Thank you for trying Sticky AMP!!

পার্বতী ও ময়ূরী সাংসদ হতে চান

তাঁরা দুজন সমাজের এমন একটি শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করছেন, যাঁরা আজন্ম বুকচাপা একটা কষ্ট বয়ে বেড়ান। অনাদর, অবহেলা, বিতাড়ন পদে পদে। আপনজন থেকেও নেই। জীবিকার পথ রুদ্ধ। মনের গভীরে গুমরে কাঁদে কষ্ট—কত দিন মাকে দেখি না! এরপরও তাঁরা পথ চলছেন একটুখানি অধিকার পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে। জনপ্রতিনিধিত্ব করার ইচ্ছায় তাঁরা হতে চাইছেন সাংসদ।

ওহিদুল ইসলাম এখন পার্বতী নামে পরিচিত। আর আরিফ হয়েছেন আরিফা ইয়াসমিন ময়ূরী। শুধু নাম পরিবর্তন হয়নি, পোশাক, আচার-ব্যবহারেও তাঁরা এখন আর পুরুষ নন, তাঁরা নারী। নিজেদের পরিচয় দেন ‘রূপান্তরিত নারী’ বলে। চেনাজানা সবাই জানে ‘হিজড়া’ বলে। তাঁরা একাদশ জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের সাংসদ হওয়ার জন্য বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম কিনেছেন।

আরিফা ও পার্বতীর মতো মোট আটজন ‘রূপান্তরিত নারী’ সংরক্ষিত আসনের সাংসদ হওয়ার জন্য আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম কিনেছেন। গতকাল রোববার প্রথম আলো কার্যালয়ে বসে কথা হয় আরিফা ও পার্বতীর সঙ্গে। তাঁদের মতে, আওয়ামী লীগ সরকারই প্রথম তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে স্বীকৃতি দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলের পক্ষ থেকে সংসদে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ দিলে বিশ্বের কাছেও তা প্রশংসিত হবে। এ দুজনের একজনও জাতীয় সংসদের ভেতরে কখনো প্রবেশের সুযোগ পাননি।

সাংসদ হতে চাওয়ার বিষয়ে এই দুজন বলেন, একজন হিজড়া (তৃতীয় লিঙ্গ) অন্য একজন হিজড়ার সমস্যা বা সম্ভাবনা যেভাবে চিহ্নিত করতে পারবেন, অন্য কেউ তা পারবেন না। সংসদে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের প্রতিনিধিত্ব থাকলে তাঁদের জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রাখাটা সহজ হবে। তবে সাংসদ হওয়ার সুযোগ পেলে শুধু তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করবেন, তা না, নারী–শিশুসহ অবহেলিত মানুষের পাশে দাঁড়াবেন। সাংসদ হিসেবে কথা বললে অন্যরা তা গুরুত্ব দেবেন, এই সুযোগটাই চাইছেন তাঁরা। এ দুজনই মাঠপর্যায়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে জানালেন।

২০১৩ সালে সরকার হিজড়াদের ‘হিজড়া লিঙ্গের’ স্বীকৃতি দিয়েছে। এতে সমাজে একটি পরিবর্তনের ধারা শুরু হয়েছে। কিন্তু তারপরও এই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা চাকরি পান না। বাড়ি ভাড়া পেতে হলে মোটা অঙ্কের অগ্রিম জামানত দিতে হয়। ‘হিজড়া’ পরিচয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র করতে পারেন না। কেননা, বাবা–মায়ের দেওয়া নামেই এই মানুষগুলোর শিক্ষাগত সনদ, নাম পরিবর্তন করতে হলে সব সনদ পাল্টাতে হবে। খাদ্যবস্ত্রের সংস্থান করতে মানবেতর জীবন কাটাতে হয়।

তৃতীয় লিঙ্গের আদি পেশা হাটবাজার থেকে টাকা তোলা বা ছল্লা, বাচ্চা নাচিয়ে পয়সা নেওয়া—এসব কৌশল এখন হুমকির মুখে। তৃতীয় লিঙ্গের কিছু মানুষ আদি এ পেশাকে জবরদস্তির পর্যায়ে নিয়ে গেছেন বলে সাধারণ মানুষও বিরক্ত। এখনো তৃতীয় লিঙ্গের কেউ মারা গেলে কোন নামে সৎকার হবে, কে জানাজা পড়াবেন, কবরস্থানে জায়গা দেওয়া যাবে কি না ইত্যাদি প্রশ্ন সামনে চলে আসে।

আরিফা ও পার্বতীর কথা—প্রথমত তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের মানুষ হিসেবে দেখতে হবে। তাঁরা তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি পেয়েছেন। এখন মানবাধিকার পেতে যুদ্ধ করতে হচ্ছে।

আরিফা ময়মনসিংহ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে তড়িৎকৌশলে ডিপ্লোমা পাস করার পরও শুধু তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ পরিচয়ের কারণে কোনো চাকরি পাননি বলে মনে করেন। তবে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ পরিচয়েই তিনি দেশে প্রথমবারের মতো ২০১৭ সালে ‘সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছেন যে নারী’ ক্যাটাগরিতে জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ ‘জয়িতা’ পুরস্কার পেয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে ৫০ হাজার টাকা ও ক্রেস্ট নিয়েছেন।

