Thank you for trying Sticky AMP!!

পাঁচ কিশোরের উদ্যোগ বদলে দিল গ্রাম

জিন্দা পার্কের ভেতরে মনোরম ঘর। সর্বত্র প্রাণ–প্রকৃতির অপূর্ব সহাবস্থান। ছবি: প্রথম আলো

স্কুলপড়ুয়া পাঁচ কিশোর মাত্র ৬০ টাকা পুঁজি নিয়ে শুরু করেছিল একটি সমিতি। সেটি গত শতকের আশির দশকের শুরুর কথা। তারপর প্রায় চার দশকের শ্রম আর অল্প অল্প পুঁজি মিলিয়ে তাদের সেই ‘অগ্রপথিক পল্লী সমিতি’ নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলার দাউদপুর ইউনিয়নের জিন্দা গ্রামের চেহারাই বদলে দিয়েছে। ‘জিন্দা পার্ক’ নামের একটি অনন্য স্থাপনা নির্মাণের পাশাপাশি গড়ে তুলেছে প্রাণ-প্রতিবেশের বৈচিত্র্যময় সম্পর্ককে ধারণ করা সৌহার্দ্যময় সমাজব্যবস্থা। তাদের স্লোগান, ‘দরদি সমাজ গঠন’।

অগ্রপথিক পল্লী সমিতির সদস্যসংখ্যা এখন পাঁচ হাজারের বেশি। উপকারভোগীর সংখ্যা পাশের সাত গ্রামের সবাই। তাঁদের প্রত্যেকের শ্রমে-ঘামেই গড়ে উঠেছে প্রায় ১০০ বিঘা আয়তনের এক বিশাল কমপ্লেক্স, যা এখন জিন্দা পার্ক নামে পরিচিত। অবশ্য উদ্যোক্তারা এটিকে প্রথাগত কোনো ‘পার্ক’ কিংবা ‘রিসোর্ট’ বলতে নারাজ। তাঁদের ভাষ্য, এটা অনেকটা চাপিয়ে দেওয়া একটা নাম। তাঁরা এই কমপ্লেক্সকে ডাকতে পছন্দ করেন ‘ঐকতান’ নামে। আদিতে এই পুরো প্রকল্পটিকে শান্তিনিকেতনের আদলে গড়তে চেয়েছিলেন তাঁরা। নাম ঠিক করেছিলেন ‘শান্তিকানন’। এখন এই জিন্দা পার্ককে ঘিরেই পরিচালিত হচ্ছে সমিতির সব কার্যক্রম।

উদ্যোক্তারা বলছেন, দেয়াল দিয়ে ঘিরে দিলে বন্দী ভাব আসে, সেই চিন্তা থেকে পুরো কমপ্লেক্সের তিন দিক পরিকল্পিতভাবে জলাশয় দিয়ে ঘেরা। সম্প্রতি দেখা যায়, এই জলাধারগুলোই এলাকার সীমানা নির্ধারণ করেছে। এ ছাড়া ভেতরেও রয়েছে দুটি বিশাল আয়তনের জলাশয়। সব মিলিয়ে জলাশয়ের পরিমাণ মোট জায়গার ২৫ শতাংশ। গোটা কমপ্লেক্সে মন শান্ত করে দেওয়ার মতো সবুজের সমারোহ। এর মধ্যে আছে দৃষ্টিনন্দন  নির্মাণশৈলীর একটি স্কুল, পাঠাগার, মসজিদ ও কটেজ। আছে একটি স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র। খেলার মাঠ। নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য তৈরি হচ্ছে নতুন আরেকটি স্কুল ভবন। চলছে একটি রেস্তোরাঁ ও রেস্ট হাউস তৈরির কাজ। প্রকৃতির সঙ্গে এই অবকাঠামোগুলোর সহাবস্থান বোঝা যায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই। বর্তমানে গোটা কমপ্লেক্সে আড়াই শ প্রজাতির প্রায় ২৫ হাজার গাছ আছে। এই শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, পাখপাখালিরা বিরক্ত হয়, এ জন্য এখানো কোনো ‘পিকনিক পার্টি’র প্রবেশাধিকার নেই। সাধারণ দর্শনার্থীরা ১০০ টাকার টিকিটে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এখানে সময় কাটাতে পারেন। ভেতরে সমিতির নিজস্ব রেস্তোরাঁ আছে, সেখানে গ্রহণযোগ্য দামে মানসম্মত খাবার পাওয়া যায়। তবে এখানে রাতে থাকার কোনো ব্যবস্থা নেই। উদ্যোক্তারা বলছেন, ভবিষ্যতে এখানে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের নামে একটি সংগীত বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ ও পরিচালনার পরিকল্পনাও আছে তাঁদের। এ জন্য আলাদা জায়গাও রাখা হয়েছে।

