Thank you for trying Sticky AMP!!

প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য বাজেটে বরাদ্দ বৃদ্ধির আশ্বাস

প্রথম আলো কার্যালয়ে আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে গতকাল বক্তৃতা করেন অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আবদুল মান্নান। পাশে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী l প্রথম আলো

অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আবদুল মান্নান দলিত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে আগামী বাজেটে বরাদ্দের পরিমাণ বাড়ানোর জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেবেন বলে জানিয়েছেন। তিনি বৈষম্য বিলোপ আইনের খসড়া যাতে দ্রুত সংসদে উত্থাপিত হয়, সে জন্য আইনমন্ত্রীর সঙ্গেও কথা বলবেন বলে জানিয়েছেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে ‘জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল: দলিত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তি’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রতিমন্ত্রী এই আশ্বাস দেন। তিনি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ নিরসনে বিভিন্ন কাজে বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) এবং সুশীল সমাজকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান।
জাতীয় সামাজিক সুরক্ষা ফোরাম ও প্রথম আলো আয়োজিত এই গোলটেবিল বৈঠক সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। গোলটেবিল বৈঠক আয়োজনে সহযোগিতা করেছে বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন ও যুক্তরাজ্যের দাতা সংস্থা ডিপার্টমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ডিএফআইডি)।
গোলটেবিল বৈঠকে অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী বলেন, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য প্রকল্প আছে। তবে প্রকল্প বাস্তবায়ন ও নজরদারির ক্ষেত্রে দুর্বলতা আছে, তা স্বীকার করতেই হবে।
আলোচকেরা সরকারের বিভিন্ন পরিকল্পনা, প্রকল্প ও কর্মসূচিতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার বিষয়টিতে গুরুত্ব দেন। তাঁরা বলেন, এই জনগোষ্ঠীর প্রতি সমাজের বিদ্যমান আচরণ ও মনমানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। একই সঙ্গে বাজেটে বরাদ্দ বাড়াতে হবে।
সমাজে বিদ্যমান মনমানসিকতার কথা উল্লেখ করে গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও জাতীয় সামাজিক সুরক্ষা ফোরামের আহ্বায়ক রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, ‘আমরা ফোনের হ্যান্ডসেট সারাক্ষণ পরিবর্তন করি কিন্তু মাইন্ডসেট পরিবর্তন করি না।’ শিক্ষকেরা যাতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ না করেন, সে জন্য শিক্ষক প্রশিক্ষণের বিষয়গুলোতে তা সম্পৃক্ত করার পরামর্শ দেন তিনি।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, সামাজিক নিরাপত্তাসংক্রান্ত কৌশলপত্রে দারিদ্র্যবিমোচন, বৈষম্য বিলোপ, বিশুদ্ধ পানি, নারীর ক্ষমতায়নসহ সব বিষয় আনা হয়েছে। তবে এ কৌশলপত্র বাস্তবায়নই বড় চ্যালেঞ্জ। কৌশলপত্র বাস্তবায়নের রূপরেখা (রোডম্যাপ) এখনো তৈরি হয়নি। তিনি বৈষম্য বিলোপ আইনের খসড়া দ্রুত চূড়ান্ত করার জোর দাবি জানান।
গোলটেবিল বৈঠকে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের কর্মসূচি সমন্বয়কারী রেজোয়ানুল করিম সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি শক্তিশালীকরণ প্রকল্পের আওতায় দলিত জনগোষ্ঠীর সার্বিক পরিস্থিতির চিত্র তুলে ধরেন। বিভিন্ন ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা বিতরণে সুবিধাভোগী নির্বাচনে স্থানীয় সরকারের পাশাপাশি এনজিওগুলোকে সম্পৃক্ত করা এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাস্তবায়নে কার্যকর অভিযোগ নিরসনব্যবস্থা চালুর সুপারিশ করেন তিনি।
বাংলাদেশ হরিজন কল্যাণ পরিষদের মহাসচিব নির্মল চন্দ্র দাস বলেন, ‘আমাদের হোটেলে ঢুকতে দেয় না, আমরা ঢুকলে নাকি হোটেল বন্ধ হয়ে যায়। পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের জন্য সরকার ৮০ শতাংশ কোটা রেখেছে, কিন্তু তার বাস্তবায়ন হয় না। অন্যরা ভাগ নিয়ে যায়। সিটি করপোরেশনের জন্মলগ্ন থেকে চাকরি করলেও চাকরি স্থায়ী হয়নি আমাদের। কলোনিতে দাদা, বাবা তারপর আমি থাকছি, তারপরও বলতে পারি না এ ঘর আমার। উত্তর সিটি করপোরেশন পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের জন্য আবাসনের প্রকল্প হাতে নিয়েছে, এই পরিকল্পনা করার আগে আমাদের সঙ্গে একটু আলোচনা করতে পারত।’
