Thank you for trying Sticky AMP!!

প্রকল্প হয়, বধ্যভূমি সংরক্ষণ হয় না

বধ্যভূমির সঙ্গেই ভাগাড়। গত বুধবার বগুড়া রেলস্টেশন এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো
>

• মাদারীপুরে সমাদ্দার ব্রিজ-সংলগ্ন বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হলেও তা সংরক্ষণ করা হচ্ছে না
• রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ৫০ লাখ টাকা প্রয়োজন
• পাঁচটি বধ্যভূমি অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে

মাদারীপুরে সমাদ্দার ব্রিজ-সংলগ্ন বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হলেও তা সংরক্ষণ করা হচ্ছে না। স্মৃতিস্তম্ভের পাশে বাজারের ময়লা-আবর্জনা ফেলা হচ্ছে। পুরো জায়গায় গরু-ছাগল বিচরণ করছে। তাই এটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ৫০ লাখ টাকা প্রয়োজন।
গত ১১ নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীকে আধা সরকারি পত্র (ডিও লেটার) দিয়ে এই টাকা চেয়েছেন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। গত বছরও এই বধ্যভূমি সংরক্ষণের জন্য তাঁর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১১ লাখ টাকা দিয়েছিল মন্ত্রণালয়।

বিএনপি সরকারের সময় ২০০৪ সালে ৩৫টি বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হয়। ২০০৮ সাল পর্যন্ত এই প্রকল্পে ৬০ কোটি টাকা খরচ হয়। কিন্তু বেশির ভাগ বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়নি। যেগুলোতে করা হয়েছে, সেগুলোও এখন বেহাল। ২০১০ সালে বর্তমান সরকার আবার বধ্যভূমি সংরক্ষণের প্রকল্প হাতে নেয়। কিন্তু গত আট বছরে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব ছিল মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের।

সর্বশেষ গত ১১ সেপ্টেম্বর সরকার আবার ২৭১টি বধ্যভূমি সংরক্ষণের জন্য ৪৪২ কোটি টাকার প্রকল্প অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) পাস করে। ২০২১ সালের মধ্যে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে।

একনেকে এই প্রকল্প পাস হওয়ার পর প্রায় সব জেলা থেকে বধ্যভূমি সংরক্ষণের জন্য আবেদন আসতে শুরু করেছে। গত ৭ নভেম্বর একই বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক মন্ত্রীকে চিঠি দেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি জানান, তাঁর নির্বাচনী এলাকা দিনাজপুরের দুই উপজেলা পার্বতীপুর ও ফুলবাড়ীতে এখন পর্যন্ত কোনো স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়নি।

জানতে চাইলে ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটির আহ্বায়ক এম এ হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি মনে করি, এটা সরকারের চূড়ান্ত ব্যর্থতা। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যার স্থান তথা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ করে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। আমরা ২০০৪ সালে মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছিলাম, সারা দেশে এক হাজার বধ্যভূমি রয়েছে; এর মধ্যে ঢাকায় আছে ৭৩টি। এগুলো সংরক্ষণ করতে বড়জোর ১০ কোটি টাকা লাগবে। আর সরকার দফায় দফায় টাকা বরাদ্দ দিচ্ছে অথচ বধ্যভূমিগুলো এখন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা গেল না। এতে স্পষ্ট, এখানে টাকা অপচয় হচ্ছে।’

গত দুই দিনে পাঁচটি বধ্যভূমিতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বধ্যভূমিগুলো অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় বা জেলা প্রশাসন কেউ এসব বধ্যভূমির খেয়াল রাখছে না।

সরকারি বাঙলা কলেজ বধ্যভূমি
রাজধানীর মিরপুরের বিভিন্ন স্থানে যে বধ্যভূমিগুলো আবিষ্কৃত হয়েছে, তার মধ্যে সরকারি বাঙলা কলেজ অন্যতম। কলেজের ভেতরে বড় গেট ও শহীদ মিনারের মাঝামাঝি স্থানে ১৯৭১-এ পুকুর ছিল এবং হানাদার বাহিনী তার পাশে মুক্তিকামী মানুষকে লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করত।

সংরক্ষণের জন্য করা ৩৫টি বধ্যভূমির তালিকায় থাকলেও সম্প্রতি গিয়ে একে অরক্ষিতই দেখা গেছে। সেখানে কোনো স্মৃতিস্তম্ভ নেই।

বাঙলা কলেজ বধ্যভূমি সংরক্ষণে উদ্যোক্তা কমিটির সমন্বয়ক তাওহীদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘মিরপুর বাঙলা কলেজের বধ্যভূমি সংরক্ষণে আমরা শুরু থেকে যে আন্দোলন করেছি, তা কারও কাছে গুরুত্ব পায়নি। এমনকি মন্ত্রণালয়ের কাছেও না। ফলে আজ পর্যন্ত সেসব স্থান পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে শিক্ষার্থীরা যা জানতে পারত, তা থেকে বঞ্চিত রইল।’

