমরা জীবন দিয়েছিলাম, এই হরফের কারণে আমাদের স্বাধিকার আন্দোলনের সূচনা ও পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল—শুধু সেখান থেকেই হরফের প্রতি মায়া জন্মাবে না। শিশুকে যখন স্বাধীনভাবে লিখতে দেওয়া হবে, সে যখন দেখবে রেখার পুরুত্বের মধ্যে আছে সম্ভাবনা, হরফের বাঁকে বাঁকে আছে এক অদ্ভুত আনন্দ, তার আগ্রহ তৈরি হবে।
প্রশ্ন

হরফ নিয়ে এই আয়োজন দেখে তরুণেরা কী উপলব্ধি করবে বা সেটা কোথায় প্রয়োগ করবে?

সব্যসাচী হাজরা: তরুণেরা বাংলা টাইপোগ্রাফি নিয়ে প্রযুক্তিনির্ভর অনেক কাজ করছেন। তাঁদের উৎসাহ আছে, এটা আনন্দের। তাঁদের কাজও সম্ভাবনাময়। এই আয়োজনে একটা বার্তা আছে যে প্রমিত বাংলা হরফ হাতে লেখার চর্চাও জরুরি। হাতে লিখলে প্রমিত মুদ্রিত হরফের ইতিবৃত্ত উপলব্ধ হয়, অজস্র সম্ভাবনার দরজা খুলে যায়। যে হস্তাক্ষরের অনুকরণে প্রমিত হরফের মুদ্রিত রূপ, সেগুলোকে আত্মস্থ ও আয়ত্ত করার মধ্য দিয়ে আমাদের প্রস্তুতি ও চিন্তার জায়গাগুলো শাণিত হয়। একটা উদাহরণ দিই, সাম্প্রতিককালে মুদ্রিত হরফে প্রায়ই যে ‘অ’ দেখা যায়, সেটা ভার্টিক্যাল লাইন দিয়ে যুক্ত করা হয়। ‘অ’ আসলে মাত্রার সঙ্গে যুক্ত হবে ‘শুট’ অংশটির মাধ্যমে। এখন মূল প্রমিত রূপের ধারণা না থাকলে এটা নজর এড়িয়ে যাবে। একজন টাইপোগ্রাফারের এই জায়গাটিকে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।

‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ সিনেমার নামলিপি কার করা? নূর হোসেনের গায়ে কে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ লিখে দিয়েছিল? এই যে ছোট্ট একটা লেখার মধ্য দিয়ে বড় একটা আন্দোলন হয়ে গেল, কে এর লিপিকার? ব্যানার লিখতেন, সে রকম একজন ব্যক্তি লিখেছিলেন।
প্রশ্ন

প্রদর্শনীতে কিছু কলমের নমুনা দেখানো হয়। আমাদের হরফের সঙ্গে এগুলোর সম্পর্ক রয়েছে নিশ্চয়ই?

সব্যসাচী হাজরা: আমরা এখন আর বাংলা লেখাঙ্কনে অভ্যস্ত নই। যে কারণে হাতে লেখার চর্চা প্রায় উঠেই গেছে। অথচ বিদেশে এখনো স্কুলগুলোতে ক্যালিগ্রাফি চর্চা হয়। আমি তিনটি স্কুলে একটা পরীক্ষা চালিয়েছিলাম। সুবিধাবঞ্চিত বাচ্চাদের স্কুলে ও শহরের সচ্ছল বাচ্চাদের স্কুলে, দেখার জন্য, তারা ক্যালিগ্রাফি করতে পারে কি না। বাংলা হরফ লেখার জন্য কখনোই নির্দিষ্ট কাগজ, কালি, কলম ও করণকৌশল সাজেস্ট করা হয় না। আমি দেড় শ কলম বানিয়েছিলাম। সেগুলো থেকে ২১টি রাখা হয়েছে, যেগুলো বাংলা লেখাঙ্কন বা ক্যালিগ্রাফির জন্য যথাযথ। অদ্ভুত ব্যাপার হলো বাচ্চাগুলো সেগুলো দিয়ে অনেক আনন্দ নিয়ে পারফেক্ট হরফটাই লিখতে পেরেছিল। কিছু কলম আইসক্রিমের কাঠি কেটে বানানো হয়েছিল।

