Thank you for trying Sticky AMP!!

নেতার ভাষণ

রেসকোর্স ময়দানে সেই অবিস্মরণীয় ভাষণ। ছবি: সংগৃহীত

এ বছর ৭ মার্চ এসেছে ভিন্ন এক আবেগপূর্ণ সময়ে এবং অন্য এক তাৎপর্য নিয়ে। আবেগ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ঘিরে। ২০২০ সালের ১৭ মার্চ তাঁর শততম জন্মদিন থেকে আগামী বছরের ওই দিন পর্যন্ত জাতি ‘মুজিববর্ষ’ উদ্যাপন করছে। আর এই ২০২১ মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি বা সুবর্ণজয়ন্তী। এই দুই উদ্যাপনের পবিত্র আবেগকে উপেক্ষা করা কারও পক্ষে সম্ভব নয়।

আর তাৎপর্য এটাই যে স্বাধীনতার জন্য জীবন বাজি রেখে লড়ার পেছনে জনগণের স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা ও নেতার আদর্শ ৫০ বছরে কতটুকু বাস্তবায়িত হলো, আমরা ঠিক পথে চলছি কি না, তার একটি বোঝাপড়া এবং নতুন সংকল্প গ্রহণের যথার্থ উপলক্ষ এই দুই জয়ন্তী।

আমাদের ইতিহাসে ৭ মার্চ এক অবিস্মরণীয় দিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি অনন্যসাধারণ ভাষণের জন্য। ১৯৭১ সালের এই দিনে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (্এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) সুবিশাল উত্তাল জনসমুদ্রের সামনে ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি কার্যত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং তা অর্জনের রণকৌশলও জনগণের সামনে তুলে ধরেন। স্বাধীনতাসংগ্রামের ইতিহাসে তাই এটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় ঘোরানোর দিন।

এই ভাষণের অব্যবহিত পটভূমির দিকে তাকালে আমরা দেখি, সাত দিন আগে তথা পয়লা মার্চ থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশের সর্বত্র পাকিস্তানি কেন্দ্রীয় সরকারের প্রশাসন সম্পূর্ণ অচল হয়ে পড়েছিল। লাখো সংগ্রামী মানুষের দৃপ্ত পদভারে রাজপথে প্রতিদিন যেন ইতিহাস রচিত হচ্ছিল। জনতার সংগ্রামকে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বও তখন প্রতিদিনই শাণিত হয়ে উঠছিল। নেতা ও জনতার পারস্পরিক সম্পর্ক ও বিকাশের দ্বান্দ্বিকতার (ডায়ালেকটিকস) তাত্ত্বিক বিবরণের বাস্তব রূপটি যেন দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল।
পূর্ব বাংলার মানুষ ভাষা আন্দোলনে সূচনা করে পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রসহ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক স্বাধিকারের লড়াই চালিয়ে আসছিল। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ১৯৬৬ সালে পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসনের ছয় দফা দাবি দিয়ে শেখ মুজিব বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে এই আন্দোলনের অবিসংবাদী নেতা হয়ে ওঠেন। জাতীয়তাবাদীদের পাশে বাম ও কমিউনিস্ট প্রভাবিত ছাত্র আন্দোলনের ধারাটির জন্য মেহনতি শ্রেণিগুলোর স্বার্থে ১১ দফা দাবি যুক্ত হওয়ায় এই আন্দোলন আরও ব্যাপ্তি পায়। আইয়ুব খানের আধা সামরিক স্বৈরশাসন উৎখাতকারী ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের জোয়ারে ছাত্রদের সংগ্রাম পরিষদ শেখ মুজিবের মাথায় ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধির মুকুট পরিয়ে দেয়।

ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসনের মধ্যেই ১৯৭০-এর ডিসেম্বরে পাকিস্তানের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদগুলোর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ গোটা পাকিস্তানে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও পূর্ব পাকিস্তানে একচ্ছত্র বিজয় অর্জন করে। বঙ্গবন্ধু নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর ও সে জন্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বানের জন্য চাপ দিচ্ছিলেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ৩ মার্চ ঢাকায় অধিবেশন ডাকেন। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে বসে পিপলস পার্টির নেতা ভুট্টোর টালবাহানা ও সেনা শাসকদের নেপথ্যের চক্রান্তে প্রেসিডেন্ট পয়লা মার্চ সম্প্রচারিত ভাষণে পার্লামেন্ট অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন।

সেই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকাসহ শহরগুলোতে মানুষ স্রোতের মতো রাস্তায় নেমে আসে। কিছু ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ হলেও মূলত জনতা ছিল দৃঢ় ও শান্তিপূর্ণ। দেশ প্রকম্পিত হয় ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ স্লোগানে। জনতা পথে পথে পাকিস্তানি পতাকা জ্বালিয়ে দেয়। সেই সত্য ফুটে ওঠে যে জনতাই ইতিহাসের স্রষ্টা। কারও আহ্বানের অপেক্ষা না করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাজপথে নেমে এসে জনতা নিজ হাতে ইতিহাস লিখে দিল। সবাই বুঝে গেল পাকিস্তানের একত্রে থাকার সম্ভাবনা শেষ।

