Thank you for trying Sticky AMP!!

প্রাথমিকের বই ছাপা নিয়ে জটিলতা বাড়ছে

প্রাথমিকের পাঠ্যবইয়ের গুণগত মান বজায় রাখতে নিরাপত্তা জামানত ৫ শতাংশ বাড়ানো এবং মান নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত বিল আটকে রাখার শর্ত দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। ছাপাখানার মালিকেরা এসব শর্ত ‘অপমানজনক’ উল্লেখ করে প্রয়োজনে আইনের আশ্রয় নেওয়ার কথা বলেছেন। এর ফলে এবার সময়মতো পাঠ্যবই শিক্ষার্থীদের হাতে পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।

বিদেশি প্রকাশনা সংস্থাকে ঠেকাতে দেশি ছাপাখানার মালিকেরা জোটবদ্ধভাবে প্রাক্কলিত দরের ৩২ শতাংশ কমে কাজ করতে আগ্রহ দেখান। অবিশ্বাস্য কম দামে শিক্ষার্থীদের মানসম্মত বই দেওয়া সম্ভব নয় বলে প্রকাশনা খাত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মত দিয়ে আসছেন। বিশ্বব্যাংকও মনে করছে, এত কম দামে ছাপার কাজ দেওয়া হলে প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা মানসম্মত বই পাবে না। প্রথমে দরপত্র বাতিলের কথা বললেও এখন বিশ্বব্যাংক ছাপাখানার মালিকদের চাপের মধ্যে রাখতে কিছু শর্ত জুড়ে দিতে চাইছে।
বিশ্বব্যাংকের কঠোর শর্ত আরোপ এবং ছাপাখানার মালিকদের তা না মানার ঘোষণায় বিনা মূল্যের প্রাথমিকের পাঠ্যবই ছাপা এবার বিলম্ব হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। আর জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) দুই পক্ষের চাপে পড়ে অনেকটা হাত গুটিয়ে বসে আছে।
এ পরিস্থিতি সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে সব পক্ষের মধ্যে আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। খুব শিগগির এর সুরাহা হয়ে যাবে। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, সরকার বছরে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা মূল্যের বই ছাপার কাজ করছে এবং দেশের ছাপাখানাগুলো এ দিয়ে উপকৃত হচ্ছে। অনেক মানুষ এই শিল্পে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কাজ করছে, উপকৃত হচ্ছে। এ বিষয়টি কারও কারও মনে রাখা দরকার।
এ বছর প্রাথমিকের পাঠ্যবই ছাপার ক্ষেত্রে প্রকাশনাশিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রায় সবাই একবাক্যে বলে আসছেন, নির্দিষ্ট শর্ত ও মান অনুযায়ী এত কম দামে বই ছাপা সম্ভব নয়। এ নিয়ে প্রথম আলোয় ৩ আগস্ট প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠান, বিশ্বব্যাংক ও ছাপাখানার মালিকদের মধ্যে আলোচনা ও চিঠি চালাচালি শুরু হয়।
গত বছরের ২০ জুলাই এনসিটিবি ছাপাখানার মালিকদের ‘নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড’ দিয়ে কাজ পাওয়ার কথা জানিয়ে দেয়। এবার এখনো সেই চিঠি দেওয়া সম্ভব হয়নি। এই চিঠি দেওয়ার দিন থেকে বই ছাপা পর্যন্ত সময় লাগে ১৩০ দিন। কিন্তু বছরের প্রথম দিন বই দিতে হলে হাতে সময় আছে ১২৮ দিন। এনসিটিবি বলছে, আজ দূরের কথা—কবে, কীভাবে ছাপাখানার মালিকদের চিঠি দেওয়া যাবে, তা অনিশ্চিত।
পাঠ্যবই বিষয়ে এনসিটিবির একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, পরিস্থিতি এমন অবস্থায় গেছে যে বিশ্বব্যাংকের শর্ত আরোপ করার মধ্যেও যেমন যুক্তি আছে, তেমনি ছাপাখানার মালিকদের বক্তব্যেরও ভিত্তি আছে।
বিশ্বব্যাংকের শর্ত: প্রাথমিকের পাঠ্যবই মাঠে পৌঁছার পর মাঠ থেকে বই সংগ্রহ করে স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এর মান যাচাইয়ের পর মুদ্রাকর ও প্রকাশকদের বিল শোধ করতে বলেছে বিশ্বব্যাংক। এ ছাড়া তাদের পারফরম্যান্স গ্যারান্টি (পিজি) ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করতে বলেছে।
এনসিটিবি সূত্র জানায়, সরকারি ক্রয়বিধি অনুযায়ী, প্রাক্কলিত দরের চেয়ে প্রদত্ত দর অস্বাভাবিক কম হলে নিরাপত্তা জামানত ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো যায়। বিশ্বব্যাংক তা ১৫ শতাংশ করতে বলেছে। কিন্তু দরদাতারা বলছেন, তাঁরা দরপত্রের শর্ত দেখে দর দিয়েছেন, সরকারি ক্রয়বিধি বা বিশ্বব্যাংকের শর্ত তাঁদের সামনে ছিল না।
বিশ্বব্যাংক ১৭ আগস্ট এনসিটিবির চেয়ারম্যানকে এসব শর্ত যুক্ত করার পরামর্শ দিয়ে চিঠি দেয়। ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের টাস্ক টিম লিডার আয়েশা ওয়াওদার ওই চিঠিতে সই করেন। চিঠির সঙ্গে পাঠ্যবইয়ের মান সুরক্ষায় এবং এ-সংক্রান্ত ঝুঁকি মোকাবিলায় কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স প্রটোকল (কিউএপি) তৈরি করে তা এনসিটিবিকে দেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান নারায়ণ চন্দ্র পাল প্রথম আলোকে বলেন, পরিস্থিতি যে পর্যায়ে গেছে, তাতে এনসিটিবি চাইলেও এককভাবে কিছু করা সম্ভব নয়। বিষয়টি তাঁরা মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছেন।
চেয়ারম্যান আরও বলেন, বিশ্বব্যাংক ও মুদ্রাকর—উভয় পক্ষের কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু যেকোনো উপায়ে জাতীয় স্বার্থে ছেলেমেয়েদের হাতে সময়মতো বই পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে এই সংকটের সমাধান খুঁজতে হবে।

