Thank you for trying Sticky AMP!!

বশীর চাচার সঙ্গে পথচলা

২০০৬ সালে গ্যালারি কায়ার আয়োজনে যমুনা আর্ট ক্যাম্পে শিল্পী মুর্তজা বশীর (মাঝে গোলাপি শার্ট পরা)। বাঁ থেকে শিল্পী রণজিৎ দাস, শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, শিল্পী কালিদাস কর্মকার (বসা), শিল্পী নিতুন কুন্ডু, শিল্পী আমিনুল ইসলাম, শিল্পী সমরজিৎ রায়চৌধুরী, শিল্পী হামিদুজ্জামান খান এবং শম্ভু আচার্য।

শিল্পী মুর্তজা বশীর। বশীর চাচা। তাঁর মৃত্যুর পর আমার পৃথিবী আরেকবার রিক্ত হয়ে গেল। ২০০৮ সালে বাবা দেবদাস চক্রবর্তীকে হারিয়ে যেমন শূন্য হয়ে গিয়েছিলাম, এখনো তেমনই মনে হচ্ছে। শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী আর মুর্তজা বশীর ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সেই সূত্রে তিনি আমার বশীর চাচা। বাবার মৃত্যুর পর থেকে তিনিই তো ছিলেন আমার অভিভাবক। তাঁকে হারিয়ে এখন কেবল স্মৃতি হাতড়াচ্ছি। একটার পর একটা স্মৃতিতরঙ্গ তুলছে মাথার ভেতরে।

১৯৭২ সাল। আমার বয়স তখন ৯ বছর। একদিন দেখলাম, আমাদের চট্টগ্রামের বাসায় বাবার পাশে সাংঘাতিক স্মার্ট একজন লোক বসে আছেন—অ্যাঙ্কেল বুট জুতা ও অফ হোয়াইট রঙের শার্ট পরা সেই মানুষটির বুকের অংশে লাল, নীল, হলুদ—এমন নানান রঙের অজস্র তালিতে ভরা। শার্টের ওই রংগুলো যেন জ্বলছে। তাঁকে দেখতে লাগছে সাক্ষাৎ সাহেবের মতো। প্যারিসফেরত সেদিনের সেই সাহেবই ছিলেন মুর্তজা বশীর।

বশীর চাচার সঙ্গে সেই আমার চেনাজানার শুরু। বিদেশ থেকে ফেরার পর দেবদাস চক্রবর্তীর আগ্রহেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছিলেন চাচা। পরে চাকরি ছেড়ে দিয়ে বাবা যখন ঢাকায় চলে এলেন, বশীর চাচা ঢাকায় এলে প্রায়ই সেন্ট্রাল রোডে আমাদের বাসায় উঠতেন। পরে বশীর চাচা ও তুলু চাচির (আমেনা বশীর) বিয়ের ঘটকও ছিলেন বাবা।

১৯৯২ সালে একক প্রদর্শনী করব বলে ঠিক করলাম। এর আগে একদিন ভাবলাম, বাবার বন্ধুবান্ধব—মুর্তজা বশীর, সাদেক খান, আমিনুল ইসলাম, নিতুন কুন্ডু—এঁদের আমার কাজ দেখাব। দেখালাম। পরে ওই দিন রাতে আমাদের বাসায় বাবা, বশীর চাচা ও আমি বসে আছি। হঠাৎই চাচা আমাকে বললেন, কাগজ–কলম দাও তো, তোমার পোর্ট্রেট আঁকি। কাকতালীয়ভাবে ওই দিন ছিল আমার জন্মদিন। সিঙ্গেল লাইনে আমার পোর্ট্রেট আঁকলেন তিনি। নিচে লিখলেন, ‘অন দ্য অকেশন টু গৌতম ইন হিজ বার্থডে।’

আমার প্রদর্শনীর দিন আমাকে একটি কথা বলেছিলেন বশীর চাচা, যেটি তাঁকে একসময় বলেছিলেন অগত্যা সম্পাদক ফজলে লোহানী। সেই কথা সেদিন আমার উদ্দেশে আবার চাচার মুখে শোনা গেল, ‘তোমার পায়ে রাবারের চপ্পল আর যশ ও খ্যাতি হলো পিছল
ধরা শেওলা রাস্তা। ঠিকমতো হাঁটতে না পারলে পড়ে যাবে।’

আমার মনে হয়, ভেতরে–ভেতরে এই কথা চাচা খুব মানতেন। বড় মাপের শিল্পী তিনি, কিন্তু আমৃত্যু ছিলেন অনুসন্ধানী। উঁচুতে উঠলেও সাধারণ মানুষ থেকে দূরে যাননি। খ্যাতি তাঁকে বন্দী করতে পারেনি কখনো।