বগুড়া স্টেশন সড়কের পাশের বধ্যভূমি
অযত্নে পড়ে আছে বগুড়া স্টেশন সড়কের পাশের বধ্যভূমিও। এর একাংশ ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। বধ্যভূমির পশ্চিম পাশে রিকশার গ্যারেজ। মূল সড়ক থেকে বধ্যভূমিতে যাওয়ার রাস্তাও দখলদারদের কবলে। স্মৃতিস্তম্ভে লেখা শহীদদের নামফলক থাকা ছয় নামের মধ্যে প্রথম চারজনের নাম প্রায় মুছে গেছে। বধ্যভূমির উত্তর ও পশ্চিম ধারে বাঁশের বেড়া দেওয়া। দক্ষিণ পাশ পুরোটাই ফাঁকা। পশ্চিম পাশের বেড়া ঘেঁষেই রিকশার গ্যারেজ, দক্ষিণ পাশে ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়।
বধ্যভূমির মূল পাটাতনের কয়েকটি জায়গাও দেবে গেছে। বধ্যভূমি মোটামুটি পরিষ্কার রয়েছে। রমজান আলী (৬০) নামের একজন এটা নিয়মিত পরিষ্কার করেন।

সৈয়দপুরে গোলাহাট বধ্যভূমি
নীলফামারীর সৈয়দপুরে গোলাহাট গেলে দেখা যায়, বধ্যভূমির স্মৃতিস্তম্ভের কাজ শেষ হয়নি। ওই বধ্যভূমিতে ১৯৭১ সালের ১৩ জুন ৪৪৮ জন হিন্দু মাড়োয়ারিকে ট্রেন থামিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী ও দোসর বিহারিরা। সংসদে বিরোধীদলীয় হুইপ শওকত চৌধুরী জানান, তিনি ২০১৩ সালে বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত করতে পারেননি।

পঞ্চগড়ের চেকরমারী বধ্যভূমি
পঞ্চগড়ের চেকরমারী বধ্যভূমিটির আশপাশে স্থানীয় লোকজন চায়ের চারা উৎপাদনের নার্সারি তৈরি করেছেন। পঞ্চগড় সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শাহিনা শবনম বলেন, ‘আমি অল্প কিছুদিন হলো পঞ্চগড়ে যোগদান করেছি। ওই বধ্যভূমিটির ব্যাপারে খোঁজখবর নেব। যদি সরকারিভাবে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ হয়ে থাকে, তাহলে তা বাস্তবায়ন করব। আর সংস্কারের ব্যবস্থা না হলে আমি দ্রুত উদ্যোগ নেব।’

ঘাগড়া কুনাপাড়া বধ্যভূমি
শেরপুরের ঝিনাইগাতীর হাতীবান্ধা ইউনিয়নে অবস্থিত ঘাগড়া কুনাপাড়া বধ্যভূমি। এটি জেলার সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি। শহীদদের স্মরণে এখানে একটা স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হলেও তা অবহেলা-অযত্নেœপড়ে আছে। সরেজমিনে দেখা যায়, বধ্যভূমিতে কোনো নামফলক নেই। সীমানাপ্রাচীর না থাকায় সেখানে খড় শুকানো হয়। হাতীবান্ধা ইউপি চেয়ারম্যান মো. নুরুল আমীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই বধ্যভূমি সবচেয়ে অবহেলিত। দেখাশোনার কোনো কমিটি নেই।’

জানতে চাইলে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির প্রথম আলোকে বলেন, ‘বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর উদ্যোগই আমাদের নেই। দিবস এলে শুধু বড় বড় কথা। বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেই শেষ। সেসব রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না। ঠিকাদার কী কাজ করেছে, তা দেখার দরকার ছিল। প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে, বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। ১০ বছর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকার পরও বধ্যভূমি সংরক্ষণ করতে পারল না।’

জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা আমাদের ব্যর্থতা। বধ্যভূমি সংরক্ষণ না করার বিষয়টি আমাকেও কষ্ট দেয়। গণর্পূত বিভাগসহ অন্য যাদের সহযোগিতার কথা ছিল, তারা সহযোগিতা করেনি। স্থানীয়রাও ভালোভাবে এসব সংরক্ষণ করেনি। এখন শুধু মেরামতের টাকা চায়।’

[প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন বগুড়া সংবাদদাতা, পঞ্চগড় প্রতিনিধি, নালিতাবাড়ী (শেরপুর) প্রতিনিধি, সৈয়দপুর (নীলফামারী) প্রতিনিধি। ]