শিশুদের হরফের প্রতি মায়া শুধু শুধু জন্মাবে না। আমি যদি এক শ বার বলি যে এই হরফের জন্য আমরা জীবন দিয়েছিলাম, এই হরফের কারণে আমাদের স্বাধিকার আন্দোলনের সূচনা ও পরবর্তী সমেয় মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল—শুধু সেখান থেকেই হরফের প্রতি মায়া জন্মাবে না। শিশুকে যখন স্বাধীনভাবে লিখতে দেওয়া হবে, সে যখন দেখবে রেখার পুরুত্বের মধ্যে আছে সম্ভাবনা, হরফের বাঁকে বাঁকে আছে এক অদ্ভুত আনন্দ, তার আগ্রহ তৈরি হবে। যে নদীর গতি আর বাঁকবদল আমাদের চিরচেনা, যে মন্দির-মসজিদের স্থাপত্যরীতি দেখে আমাদের বেড়ে ওঠা, বাংলার গৃহনির্মাণশৈলী, লোকশিল্পের বৈচিত্র্য, মানুষের সহজিয়া ভাবধারা, হরফের মধ্যেই সেটা রয়ে গেছে। শিশু অবস্থায় তাকে এসব বুঝতে দিতে হবে। মুখস্থ করে নয়; নিজের মতো করে, খেলার ছলে, আঁকার নেশায়, পরীক্ষা-নিরীক্ষায় গড়ে-পিটে নেওয়ার চর্চায়। আমরা বাচ্চাকে একটা শার্প পেনসিল আর কাগজ ধরিয়ে দিই লেখার জন্য, তাহলে কীভাবে অক্ষরের প্রতি ভালোবাসা জন্মাবে?

প্রশ্ন

আমাদের দেশে হরফ নিয়ে অনেকেই কাজ করেছেন। সেসব লিপি আপনি প্রদর্শনীতে জড়ো করেছেন। কেন?

সব্যসাচী হাজরা: শুধু বাংলাদেশে নয়, দুই বাংলায় বাংলা হরফ নিয়ে অনেক কাজ হয়েছে। কিন্তু আমরা কাজগুলো সংগ্রহে রাখতে পারিনি। সত্যজিৎ রায়, পূর্ণেন্দু পত্রী, খালেদ চৌধুরী, সোমনাথ ঘোষ, প্রাণেশ মণ্ডল, দেবদাস চক্রবর্তী, কাজী হাসান হাবীব, কামরুল হাসান, জয়নুল আবেদিন, আফজাল হোসেন, ধ্রুব এষ—কে টাইপোগ্রাফি নিয়ে কাজ করেননি। কাইয়ুম চৌধুরী যখন ‘নুরুলদিনের সারাজীবন’-এর নামলিপি এঁকেছেন, সেখানেও একটা বৈপ্লবিক অভিব্যক্তি ছিল। আমাদের এখানে কালোত্তীর্ণ কাজ হয়ে গেছে। আমরা সংগ্রহে রাখতে পারিনি, তরুণদের সামনে সেগুলো এগিয়ে দিতে পারিনি। এগুলো দেখার চোখ তৈরি হলে, কাজে একটা প্রচ্ছন্ন প্রভাব থাকবে ইতিবাচক অর্থে।

শুরুর দিকে আমি যখন কাজ করেছি, একসঙ্গে গোছানো কিছু পাইনি। অনেক কষ্ট করে অনেক কিছু সংগ্রহ করেছি নিজের প্রয়োজনে। কাজী হাসান হাবীবের ‘জীবন আমার বোন’, ‘কোথাও কেউ নেই’ উপন্যাসের নামলিপিগুলো আমাকে এখনো ভাবায়। আবার হাশেম খানের করা প্রতিটা বইয়ের নামলিপি একই প্যাটার্নের হলেও বই অনুযায়ী ক্যারেক্টার চেঞ্জ হয়ে যেত। পত্রিকার নামলিপিতে কাইয়ুম চৌধুরী অদ্বিতীয়। বইয়ের প্রচ্ছদ, সিনেমার পোস্টার, বিজ্ঞাপনের নামাঙ্কন, বাহনলিপি—সব যদি আজকের ছেলেমেয়েদের সামনে জড়ো করে দেওয়া যায়, তাহলে সে উপলব্ধি করতে পারবে যে আমাদের এখানে এই মানের কাজ হয়েছে এবং তা তাদের জন্য অনেক চিন্তা ও কাজের রসদ জোগাবে।

প্রশ্ন

আপনি সংগ্রহ শুরু করলেন কবে থেকে? এই কাজ করতে গিয়েই কি বুঝতে পারলেন যে পূর্বসূরিদের কাজ সংগ্রহ করা হয়নি?

