Thank you for trying Sticky AMP!!

প্রতিবাদ করলেই মামলা

ইউজিন নকরেক (৫৫) টাঙ্গাইলের মধুপুর বন এলাকার সামাজিক সংগঠন জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি। গত শতকের ষাটের দশকে প্রতিষ্ঠিত এই সংগঠন এই বনের গারো ও কোচ জাতিগোষ্ঠীর অধিকার নিয়ে কাজ করে। চলতি বছরের জুন মাসে হঠাৎ ইউজিন জানতে পারেন, তাঁকে প্রধান আসামি করে গত বছরের জুন ও জুলাই মাসে দুটি মামলা করেছে বন বিভাগ।

দুটি মামলায় অপরাধ সংঘটনের যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে কোনো অমিল নেই। বলা হয়েছে, মধুপুর জাতীয় উদ্যান বিটে বনপ্রহরীরা বনের মধ্যে ইউজিনসহ কয়েকজনকে গাছ কাটতে দেখে তাড়া দেন। তাড়া খেয়ে পালিয়ে যায় আসামিরা। পরে বনকর্মীরা গিয়ে মূল্যবান কাটা গাছ উদ্ধার করেন।

ইউজিন বলছিলেন, ‘আমার বয়স, শিক্ষা, সামাজিক অবস্থান কি বনের কাঠ চুরির মতো? এর চেয়ে অপমান আর কী হতে পারে?’

বনের জলছত্র গ্রামে নিজের বাড়িতে একটি ঘর তুলতে চেয়েছিলেন তৃপ্তি চিরান। এ কাজে বাদ সাধেন বন বিভাগের স্থানীয় কর্মীরা। বন বিভাগের এই আচরণে প্রতিবাদ জানান তাঁর আত্মীয় বিজলী দফো এবং বোনের মেয়ের জামাই নিটুল সাংমা। এরপরই বনে অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে গত মে মাসে মামলা ঠুকে দেয় বন বিভাগ।

স্থানীয় ব্যক্তিরা বলছেন, শুধু ইউজিন বা নিটুল নয়, এই বনজীবী গারোদের মধ্যে যাঁরা নেতৃস্থানীয়, তাঁদের বিরুদ্ধে এভাবে নানা অভিযোগে বন মামলা শুরু হয়েছে মধুপুরে। প্রায় ২৫ হাজার গারো এবং ৪ হাজার কোচ পরিবার বনের ৫৯টি গ্রামে বাস করে। সম্প্রতি অন্তত আটটি গ্রাম ঘুরেছেন প্রতিবেদকেরা। দেখেছেনে প্রতি গ্রামে এসব মানুষের মধ্যে ভীতি, শঙ্কা।

কেন এই মামলাবাজি?

স্থানীয় গারো ও কোচদের অভিযোগ, গত বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি মধুপুর বনের ৯ হাজার একরের বেশি জমি সংরক্ষিত বন ঘোষণা করে বন বিভাগ। ওই এলাকার মধ্যে পড়েছে গারো-কোচদের ১৩টি গ্রাম।

বন আইনের ২৬ ধারা অনুযায়ী, সংরক্ষিত বনে আগুন জ্বালানো, অনধিকার প্রবেশ, গবাদিপশু চরানোও দণ্ডনীয় অপরাধ। স্থানীয় বনবাসীরা এর প্রতিবাদ শুরু করেন। তাঁদের অভিযোগ, বন আইনে সংরক্ষিত বন করার আগে স্থানীয় ব্যক্তিদের মত নেওয়ার বাধ্যবাধকতা ছিল। কিন্তু বন বিভাগ তাঁদের সঙ্গে কোনো আলোচনাই করেনি। এখন তাঁদের শত বছরের বাসস্থান থেকে উচ্ছেদের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

গারো নেতা ইউজিন বলছিলেন, ‘আমাদের প্রতিবাদ শুরুর পর থেকেই বন মামলা শুরু হয়েছে। বন বিভাগের এটা পুরোনো কৌশল। এর আগে ২০০৪ সালে ইকোপার্কবিরোধী আন্দোলনের পর এভাবে শত শত মিথ্যা মামলা দেয় বন বিভাগ। এখন আবার সেই মামলাগুলো উজ্জীবিত করা হচ্ছে।’

টাঙ্গাইল জেলা আদালত সূত্র জানায়, ২০১৬ সালে মধুপুরে বন মামলার সংখ্যা ছিল ২৩৮। এ বছরের প্রথম ছয় মাসেই নতুন মামলা হয়েছে ১৪৮টি।

সম্প্রতি বন ঘুরে স্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে দেখা যায়, কখন মামলার পরোয়ানা নিয়ে পুলিশ আসবে তা নিয়ে সবাই শঙ্কিত। অনেকেই রাতে বাড়িতে থাকেন না।

পুলিশকে অর্থ দিতে হয়

মামলায় অভিযুক্ত একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একটি মামলা শুরু হলে বনকর্মী, পুলিশকে থোক অর্থ দিতে হয়। এভাবে অর্থ দিয়ে মামলা থেকে নাম বাদ দিতে পেরেছেন অনেকে।

মধুপুর বনে সাড়ে তিন দশক ধরে কাজ করছেন প্রকৃতিবিদ ফিলিপ গাইন। তিনি বলেন, ‘এখন মধুপুরে বন মামলা সামাজিক বনায়নে অংশগ্রহণকারীবন বিভাগ ও পুলিশের অসাধু কর্মীদের আয়ের বড় উৎসে পরিণত হয়েছে।মিথ্যা বন মামলার ফাঁদে ফেলা হয়েছে এখানকার বনজীবীদের।’

ঝরাপাতার শালবনে বন মামলায় সর্বস্বান্ত হওয়া মানুষ কম নেই। তবে টাঙ্গাইলের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মাসুদ রানার সাফ কথা, ‘অপরাধ না করলে মামলা দেওয়া হয় না।’ গত সোমবার তিনি প্রথম আলোকে বললেন, ‘বনের সম্পদে গারো এবং অনেক বাঙালির লোলুপ দৃষ্টি। বনকর্মীরা অপরাধের চেয়ে বরং কম মামলাই দেন।’

বন মামলা এবং মানুষের নিঃস্ব হওয়ার চিত্র তুলে ধরা হয় পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের কাছে। বনমন্ত্রী প্রথম আলোকে বলেন, ‘অকারণে বন মামলা দেওয়ার কথা না। এখন বন বিভাগ অনেক সাবধান। বিষয়গুলো নিয়ে আমি স্থানীয় বন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলব।’

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘আপনি প্রথম ব্যক্তি, যাঁর কাছ থেকে ঘটনাগুলো শুনলাম। খোঁজ না নিয়ে কথা বলতে পারি না। এখানে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের ভূমিকাই মুখ্য। তবে যদি অন্যায্য কিছু ঘটে থাকে, সে বিষয়ে আমি দেখব।’