Thank you for trying Sticky AMP!!

বইপাড়া: একটি গল্পের খনি

ফাইল ছবি

কলেজ স্ট্রিট, একটি সড়ক। যে সড়ক তার বুকে নিজের নামের মতোই আগলে রেখেছে কলকাতার বিখ্যাত সব কলেজকে। আগলে রেখেছে কলকাতার সবচেয়ে শিক্ষিত, সৃষ্টিশীল মানুষগুলোকে।

প্রেসিডেন্সি কলেজ, হিন্দু কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা মেডিকেল কলেজ—সবগুলোই এই সড়কটি ওপর ঠায় দাঁড়িয়ে। এই কলেজগুলোকে কেন্দ্র করেই প্রায় দেড় কিলোমিটার সড়কজুড়ে গড়ে উঠেছে বইপাড়া। বিশ্বের সবচেয়ে বড় পুরাতন বইয়ের এই বাজারের প্রতিটি পরতে পরতে যেন গল্প।

বাংলা সাহিত্যের অনেক চরিত্র এই সড়কটির সঙ্গে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। এই সড়কে হাঁটতে হাঁটতে আপনি অনুভব করবেন ‘শেষের কবিতা’র অমিত-লাবণ্য, সুনীলের ‘কাকাবাবু’, শরবিন্দুর ‘ব্যোমকেশ’ কিংবা সমরেশের ‘অনিমেষ-মাধবীলতা’কে। হয়তো দেখলেন আপনার পাশে দাঁডিয়ে আছেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর হাত ধরে বই কিনতে এসেছে অপু-দুর্গা। আবার ধরুন সুচিত্রা ভট্টাচার্যের মিতিন মাসিও হাঁটছেন আপনার পাশে। হয়তো শুনতে পাবেন শক্তি চট্টোপাধ্যায় কিংবা শ্রীজাতের কোনো কবিতার চরণ।

কলেজ স্ট্রিটে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে দে’জ পাবলিশিং কিংবা বেঙ্গল পাবলিশার্সের মতো নামকরা সব প্রকাশনী। এই প্রকাশনীগুলোতে শুধু বই-ই ছাপানো হয় না, এখানে জন্ম হয় বাংলা ভাষার সেরা সাহিত্যিকদের। এখানে প্রকাশকদের সঙ্গে আড্ডায় মেতেছেন রবি ঠাকুর, বঙ্কিম বাবু, সত্যজিৎ থেকে শুরু করে সুনীল, সমরেশরা। হাল আমলের স্বরণজিত চক্রবর্তী, অনীশ দেবরাও হাঁটছেন একই পথে। আবার এই সড়কেই দেখা যায় বইয়ের পাণ্ডুলিপি নিয়ে প্রকাশকদের দরজায় কড়া নাড়া নতুন লেখকদের।

বইপাড়ার প্রতিটা দোকান, প্রতিটা বই, প্রতিটা পাতা একেকটা গল্প বলে। এ যেন লেখক-পাঠকদের জন্য পৃথিবীতে এক টুকরো স্বর্গ। এখানকার সবচেয়ে সুন্দর ব্যাপার হলো বইপাড়ার দোকানগুলো আলাদা করার জন্য ইট-পাথরের প্রয়োজন হয় না। বইয়ের সারি দিয়েই আলাদা করা হয় দোকানগুলো। এখানে যেমন একদম ছোট ছোট দোকান রয়েছে, তেমনি রয়েছে দাস গুপ্তা অ্যান্ড কোম্পানির মতো বিশাল আকৃতির বইয়ের দোকান। এই দোকানটিতে রয়েছে প্রায় দুই লাখেরও বেশি বই। অমর্ত্য সেন নাকি ছাত্রাবস্থায় এই দোকানে এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বই পড়তেন। নতুন-পুরোনো সব মিলিয়ে যেন এক বিশাল বইয়ের সমুদ্র এই বইপাড়া।

ফাইল ছবি

কলেজ স্ট্রিটে আসবেন অথচ কফি হাউসে এক কাপ চা খাবেন না, তা কী করে হয়! এই কফি হাউসসহ অন্য কেবিনগুলোয় একসময় আড্ডায় বসতেন বাঘা সব লেখক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যজিৎ রায়েরা এখানে বসে এক কাপ চা আর একটা সমুচা খাবেন না, তা ভাবা যায়? কলকাতার ইতিহাস, সংস্কৃতি, সাহিত্য, রাজনীতিকে লালন করে এই কেবিনগুলো। সুভাষ চন্দ্র বসুরা এখানে বসে এঁকেছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের ছক। তা ছাড়া নকশাল আন্দোলনেরও আঁতুড়ঘর এই কেবিনগুলো। সাহিত্য, সিনেমা, রাজনীতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের যুগ যুগ ধরে এভাবেই আগলে রাখছে এই কলেজ স্ট্রিট।

কলকাতার রসগোল্লা ভোজনরসিকদের জন্য যতটা প্রিয়, বাঙালি পাঠকদের জন্যও বইপাড়া ততটাই প্রিয়, ততটাই মিষ্টি। যদিও কিছুদিন আগে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের সঙ্গে লড়তে গিয়ে বিশাল ক্ষতি হয়েছে বইপাড়ার। ভিজিয়ে দিয়ে গেছে নতুন-পুরান অনেক অমূল্য বই। হয়তো এমন কিছু বই-ও নষ্ট হয়ে গেছে, যেগুলো শুধু বইপাড়াতেই পাওয়া যেত। তবে এই ঝড় বইপাড়ার শত বছরের ঐতিহ্য ছুঁতে পারে না। আবার কলেজ স্ট্রিটের সোডিয়াম বাতির নিচে রবি ঠাকুর, সমরেশরা হাঁটবেন। সুভাস চন্দ্র বসুরা আবার কোনো আন্দোলনের ছক করবেন, সত্যজিৎ রায়েরা নতুন কোনো সিনেমা বানাবেন।

আবার কলেজ স্ট্রিটের বুকের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা কলেজগুলোর শিক্ষার্থীর আনাগোনায় প্রাণ ফিরে পাবে বইপাড়া। কেননা, কলেজ স্ট্রিট শুধু একটা কথা বিশ্বাস করে। করব, লড়ব, জিতব। বইপাড়া আবার ফিরবে, কফি হাউসে আবার আড্ডা হবে, হবেই।

*লেখক: শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি