Thank you for trying Sticky AMP!!

পরোপকারী এক পরম বন্ধু

চোখের ছানি অস্ত্রোপচারের পর রোগীদের তদারক করছেন আমিনুল ইসলাম (মাঝে)। সম্প্রতি চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের কৃষ্ণগোবিন্দপুর ডিগ্রি কলেজ প্রাঙ্গণে। ছবি: প্রথম আলো

সেদিনের সে তরুণ এখন বয়ঃপ্রাপ্ত। বয়সের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তাঁর কাজের পরিধিও বেড়েছে। শত শত মানুষকে এখন সেবা দিয়ে বেড়ান তিনি। বয়স্কদের চোখের অস্ত্রোপচারে সাহায্য করেন। প্রতিবন্ধী শিশু–কিশোরদের সহায়তা দেন। এই সবই তিনি করেন নিঃস্বার্থভাবে। অথচ তিনি যে এলাকার মানুষ, সেটি সন্ত্রাসের এক জনপদ হিসেবে পরিচিত। মাদক সেখানে মহামারি। খুনোখুনি, বোমাবাজি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এহেন আঁধারে আলো ছড়ানো পরোপকারী মানুষটি পেশায় একজন গ্রন্থাগারিক। নাম তাঁর আমিনুল ইসলাম, বয়স ৫২। বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার চুনাখালি বগিপাড়ায়। নিজ গ্রামসহ আশপাশের এলাকায় তিনি প্রতিবন্ধী ও চোখের রোগীদের পরম বন্ধু বলে পরিচিত।

তিন দশক আগে বৃদ্ধাকে সাহায্য করতে গিয়ে সেই যে মানবসেবায় ডুব দিয়েছিলেন, আজও তিনি তাঁদের নিয়েই আছেন। নিজের পরিবার–পরিজন ফেলে ছোটেন অসহায় মানুষের পেছনে। নিজের সামর্থ্যে না কুলালে ধনাঢ্য ও দানশীল ব্যক্তিদের কাছে হাত পাতেন।

চক্ষুরোগীদের সেবা

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের কৃষ্ণগোবিন্দপুর ডিগ্রি কলেজের গ্রন্থাগারিক আমিনুল। একসময় তাঁর কলেজেই চক্ষুশিবিরের আয়োজন হতো। এখন হাসপাতাল ছাড়া চোখের ছানির অস্ত্রোপচার নিষিদ্ধ। তাই মাইকিং করে এলাকার লোকজনকে জড়ো করেন আমিনুল। দিনাজপুর থেকে চিকিৎসক এসে পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে চোখের ছানির অস্ত্রোপচার করতে হবে, এমন মানুষগুলোকে বাছাই করে যান। দিনক্ষণ ঠিক হলে আমিনুল গাড়িভাড়া করে লোকজনকে নিয়ে দিনাজপুরে হাসপাতালে যান অস্ত্রোপচার করাতে। গেল ৭ বছরের হিসাব আছে আমিনুলের কাছে। ১ হাজার ৬৭৫ জনের চোখের ছানি অস্ত্রোপচার করাতে পেরেছেন। এ কাজে নিজে টাকা দেন। কখনো বন্ধুবান্ধব ও দানশীলদের কাছেও হাত পাততে হয়। এখানেই শেষ নয়। দিনাজপুরে রোগীদের সেবা–শুশ্রূষার জন্য স্ত্রী, ছেলে ও এক বন্ধুকেও সঙ্গে নিয়ে যান। ‘আনন্দের সঙ্গেই তারা এ কাজ করে,’ গর্ব করে বললেন আমিনুল। এতে তিনি মনে জোর পান। তাঁদের সমর্থন ছাড়া এত নিবিড়ভাবে মানুষের সেবা করা যেত না বলে মনে করেন আমিনুল।