.
বিশ্বব্যাংকের শর্ত মানতে চাইছেন না মুদ্রাকররা, মামলার হুমকি

ছাপাখানার মালিকদের প্রত্যাখ্যান: বিশ্বব্যাংকের শর্ত মুদ্রাকরেরা প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাঁরা বলছেন, দরপত্রের শর্তের বাইরে নতুন কোনো শর্ত তাঁরা মেনে নেবেন না। এনসিটিবি চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করে ছাপাখানার মালিক ও তাঁদের সমিতির নেতারা এর প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির চেয়ারম্যান শহীদ সেরনিয়াবাত প্রথম আলোকে বলেন, শর্ত অনুযায়ী মুদ্রাকরেরা দরপত্র দাখিল করে সর্বনিম্ন দরদাতা হয়েছেন। এখন আবার বিশ্বব্যাংকের শর্ত তাঁদের ওপর আরোপ করতে গেলে মামলা-মোকদ্দমা করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
এক প্রশ্নের জবাবে শহীদ সেরনিয়াবাত বলেন, শতভাগ বই ছাপতে সক্ষম হলেও বিদেশিদের ডেকে আনার প্রবণতা ঠেকাতে তাঁরা কম দর দিয়েছেন। কিন্তু লোকসান হলেও বা লাভ কম হলেও তাঁরা শর্ত অনুযায়ী বই সরবরাহ করবেন। যদি কোনো ছাপাখানার মালিক বই বুঝিয়ে দিতে না পারেন, তাহলে বোর্ড তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে।
বিরোধ যেখান থেকে শুরু: প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে এবার ৭৭৩ কোটি টাকা মূল্যের প্রায় ৩৫ কোটি বই বিনা মূল্যে ছেপে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণ করার প্রস্তুতি নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে প্রাথমিক স্তরে ২৯২ কোটি টাকা, প্রাক্-প্রাথমিক স্তরে ৩৮ কোটি এবং মাধ্যমিকে ৪৪৩ কোটি টাকা দর প্রাক্কলন করে এনসিটিবি দরপত্র আহ্বান করে। এই তিনটি স্তরেই প্রাক্কলিত দরের চেয়ে কম দর পড়েছে।
গত বছরের দরপত্রমূল্য এবং বাজার দর পর্যালোচনা করে এনসিটিবি শুধু প্রাথমিক স্তরের বই ছাপার জন্য ৩৩০ কোটি টাকা খরচের বিষয়টি প্রাক্কলন করে। কিন্তু ছাপাখানার মালিকেরা জোটবদ্ধ হয়ে ২২১ কোটি টাকায় এ কাজ নিয়েছেন। ফলে সরকার যে টাকায় কাজ করাতে চায়, মুদ্রাকর ও প্রকাশকেরা তার চেয়ে ১০৯ কোটি টাকা কমে কাজ করে দিতে আগ্রহ দেখিয়েছেন।
ছাপাখানার মালিকদের যুক্তি হচ্ছে দেশের প্রকাশনা সংস্থাগুলো এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। তারপরও ভারতসহ কয়েকটি দেশকে ছাপার কাজ দেওয়া হচ্ছে। অথচ ব্যাংকঋণ নিয়ে, ছাপাখানা বসিয়ে, লোকজন নিয়োগ করে তাঁরা সারা বছর পাঠ্যবই ছাপার জন্যই বসে থাকেন।
প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ১১ কোটি বই ছাপার জন্য এনসিটিবি আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে গত ২৯ এপ্রিল। এতে প্রায় সাড়ে সাত শ প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। কিন্তু ২০টি প্যাকেজে অংশ নেওয়া ২২টি ছাপাখানার সবাই কাজ না পাওয়ার আশঙ্কায় জোট বেঁধে ৩১ দশমিক ৯৪ শতাংশ কম দর দেয়।
এনসিটিবির একাধিক সূত্র জানায়, অস্বাভাবিক কম দরে কাজ নেওয়া ছাপাখানাগুলোকে অনিয়মের আশ্রয় নিতেই হবে। এই দরে ৮০ গ্রাম সাদা কাগজ, উজ্জ্বলতা ও পুরুত্ব এবং মানসম্মত ছাপার সুযোগ থাকবে না।
এর আগে ২০১১ সালে সরকার আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে প্রাথমিক স্তরের রঙিন বই ছাপার সিদ্ধান্ত নেয়। মুদ্রাকর ও প্রকাশকেরা তখন থেকেই এর বিরোধিতা করে আসছেন।