সব্যসাচী হাজরা: আমি আসলে বহু আগে থেকেই অবচেতনে সংগ্রহ করছি। কোভিডের সময় হঠাৎ শূন্যতা, ঘরে আটকে থাকা একটা নিরবচ্ছিন্ন সুযোগ করে দিয়েছে ভাবনা, চর্চা ও লেখার। বইয়ের ধারণাটা অনেক দিন থেকেই ভাসা ভাসা ভাবছিলাম। গত দুই বছরেই মূল কাঠামোটা দাঁড় করাই। কিন্তু অনেক তথ্য জানা নেই, খোঁজ নিলে বলার খুব বেশি কেউ নেই, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন উত্তর আসছে। যাঁরা বলেছেন কেউবা পুরোটাই স্মৃতির ওপর ভরসা করে, আবার বলার মতো অনেকেই বেঁচে নেই। প্রতিষ্ঠানগুলো থেকেও সংগ্রহের তেমন সুযোগ নেই। যেমন ধরা যাক, বাংলা একাডেমির সব প্রকাশনার প্রচ্ছদ একসঙ্গে করা নেই। আমরা হয়তো বিস্মৃতিপরায়ণ, বা জানার ইচ্ছেটাই কম।

ছায়ানটের লোগো, বাংলাদেশ ব্যাংকের লোগো বা বিমানের লোগো কে করেছেন, কজন তরুণ বলতে পারবেন? বিমান মল্লিক যে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের প্রথম ডাকটিকিটের ডিজাইন করলেন, কোথায় তাঁর নাম আছে, কে চেনে তাঁকে? আমি যখন বইয়ের কাজে হাত দিই, হাতড়াতে শুরু করি, ‘এটা কার’, ‘ওটা কার’। ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ সিনেমার নামলিপি কার করা? নূর হোসেনের গায়ে কে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ লিখে দিয়েছিল? এই যে ছোট্ট একটা লেখার মধ্য দিয়ে বড় একটা আন্দোলন হয়ে গেল, কে এর লিপিকার? ব্যানার লিখতেন, সে রকম একজন ব্যক্তি লিখেছিলেন।

সারা শহর ঘুরে ঘুরে আমি ছবি তুলেছি অক্ষরবিন্যাসের নমুনা পেতে। অনেকবার পুরান ঢাকায় গিয়েছি। কল-রেডি, আলাউদ্দিন সুইটমিট, শক্তি ঔষধালয়, বলাকা বা লায়ন সিনেমা হলের দেয়ালে লেখা ‘চলিতেছে’, এসব সংগ্রহ করেছি। আধুনিক অনুষঙ্গ, প্যানাফ্লেক্স, প্রিন্টেড হরফে দেশ ভরে গেছে; বৈচিত্র্যহীন, যান্ত্রিক। হাতের লেখার কদর কমে গেছে। হাতে লেখা সেই লোকগুলোও হারিয়ে গেছেন। অনেক কিছু আমরা হারিয়ে ফেলেছি। আরও দেরি করলে আর কিছুই থাকবে না।

সারা শহর ঘুরে ঘুরে আমি ছবি তুলেছি অক্ষরবিন্যাসের নমুনা পেতে। অনেকবার পুরান ঢাকায় গিয়েছি। কল-রেডি, আলাউদ্দিন সুইটমিট, শক্তি ঔষধালয়, বলাকা বা লায়ন সিনেমা হলের দেয়ালে লেখা ‘চলিতেছে’, এসব সংগ্রহ করেছি। আধুনিক অনুষঙ্গ, প্যানাফ্লেক্স, প্রিন্টেড হরফে দেশ ভরে গেছে; বৈচিত্র্যহীন, যান্ত্রিক। হাতের লেখার কদর কমে গেছে। হাতে লেখা সেই লোকগুলোও হারিয়ে গেছেন। অনেক কিছু আমরা হারিয়ে ফেলেছি।
প্রশ্ন

আপনি এখনকার তরুণ শিল্পীদের কাছে কী প্রত্যাশা করেন?