২০০৪ সালে আমি যখন গ্যালারি কায়া শুরু করি, চাচার কাছে গেলাম। তিনি বললেন, ‘আমি তোমাকে ছবি দেব। তুমি দেবদাসের ছেলে। মানে আমারও ছেলে।’ ছেলের প্রতি বাবার তো কিছু কর্তব্য থাকে। সেই কর্তব্য তিনি বরাবর পালন করেছেন। গ্যালারির জন্য প্রথম যে ছবিটি তিনি আমাদের দিয়েছিলেন, তার নাম ‘ওম্যান’। গোলাপ ফুল হাতে দণ্ডায়মান এক নারী। অসাধারণ একটা কাজ। তারপর একে একে তাঁর অনেক প্রদর্শনী আমরা করেছি।

মুর্তজা বশীরের করা গৌতম চক্রবর্তীর পোর্ট্রেট

মনে আছে, উডকাট, এচিং, লিনো—অনেক আগে করা বশীর চাচার এসব কাজ নিয়ে একটা প্রদর্শনী করেছিলাম ২০০৭ সালে। ওই প্রদর্শনীতে ছিল তাঁর একটি পুরোনো ড্রয়িং, যেটি আর্ট কলেজে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় তিনি এঁকেছিলেন—সিঙ্গেল লাইনে করা একটি হাতের ড্রয়িং। তবে হাতের তর্জনীর জায়গায় লাল কালিতে কাটা দাগ দেওয়া ছিল। আর ছবিতে দেওয়া ছিল কিছু কারেকশনও। শিল্পাচার্য
জয়নুল আবেদিন তাঁর ছাত্র মুর্তজা বশীরের ড্রয়িংয়ে এই কারেকশনগুলো দিয়েছিলেন। তো সেই ছবি আমি যখন প্রদর্শনীতে
রাখতে চাইছি, চাচা বললেন, ‘এটা তো আমার খুব প্রথম দিককার ছবি, প্রদর্শনীতে তুমি এটা কেন রাখতে চাও?’ তাঁকে বললাম, আপনি সিঙ্গেল লাইন ড্রয়িংয়ের মাস্টার। কীভাবে কঠোর অনুশীলনের মধ্য দিয়ে দিনে দিনে আপনি তৈরি হয়েছেন, এখানে তার চিহ্ন ধরা আছে। বিনা বাক্যে সেদিন আমার কথা মেনে নিয়েছিলেন বশীর চাচা।

স্বভাবে মুর্তজা বশীর ছিলেন খুব মুডি। তবে তাঁর মধ্যে যুক্তিবোধ ছিল প্রবল। যুক্তি দিয়ে কথা বললে মানতেন। সব সময়ই তাঁর ভেতরে থইথই করত তারুণ্য। তরুণদের বিশেষ মূল্যও দিতেন তিনি। বারবার বলতেন, কোন শিল্পী আমার ছবিকে কীভাবে নিচ্ছে, তার চেয়েও বড় বিষয় হলো তরুণেরা আমার ছবি পছন্দ করছে কি না। তাঁর শিল্পীজীবনের দিকে তাকালেও দেখা যাবে, তরুণ চিত্রকরের মতোই বারবার নিজের ছবিতে ভাঙা–গড়ার খেলা খেলেছেন মুর্তজা বশীর। ক্রমাগত পরীক্ষা–নিরীক্ষা করেছেন। যে কারণে একই বিষয়, ধারা ও করণকৌশলে কখনোই আঁকেননি তিনি।

গ্যালারি কায়ার প্রথম দিকে এক প্রদর্শনীর সময় হঠাৎ তিনি আমাকে বললেন, ‘তুমি আমার ছবির দাম এত কম রাখছ কেন?’ তাঁকে বললাম, চাচা, আপনাকে নিয়ে আমি দীর্ঘ একটা জার্নি করতে চাই। আমাদের সৌভাগ্য, গ্যালারি কায়া মুতর্জা বশীরের শিল্পীযাত্রার সঙ্গী হয়ে প্রায় দেড় যুগ চলতে পেরেছে।

সম্ভবত ২০১৩ সালে প্রথমবারের মতো অসুস্থ হয়ে আইসিইউতে গেলেন বশীর চাচা। তারপর থেকে অনেকবারই অসুস্থ
হয়েছেন। প্রতিবার লড়াই করে ফিরেও এসেছেন। পরে একসময় চাচা আমাকে নিজেই বলেছিলেন, অসুস্থ হয়ে আইসিইউতে গিয়ে কয়েকবারই তাঁর মনে হয়েছিল, তলিয়ে যাচ্ছেন তিনি। তখনই স্রষ্টাকে বলেছেন,‘আল্লাহ, আমাকে এখনই নিয়ো না, আমার কিছু কাজ বাকি আছে।’

এবারও যখন তিনি হাসপাতালে গেলেন, ভেবেছিলাম, বরাবরের মতো ফিরে আসবেন। কারণ, তিনি তো লড়াকু। কিন্তু এবার আর ফিরলেন না। তাঁর চলে যাওয়ার খবর শোনার পর থেকে একটা কথাই বারবার মনে হচ্ছে, সেই ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে শিল্পী হিসেবে
যে মুর্তজা বশীরের উত্থান, তাঁর বহুবিস্তৃত শিল্পযাত্রার বহুমাত্রিকতা বুঝতে আমাদের আরও সময় লাগবে।

লেখক: চিত্রশিল্পী ও পরিচালক, গ্যালারি কায়া