অগ্রপথিক পল্লী সমিতির প্রতিষ্ঠাতা তবারক হোসাইন, নাসিরউদ্দীন কাজী, শাহাদাৎ হোসেন, মাহাবুব আলম ও তাবারক হোসেন আকন্দ। এই ব্যতিক্রমী স্থাপনাটি গড়ে তোলার পেছনের গল্পটি জানতে চাইলে প্রধান উদ্যোক্তা তবারক হোসাইন বলেন, ‘১৯৮২ সালে সামাজিক কর্তব্যবোধের তাগিদ থেকে এই সমিতির যাত্রা শুরু। সমিতির সদস্যদের চাঁদায় সঞ্চিত পুঁজির পরিমাণ বাড়লে আমরা সেখান থেকে জিন্দা গ্রামসহ আশপাশের আরও সাত গ্রামের মানুষের বিভিন্ন প্রয়োজনে ঋণ দেওয়া শুরু করি। এলাকার নানা উন্নয়নকাজেও ভূমিকা রাখে এই সমিতি। আস্তে আস্তে সমিতির প্রতি মানুষের আস্থা বাড়ে। সদস্যসংখ্যাও বাড়তে থাকে। এ সময় একটা আদর্শ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম গড়ে তোলার চিন্তা মাথায় আসে। সেই গ্রামে আধুনিক শিক্ষা, স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও বিনোদনের পাশাপাশি এলাকার মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ থাকবে।’

উদ্যোক্তারা বলছেন, এই চিন্তা থেকেই নব্বইয়ের দশকের শুরুতে এই কমপ্লেক্স গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়। এ জন্য তবারক হোসাইন তাঁর পৈতৃক সম্পত্তি থেকে ৬০ বিঘা জমি দেন। বাকি ৪০ বিঘা জমি আসে দান ও ইজারার মাধ্যমে। এখন দুই বছর মেয়াদি ১৮ সদস্যের একটি কিমিটি এই কমপ্লেক্স পরিচালনা করে। পর্যায়ক্রমে সমিতির সব সদস্যের পরিচালনা পর্ষদে যুক্ত হওয়ার সুযোগ আছে।

পদে পদে বাধা

গুগল ম্যাপের সুবাদে এখন পাখির চোখে খুব চমৎকার দেখা যায় জিন্দা পার্কের চিত্র। তবে ছবিতে ধূসর হয়ে থাকা অংশটা হচ্ছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের জায়গা। রাজউক তাদের পূর্বাচল প্রকল্পের জন্য ১৯৯৫ সালে এই জিন্দা পার্ক এলাকাটি অধিগ্রহণ করে। তারপর বেশ কয়েক দফায় রাজউক ও গ্রামবাসীর মধ্যে দখলচেষ্টা ও প্রতিরোধের ঘটনা ঘটেছে। বিষয়টি আদলত অবধি গড়িয়েছে। শেষে রাজউক ‘অধিগ্রহণবলে জমির মালিক রাজউক/প্রতিষ্ঠা, পরিচালনা ও উন্নয়নে অগ্রপথিক কল্যাণ সমিতি’ এমন একটি সাইনবোর্ড লাগিয়ে ফিরে যায়।

এ বিষয়ে সমিতির প্রতিষ্ঠাতা তবারক হোসাইন বলেন, ‘জায়গাটি তথাকথিত পার্ক কিংবা রিসোর্ট হিসেবে পরিচালনার কোনো পরিকল্পনা সমিতির নেই। পুরো ব্যাপারটাই আমরা করেছি এলাকাবাসীর স্বার্থের কথা চিন্তা করে। তাঁরাই এটার মালিক, পরিচালনাকারী। রাজউক তো জমি অধিগ্রহণ শেষে তা উন্নয়ন করে আবার ব্যক্তিমালিকানায় দিয়ে দেয়। তাহলে এই জমি আবার মূল বাসিন্দাদের কাছে ফিরিয়ে দিতে বাধা কোথায়?’

গর্বের ধন

সম্প্রতি জিন্দা গ্রামের কান্তা মনোহরপুর মহল্লায় কথা হলো আলাউদ্দিন শিকদারের সঙ্গে। তাঁর মতে, সমিতির এই কমপ্লেক্সটির কারণেই তাঁদের এলাকাটি দেশজুড়ে পরিচিতি পেয়েছে। এটাকে কেন্দ্র করেই দ্রুত এই এলাকায় বিদ্যুৎ এসেছে, যাতায়াতব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে। তাই এটা তাঁদের কাছে ‘গর্বের ধন’।

এই সমিতি ও কমপ্লেক্সের প্রতি স্থানীয় ব্যক্তিদের আবেগ-অনুভূতির বিষয়টি টের পাওয়া গেল আরেকটি ছোট ঘটনায়। এদিন সকালে কমপ্লেক্সের প্রধান ফটকের সামনে কথা হলো সমিতির সদস্য আবু সাদ্দাদের সঙ্গে।  তিনি কমপ্লেক্সের ভেতরে অসাধারণ স্থাপত্যশৈলীর পাঁচতলা গ্রন্থাগারটি নির্মাণের জন্য এক কোটি টাকা অনুদান দিয়েছেন।

উদ্যোক্তারা জানান, ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন ৭০ থেকে ৮০ জন দর্শক আসেন। ছুটির দিনে এই সংখ্যা পাঁচশ ছাড়িয়ে যায়। তবে কেবল টিকিট বিক্রির টাকা থেকে কমপ্লেক্স পরিচালনার ব্যয় ওঠে না। এ ক্ষেত্র অবকাঠামো নির্মাণসহ নানা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সমিতির সদস্যদের পাশাপাশি গ্রামের অনেক সাধারণ মানুষ উদ্যোগী হন। এভাবে অনুদান আর স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতেই এগিয়ে চলেছে দরদি সমাজ গড়ার যাত্রা।