নির্মল চন্দ্র দাস আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমাদের ছেলেমেয়েরা শিক্ষিত হচ্ছে, কিন্তু নিয়োগকর্তা ঠিকানা দেখেই বাতিল করে দেন। কেননা তাঁরা মনে করেন, সুইপারের ছেলে সুইপার হবে।’
বাংলাদেশ দলিত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠী অধিকার আন্দোলনের সহসভাপতি মনি রানী দাস ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘তিন-চার লাখ টাকা ঘুষ দিতে পারি না বলে আমাদের ছেলেমেয়েরা চাকরি পায় না। আমার ছেলেরা শিক্ষিত হচ্ছে, কিন্তু দলিত কেন আমার পাশে বসবে—সমাজের মানুষের এ মনমানসিকতার পরিবর্তন হয়নি।’
পরিত্রাণের প্রকল্প সমন্বয়কারী বিকাশ কুমার দাস একটি জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত একটি খবরের কথা উল্লেখ করে বলেন, এক শিক্ষক শিক্ষার্থীকে বলেছেন, তোদের কাজ জুতা সেলাই করা, তোরা স্কুলে আসিস কেন?
বিকাশ কুমার দাস নিজের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘আমি ল পাস করেছি, কিন্তু অন্যরা বলে, তুমি ঋষির ছেলে, তুমি কি ক্লায়েন্ট পাবা?’
ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ভারতের মতো দেশেও একটি ‘ট্রাইবাল পলিসি’ তৈরি এবং সমতলের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জন্য আলাদা ভূমি কমিশন গঠন করতে হবে বলে মত দেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং।
আলোচনায় প্রিপ ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক আরমা দত্ত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমানের বিভিন্ন বিষয় দেখভালের জন্য ককাস গঠন, এই জনগোষ্ঠীকে অর্থনৈতিক কাজে সম্পৃক্ত করা এবং নিজেদের কথা নিজেরাই যাতে বলতে পারে, সে জন্য জাতীয় সংসদে এই জনগোষ্ঠীর জন্য আসন সংরক্ষণের সুপারিশ করেন।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালক (কার্যক্রম) আবু মোহাম্মদ ইউসুফ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য নেওয়া বিভিন্ন কাজে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন এনজিওকে সম্পৃক্ত করার দিকটিতে গুরুত্ব দেন।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জ্যেষ্ঠ রিসার্চ ফেলো নাজনীন আহমেদ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সুবিধাভোগীদের অনলাইন তালিকা প্রকাশ এবং দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য সরকারের প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে কোটা রাখার সুপারিশ করেন।
ডিএফআইডির উপদেষ্টা (পভার্টি অ্যান্ড সোশ্যাল প্রোটেকশন) নাভিদ আহমদ চৌধুরী দলিতসহ বিভিন্ন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মা ও শিশুদের পুষ্টির বিষয়টি নিশ্চিত করতে বিশেষ ভাতা চালুর সুপারিশ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাস্তবায়নের সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁরা যাতে অনিয়মের আশ্রয় না নিতে পারেন, সে জন্য রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন। তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই দেশের ভবিষ্যৎ নেতা, তাই এই শিক্ষার্থীদের মনমানসিকতা তৈরির বিষয়টিতে গুরুত্ব দিতে হবে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী রুহি নাজ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন অধিকার আদায়ে তথ্য অধিকার আইন ব্যবহারের বিষয়টিতে গুরুত্ব দেন।
নোয়াখালী রুরাল ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির প্রধান সমন্বয়কারী আবদুল আউয়াল সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সুবিধাভোগীদের জন্য একক নিবন্ধনব্যবস্থা করার সুপারিশ করেন।
এডিডি ইন্টারন্যাশনালের দেশীয় পরিচালক শফিকুল ইসলাম বলেন, সঠিক পরিসংখ্যান নেই বলেই বরাদ্দ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে না পৌঁছে অন্যদের কাছে চলে যাচ্ছে। সারা দেশে দলিত, হরিজন, ক্ষুদ্র জাতিসত্তাসহ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ম্যাপিং করার বিষয়টিতে গুরুত্ব দেন তিনি।