নেতা হয়তো আগেই চেয়েছিলেন ও পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু জনতাকে চাইতে হবে ও তৈয়ার হতে হবে। সংগঠিত প্রস্ত্ততি ছাড়া বিক্ষুব্ধ স্বতঃস্ফূর্ত জনতা কোনো লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে না। নেতাও কালবিলম্ব না করে দাঁড়ালেন জনতার সামনে এসে। বিকেলে তিনি সাংবাদিকদের কাছে কর্মসূচি দিলেন পরের দিন ঢাকায় ও ৩ মার্চ সারা প্রদেশে হরতাল। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবনে ছাত্র সমাবেশে ছাত্রনেতারা ওড়ালেন সবুজ জমিনে লাল সূর্যের মাঝে মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলার প্রতীকী পতাকা। হরতালের মধ্যে ৩ মার্চ বিকেলে পল্টন ময়দানে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ডাকা জনসভায় হঠাৎ উপস্থিত হয়ে বঙ্গবন্ধু বললেন, লাগাতার হরতাল ও অসহযোগ আন্দোলন চলবে এবং তিনি পরবর্তী ঘোষণা দেবেন ৭ মার্চ রেসকোর্সে জনসভায়। এরূপ ধাপে ধাপে ও ত্বরিত সুচারু নেতৃত্ব দেওয়ার ঘটনা ইতিহাসে বিরল।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শুধু আমাদের নয়, বিশ্বের ইতিহাসে এক অসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ভাষণ। জনগণের বোধগম্য সরল ভাষায়, তেজস্বী ভঙ্গিতে, ওজস্বী কণ্ঠে অনধিক ২৩ মিনিটের অলিখিত মৌখিক ভাষণটি অনেক ভাষায় অনূদিত হয়েছে। গ্রন্থবদ্ধ হয়েছে। ভাষণটি নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ও গবেষণা হয়েছে। ২০১১ সালে ভাষণটি বাংলাদেশ সংবিধানের পঞ্চম তফসিলে অন্তভু‌র্ক্ত হয়েছে। সব জাতির অধিকারের লড়াইয়ে প্রেরণাদায়ক বলে ২০১৭ সালে ইউনেসকো ভাষণটি বিশ্বের প্রামাণ্য দলিলসমূহের তালিকাভুক্ত করেছে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে বাহুল্য আলোচনা এড়িয়ে উল্লেখ করা যায যে ভাষণটির নিবিড় পাঠ বলে দেয়, এতে অতি সংক্ষেপে বিস্ময়করভাবে বাংলাদেশের মানুষের সংগ্রামের ইতিহাসের সারাৎসার আছে, জনগণের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে, দেশকে শত্রুমুক্ত করতে যুদ্ধের জন্য প্রস্ত্তত হতে বলা হয়েছে এবং স্বাধীন রাষ্ট্রের মৌল নীতিগুলোর ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে।

অতি বাম ও হঠকারী রাজনৈতিক অবস্থান থেকে অথবা উদ্দেশ্যমূলকভাবে প্রথমাবধি এই ভাষণের একটি সমালোচনা চালু আছে যে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি এবং পাকিস্তানি শাসকদের সঙ্গে আপস করে ক্ষমতায় যাওয়ার তাঁর অভিলাষ বোঝা গিয়েছিল। না, উচ্চ রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও প্রখর বাস্তব জ্ঞান থেকে বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত কৌশলে ঘোষণা দিয়েছিলেন যাতে জনগণের কাছে বার্তা পৌঁছে যায়, কিন্তু শত্রু আক্রমণ করার সুযোগ না পায়, তাঁকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ বলে পাকিস্তান ভাঙার দায় না দিতে পারে। সমকালীন ইতিহাসে কঙ্গোর বায়াফ্রার বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের পেছনে সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত ও বিয়োগান্ত ঘটনার নজির থাকায় এটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। অন্যথায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন অতি দুরূহ হতো।

‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ ছিল তাঁর ঘোষণা। স্বাধীনতার সঙ্গে ‘মুক্তি’ শব্দটির দ্যোতনা অনেক ব্যাপক, যাতে আমাদের সংগ্রামের দূর লক্ষ্য নির্ধারিত করেছেন। ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে’ এবং পরবর্তী কথাগুচ্ছ প্রতিরোধ ও গেরিলাযুদ্ধের প্রস্ত্ততির আহ্বান। তিনি শত্রুর কোর্টে বল ঠেলে দিয়ে সামরিক আইন প্রত্যাহার, সেনাদের ব্যারাকে ফেরানো, গুলি করে মানুষ হত্যার বিচার ও জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের চার দফা দাবি দিয়ে শান্তিপূর্ণ সমাধানের প্রস্তাব দেন।

এক দিকে ফুটন্ত জনতা, অনেক ছাত্রতরুণ সহকর্মীর অধৈর্য তাগিদ, অন্য দিকে পাকিস্তানি হিংস্র সেনাবাহিনীর উদ্যত কামানের সামনে দাঁড়িয়ে ঠান্ডা মাথায় এমন রাজনৈতিক প্রজ্ঞাপূর্ণ ভাষণের নজির ইতিহাসে দুর্লভ।