পার্বতী (বামে) ও ময়ূরী (ডানে)। ছবি: আব্দুস সালাম

জামালপুরের আরিফা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি ও ভিক্ষাবৃত্তি থেকে ফিরিয়ে আনতে জামালপুর সদরে ‘সিঁড়ি সমাজ কল্যাণ সংস্থা’ এবং ‘সিঁড়ি তৃতীয় লিঙ্গ উন্নয়ন মহিলা সংস্থা’ নামের দুটি সংগঠনে বর্তমানে সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। প্রায় ১০০ জন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ এসব সংগঠনের কর্মকাণ্ডে জড়িত। এসএমই ফাউন্ডেশনের সহায়তায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় পণ্য বিক্রির জন্য আরিফা বর্তমানে ঢাকায় আছেন। আরিফার বাবা বেঁচে নেই। মা আছেন। পরিবারে দুই ভাই আছেন।

আরিফা বলেন, ‘কোনো জায়গায় গেলে শুনতে হয়—তুই হিজড়া! তুই এ কাজ করতে পারবি না। তখন খুব খারাপ লাগে। কেন পারব না করতে? আমরা কি মানুষ না?’

তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কর্মরত বেসরকারি সংগঠন বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটিতে পার্বতী জুনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার হিসেবে ইউএনডিপির একটি প্রোগ্রামে কাজ করছেন। এর আগে এ সংগঠনেই মাঠপর্যায়ে কাজ করেছেন। বাবা মুন্সিগঞ্জের সিরাজুল ইসলাম মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, তিনি মারা গেছেন। মা মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী হিসেবে ভাতা পাচ্ছেন।

পার্বতী সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটিতে ইনফরমেশন অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। তবে বাবা মারা যাওয়ায় পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। তারপর থেকেই বড় ভাই, চাচাসহ অন্যরা খারাপ ব্যবহার করা শুরু করেন। পরে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের আদি পেশা হয়ে বর্তমানে চাকরি করছেন। সুস্থ জীবন নামের একটি স্বেচ্ছাসেবক সমাজকল্যাণমূলক সংস্থার সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। সমাজসেবা অধিদপ্তরের সমাজসেবা কার্যক্রম-১–এর সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন।

পার্বতী বলেন, ‘আমি রাজধানীর জুরাইনে থাকি। মা থাকেন গেন্ডারিয়া। এরপরও মায়ের মুখটা দেখি না—কত বছর হয়ে গেল! শুধু আমার জন্য একমাত্র বোনের সংসারে নানা অশান্তি হয়েছে। এখন তো আমি বাড়ি ছাড়া। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষের কাছ থেকে গালি শুনতেই হবে।’

সম্প্রতি একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়ার অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে পার্বতী বলেন, ‘আমাকে দেখে ছোট ছেলেমেয়েরা মাঠে জড়ো হয়ে হিহি করতে লাগল। আমার নামও জানতে চাইল না—হিজড়া হিজড়া বলতে লাগল। ওদের অবস্থা দেখে মনে হয়েছে, চিড়িয়াখানা থেকে বের হওয়া কোনো বাঁদর দেখতে এসেছে। এই ধরনের কষ্টগুলো আমাদের নিত্যসঙ্গী।’

বর্তমানে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের অনেকেই সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে টাকাপয়সা আদায় করছেন—এ প্রসঙ্গে আরিফা ও পার্বতীর বক্তব্য হলো, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে শিক্ষার ব্যবস্থা করে যথাযথ পুনর্বাসন করা হলেই এ ধরনের অপরাধগুলো কমানো সম্ভব। বিকল্প কোনো আয়ের পথ না দেখিয়ে এগুলো বন্ধ করতে বললে তা কাজের কাজ হবে না। আর নতুন প্রজন্মের তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের যথাযথ শিক্ষার আওতায় আনা সম্ভব হলে তাঁরা নিজেরাই মানসম্মত জীবনযাপনে উৎসাহী হবেন।

তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর অনেকে পেশাগত কারণেই এইচআইভি এইডসের ঝুঁকির মধ্যে আছেন। আরিফা ও পার্বতী তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়িয়ে এ সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখতে চান।

প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপে পার্বতী জানালেন, ছোটবেলা থেকেই নিজেকে বাংলা সিনেমার নায়ক সালমান শাহর নায়িকা মনে করতেন। আর আরিফা মিঠুন চক্রবর্তীর নায়িকার সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে নিতেন। এখন দুজনেরই ভালোবাসার মানুষ আছে। জানালেন, নারী বা পুরুষের মতো তাঁদের কোনো সংসার নেই।

পার্বতী বললেন, ‘সমাজে উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। মনোনয়ন ফরম নিতে গেলে অনেকে নেতা–নেত্রী আমাদের স্বাগত জানিয়েছেন। বৈষম্যহীন সমাজগঠনে সংসদে আমাদের প্রতিনিধিত্ব থাকলে কেউ কোনো আপত্তি করবেন না বলেই আমাদের বিশ্বাস।’

আর আরিফা দৃঢ় কণ্ঠেই বললেন, ‘সংসদে হিজড়াদের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ দিয়েই দেখুক, আমরা দায়িত্ব পালন করতে পারি কি না। আর কোনো সাংসদ যদি আমাদের পাশে বসতে না চান, সে সমস্যা তাঁর, আমার না।’