সব্যসাচী হাজরা: তরুণেরা ভাবলে, মতামত জানালে বা দ্বিমত করলে সেটাই আমার কাজের সার্থকতা। তাঁরা আমাদের থেকে এগিয়ে আছেন প্রযুক্তিতে। তাঁদের দেখার চোখ আলাদা, তাঁদের প্রতিযোগিতা আরও বড় পরিসরে। তাঁদের আমি একটা খেই ধরিয়ে দিতে চেয়েছি, সেটা বাংলা প্রমিত হরফের আকৃতির ব্যাখ্যা। তাঁরা এই সূত্রটুকু ধরে তাঁদের মতো করে অনুসন্ধান করবেন। নন্দনতাত্ত্বিক নিরীক্ষার তো কোনো শেষ নেই। মাঝে মাঝে আপনাকে ফিরে তাকাতে হয়, ইতিহাস বা ভাবনাটা খুঁজতে হয়, সেই আঙ্গিকে নিজের কাজকে ঝালাই করে নিতে হয়।

আমি শুধু আমার অনেক দিনের একটা অনুসন্ধান মলাটবন্দী করলাম। তাঁরা এর প্রয়োজনীয়তা, উপযোগিতা নির্ধারণ করবেন। যদি আরও অনেকের মধ্যে এই আগ্রহটুকু ছড়িয়ে যায় বা অনেকেই তাঁদের আগ্রহের সঙ্গে আমার আগ্রহের সাদৃশ্য পান, তাহলেই বাংলা টাইপোগ্রাফি নিয়ে বারবার আলাপের সুযোগ হবে, বিনিময় হবে, প্রস্তুতি ও সংরক্ষণের তাগিদ থাকবে।

প্রশ্ন

আপনি দীর্ঘদিন ধরে হরফ নিয়ে কাজ করছেন। হরফের প্রতি আপনার ভালোবাসা তৈরি হওয়ার গল্পটা বলবেন?

সব্যসাচী হাজরা: আমার এক একটা সকালের কথা মনে পড়ে। দাদু রেডিওর নব ঘোরাচ্ছেন। বিভিন্ন চ্যানেল আসছে, কখনো ‘খবর পড়ছি দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, আকাশবাণী’, কখনো শোনা যাচ্ছে অনুরোধের আসর... আর আমি কতগুলো তালপাতার মধ্যে কয়লা গুলিয়ে খাগড়ার কলম দিয়ে লিখছি ‘অ’। তালপাতাগুলো নিমপাতার জলে ১০ দিন ধরে ভিজিয়ে রাখতে হতো যাতে ঘুণে না ধরে। হয়তো আমার চর্চা শুরু হয় তখন থেকেই। রাতভোর দেয়াললিখনের কথা মনে পড়ে। রাজনীতিতে জড়িয়ে যাওয়া, সংগঠনের ব্যানার ফেস্টুন এঁকে বা লিখে দেওয়া, দেয়াললিখন...তখন হরফ-বিষয়ক সচেতনতা হয়তো অতটা ছিল না, কিন্তু চর্চা ছিল। কিন্তু ভালোবাসা তো এভাবেই জন্মায়। আমি হয়তো কিছু হরফই লিখেছিলাম, কিন্তু অনেক আবেগ নিয়েই তো জানাতে চেয়েছি ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’। আমার মনে হয় হরফের প্রতি ভালোবাসা ওই সময়ের রাজনৈতিক চর্চার সঙ্গে অনেকটাই জড়িত।

প্রশ্ন

আপনি সব্যসাচী নামে একটি টাইপফেস তৈরি করেছেন। এটা কেন করলেন?

সব্যসাচী হাজরা: প্রমিত বাংলা হরফের নন্দনতাত্ত্বিক নিরীক্ষার একটা ফলাফল ছিল টাইপফেস তৈরি। টাইপফেসগুলোকে আপাতদৃষ্টে কাছাকাছি মনে হয়। বড় করলে এর পার্থক্যটা বোঝা যায়। যাঁরা এটা ব্যবহার করতে চান তাঁদের জন্য সব্যসাচী টাইপফেস উন্মুক্ত। আর যাঁরা টাইপফেস তৈরির প্রতি আগ্রহী তাঁদের জন্য একটা নমুনা থাকল।

প্রশ্ন

আপনি বারবার ঘাটতি ধরিয়ে দেওয়ার কথা বলছেন। আপনি কি পূর্ববর্তীদের কোনো ঘাটতি ধরতে পেরেছেন?

সব্যসাচী হাজরা: কিছু ক্ষেত্রে চোখে হয়তো পড়েছে। কিন্তু এই কাজগুলোর ক্ষেত্রে তাঁরা এত আন্তরিক ছিলেন, যে বৈরী সময়ের মধ্যে তাঁরা কাজগুলো করেছেন, সেটাও তো বিবেচনার...নয়তো একজন স্বর্ণকারকে দিয়ে হরফ কাটানোর দরকার ছিল না। আমার তো পঞ্চানন কর্মকার বা ন্যাথানিয়েল ব্র্যাসি হালেদের ভুলটাও রেখে দিতে ইচ্ছে করে। আগের কাজগুলো প্রদর্শনের সময় আমি কোনো কারেকশন করিনি, যাতে আদি রূপটার কোনো ভুল রেফারেন্স থেকে না যায়।

প্রশ্ন

সংরক্ষণে আর হাতের লেখা চর্চায় আমাদের আগ্রহ কম কেন?

সব্যসাচী হাজরা: আমাদের আগ্রহ কমে গেছে। কারণ, আগ্রহ থাকার জন্য যে উপাদানগুলো থাকা দরকার ছিল, সেগুলো নেই। নীতিনির্ধারকদের বুঝতে হবে, সংগ্রহ না থাকলে, জাদুঘর না থাকলে পরের প্রজন্ম কিছু শেখে না। আপনি-আমি কী জানি, সেটা কোনো ব্যাপার না। তরুণ প্রজন্ম কী জানে, সেটাই বড় কথা। ২০ বছর পরের বাচ্চাটা আজকের চর্চা সম্পর্কে জানতে পারবে কি না—এটাই ব্যাপার। মানুষ তার ইতিহাস, শিল্প, সাহিত্য, হরফ সম্পর্কে জানতে চাইত আগে। এখন সেটা কমে গেছে। এত প্রযুক্তি থাকলেও আমাদের সংগ্রহের প্রবণতা অনেকাংশে কমে আসছে।

প্রশ্ন

আমাদের তো জাদুঘর আছে। সেখানে সংরক্ষণ করা বস্তুগুলো কি যথেষ্ট নয়?

সব্যসাচী হাজরা: জাতীয় জাদুঘরে মুদ্রণের একটা জায়গা আছে, উপস্থাপনা দুর্বল। বাংলা একাডেমির একটা বিবর্তনের ঘর আছে, খুবই দায়সারাগোছের। আমাদের উপস্থাপনা এমন হতে হবে, সেটা কিউরেশনের মাধ্যমে হোক বা ডকুমেন্টারি দিয়ে হোক যাতে তরুণেরা আকৃষ্ট হয়। জাদুঘর বা সংগ্রহশালাগুলো খুব কি আন্তরিক, দেখানোর ক্ষেত্রে অথবা দর্শক টানার উদ্দেশ্যে? সেখানে কি যথেষ্ট লোকবল বা সুযোগ আছে? বিষয়টা তো এককথায় উপসংহার টানার মতো না। কিন্তু আপাতদৃষ্টে আমাদের সংগ্রহশালাগুলো রিজিড, দর্শকবান্ধব নয়। এ বিষয়ে তাদের জবাবদিহি নেই অথবা তাদের দর্শকবান্ধব বা প্রচারমুখী করতে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে ঘাটতি আছে।

প্রশ্ন

আপনি এই বইয়ের জন্য এত সময় নিলেন কেন?

সব্যসাচী হাজরা: আমার অপারগতা কিংবা খুঁতখুঁতে স্বভাব দায়ী। এ ধরনের কাজের তেমন কোনো রেফারেন্স নেই। সময় লেগেছে, খুব সহজ ছিল না। চিন্তাগুলো গুছিয়েছি, ফেলেছি আবার কাটাছেঁড়া করেছি, বইয়ের কাজে যাঁরা সাহায্য করেছেন, আমার কাছের মানুষদের সঙ্গে বারবার আলোচনা করেছি। এর থেকে দ্রুত করার ম্যাজিকটা আমার জানা ছিল না। তবে আরও দেরি যে হলো না, সেটা বরং আনন্দের। কারণ, এই বছরটা তো ঐতিহাসিক উদ্‌যাপনের। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্মের দ্বিশতবার্ষিকী, ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর আবার রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালিত হচ্ছে।