প্রতিবন্ধীদের জন্য দরদ

বছর দুয়েক আগের কথা। একদিন ট্রেনে করে রাজশাহী থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ আসছিলেন আমিনুল। এক বগিতে কিশোরী এক প্রতিবন্ধীকে কাঁদতে দেখেন। তখনই নিজের ছেলের মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। তাঁর ২২ বছর বয়সী ছেলেটাও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। মেয়েটির কাছে গিয়ে কান্নার কারণ জানতে চাইলেন। কিশোরী বলল, মা তাকে ট্রেনে রেখে পালিয়ে গেছে। তার মা-বাবার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে অনেক আগে। বাবা বিয়ে করেছেন। মা–ও সম্প্রতি বিয়ে করেছেন। এরপর থেকেই তাকে তাড়ানোর চেষ্টা চলছে। কিশোরীকে সঙ্গে নিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সমাজসেবা অধিদপ্তরে যোগাযোগ করেন আমিনুল। স্থানীয় সমাজসেবা কর্মকর্তা আমিনুলকেই বললেন শিশুটির অভিভাবকদের খুঁজে বের করতে। পুলিশের সহায়তায় কিশোরীকে তার নানির কাছে পৌঁছে দিয়ে আসেন আমিনুল। কিন্তু নানি খুশিমনে তাকে গ্রহণ করেননি। ওই ঘটনার পর থেকেই তিনি মনস্থির করেন, প্রতিবন্ধীদের জন্য একটি আশ্রম গড়ে তুলবেন। এ জন্য জমি খোঁজা হচ্ছে। রানিহাটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মহসিন আলী আশ্রমের জন্য একটি খাসজমি দেবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন। তবে জমি পাওয়া না গেলে তাঁর নিজের বাড়িতেই তিনি এটি স্থাপন করবেন বলে জানিয়েছেন। ইতিমধ্যে তিনি বেশ কিছু প্রতিবন্ধীকে সহযোগিতা করেছেন। কয়েকজনকে ঢাকার সাভারে অবস্থিত সিআরপিতে প্রশিক্ষণ দিয়ে চাকরিরও ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।

রানিহাটি ইউপির চেয়ারম্যান মহসীন আলীর কথায়, সন্ত্রাসের এ জনপদে আমিনুল ইসলাম একজন ব্যতিক্রমী মানুষ। সমাজসেবী হিসেবে এলাকায় তাঁর সুনাম রয়েছে। তিনি প্রতিবন্ধীদের জন্য একটি আশ্রম স্থাপনের চেষ্টা চালাচ্ছেন। তাঁর এ উদ্যোগের পাশে থাকতে চান তিনি।

অন্যরা যা বলেন

আমিনুল ইসলামের স্ত্রী রোকেয়া বেগম একজন কলেজশিক্ষক। স্বামীকে নিয়ে তিনি কষ্টমিশ্রিত গর্বের কথা জানালেন। বললেন, ‘একবার তাঁকে অসুস্থ রেখে আমিনুল এক রোগীকে নিয়ে ভারতে এক মাস ছিলেন। তখন খুব কেঁদেছিলাম। পরে ভেবে দেখেছি, যখন তিনি অন্যকে সহযোগিতার কাজগুলো করেন, তখন খুব আনন্দে থাকেন, ভালো থাকেন। তাঁকে ভালো রাখার জন্যই আমি তাঁর কাজকে সমর্থন করি। আমার স্বামী এমন পরোপকারী মানুষ হওয়ায় আমি গর্বিত।’

কৃষ্ণগোবিন্দপুর ডিগ্রি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ জাকির হোসেনের ভাষ্য, ‘কলেজে আয়োজিত চক্ষুশিবিরগুলোতে শিক্ষকেরাও তাঁকে সহায়তা করেন। আর কলেজের অনেক শিক্ষার্থীই তাঁর ভক্ত ও অনুসারী। আমার খুব ভালো লাগে যে আমাদেরই এক সহকর্মী এমন কাজের সঙ্গে যুক্ত।’

কথা হয় দিনাজপুরের গাওসুল আজম বিএনএসবি চক্ষু হাসপাতালের প্রধান চক্ষু সার্জন আনসার আলীর সঙ্গে। তিনি জানান, সাত-আট বছর ধরে দেখে আসছেন, আমিনুল প্রতিবছর শতাধিক ছানিপড়া রোগীকে এ হাসপাতালে এনে অস্ত্রোপচার করে নিয়ে যান। রোগীদের কাছ থেকে জেনেছেন, তাঁদের কাছ থেকে কোনো খরচ নেওয়া হয় না। এ ছাড়া চাঁপাইনবাবগঞ্জের যে এলাকায় রোগী বাছাই করা হয়, সেখানে মাইকে প্রচার করে ৩০০-৪০০ রোগী জড়ো করা হয়। হাসপাতালের চিকিৎসকেরা গিয়ে তাঁদের মধ্যে ছানি অস্ত্রোপচার করার উপযোগী রোগী বাছাই করে আসেন। তাঁদেরই এখানে নিয়ে আসা হয়। অস্ত্রোপচারের পর হাসপাতালের চিকিৎসা দল আবারও সেখানে গিয়ে ফলোআপ চিকিৎসা দিয়ে আসে।