Thank you for trying Sticky AMP!!

বাল্যবিয়েমুক্ত হবে ময়মনসিংহ

প্রতীকী ছবি

গত ২৩ আগস্ট রাতে ভালুকার বগাজান ও বিরুনীয়া গ্রামে দুটি বাল্যবিবাহের আয়োজন করা হয়েছিল। বিরুনীয়া গ্রামে রাত নয়টার দিকে বিয়ের আয়োজন চলছিল। কনে স্থানীয় একটি দাখিল মাদ্রাসার দশম শ্রেণির ছাত্রী। দাখিল পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন কার্ডে উল্লেখিত জন্মতারিখ অনুযায়ী তাঁর বয়স ছিল ১৭ বছর ৬ মাস। বর পাশের গোয়ারী গ্রামের আবুল হোসেনের ছেলে সোহেল।

গোপন তথ্যের ভিত্তিতে বিয়েবাড়িতে পুলিশসহ উপস্থিত হন ভালুকা উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) রোমেন শর্মা। তাঁদের উপস্থিতি টের পেয়ে বরযাত্রীরা পালিয়ে যান। কনে অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় বিয়ের আয়োজন বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর কনের মাসহ স্থানীয় কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তির কাছ থেকে মেয়ের বয়স ১৮ বছর না হওয়া পর্যন্ত বিয়ে দেওয়া হবে না বলে মুচলেকা নেওয়া হয়।

ওই রাতেই সাড়ে ১১টার দিকে উপজেলার মেদুয়ারী ইউনিয়নের বগাজান গ্রামে বিয়ের আয়োজন চলছিল। কনে স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছে। এক বছর ধরে পড়ালেখা বন্ধ করে বাড়িতেই থাকে। পরিবারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী তার বয়স হয়েছিল ১৫ বছর। গোপন তথ্যের ভিত্তিতে বিষয়টি জানতে পেরে বিয়েবাড়িতে পুলিশ পাঠিয়ে সেই বিয়েও বন্ধ করে দিতে সক্ষম হয় ভালুকা উপজেলা প্রশাসন।

জেলায় এমন আরও শতাধিক ঘটনা ঘটেছে। এ অবস্থায় বাল্যবিবাহ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে তা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়। এ লক্ষ্যে আগামী ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিন হতে ময়মনসিংহ বিভাগকে বাল্যবিবাহমুক্ত ঘোষণা করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে প্রশাসন। সম্প্রতি ময়মনসিংহের নান্দাইল, ভালুকা, ঈশ্বরগঞ্জসহ জামালপুর, শেরপুর, নেত্রকোনা জেলার বেশ কয়েকটি উপজেলায় বাল্যবিবাহের ব্যাপক প্রবণতা দেখা দেয় এবং এগুলোর অধিকাংশই স্থানীয় লোকজন ও প্রশাসনের সহায়তায় রোধ করা সম্ভব হয়েছে। এরপরও অনেক স্থানে চুপিসারে কিছু বাল্যবিবাহের ঘটনা এখনো ঘটে চলেছে। তাই বিভাগীয় প্রশাসন এখন থেকে কঠোর ভূমিকায় মাঠে নামতে যাচ্ছে।

মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর ময়মনসিংহ কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরে ময়মনসিংহ জেলায় মোট ৯৭টি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ৪ মাসে সবচেয়ে বেশি ৪৯টি প্রতিরোধের ঘটনা ঘটে। পরের ৩ মাসে সেই সংখ্যা ১২–তে নেমে এলেও আবার আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর—এ ৩ মাসে আরও ৩৬টি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের ঘটনা ঘটেছে। তবে এটি শুধু মহিলা অধিদপ্তরের তথ্য, এর বাইরেও উপজেলা প্রশাসন ও বিভিন্ন এনজিও পৃথকভাবে বেশ কয়েকটি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করেছে বলে জানিয়েছেন মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের উপপরিচালক দিলখোশ জাহান।

১৯ নভেম্বর বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে মুজিববর্ষ উদ্‌যাপন সামনে রেখে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধসংক্রান্ত একটি মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। বিভাগীয় কমিশনার খোন্দকার মোস্তাফিজুর রহমানের সভাপতিত্বে এ সভায় ডিআইজি নিবাস চন্দ্র মাঝি, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ইউসুফ খান পাঠান, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জহিরুল হক, সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের কর্তাব্যক্তি ছাড়াও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান, কাজি, মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিকেরা উপস্থিত ছিলেন। প্রত্যেকেই বিভিন্ন পরামর্শ ও সুপারিশ দিলে সেগুলো লিপিবদ্ধ করা হয় এবং সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় সামনের ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিন থেকে ময়মনসিংহ বিভাগকে বাল্যবিবাহমুক্ত ঘোষণা করার।

বাল্যবিবাহ বন্ধে দেওয়া পরামর্শ ও সুপারিশগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল প্রতিটি ইউনিয়নে বাল্যবিবাহ নিরোধ কমিটি গঠন, একটি করে ফান্ড গঠনের মাধ্যমে দরিদ্র পরিবার ও কন্যাদায়গ্রস্ত বাবাদের অর্থ সহায়তা, আইনের কঠোর প্রয়োগ, অভিভাবক সচেতনতা বৃদ্ধি, প্রচারপত্র ও স্টিকার বিলি, বিবাহ নিবন্ধন বাধ্যতামূলক, অনিবন্ধিত কাজিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আলোচনা, প্রশাসনিক সেল গঠন ও মাসিক উন্নয়ন সভায় এ–সংক্রান্ত পর্যালোচনা ও জেলা পর্যায়ে কাজি সম্মেলন করার মাধ্যমে তাঁদের সাবধান করা।

এর আগে গত ৩১ অক্টোবর ময়মনসিংহ বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের সম্মেলনকক্ষে একটি মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়েছিল। সেই সভায় বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্বে ময়মনসিংহ বিভাগের ৩৫টি উপজেলার ইউএনওরা অংশ নেন। বিভাগীয় কমিশনার খোন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান সব উপজেলার শীর্ষ কর্মকর্তাদের বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে বিশেষ নির্দেশনা দেন।

সভায় উপজেলার প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও অন্য সংগঠনের মাধ্যমে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের আন্দোলন জোরালো করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এই মতবিনিময় সভায়। নভেম্বরজুড়ে ময়মনসিংহ বিভাগের প্রতিটি এলাকাতেই বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে ক্যাম্পেইন চালানোর নির্দেশনা দেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন মাধ্যমে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধসংক্রান্ত প্রচারণা চালানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে প্রতিটি উপজেলার শিক্ষক, মসজিদের ইমাম, মন্দিরের পুরোহিত, সাহিত্যিক, জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতা ও সামাজিক সংগঠনগুলোর নেতাদের সম্পৃক্ত করে সমাজের উন্নয়নে সবাইকে একসঙ্গে বাল্যবিবাহ বন্ধে কাজ করতে আহ্বান জানানো হয়।

 বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের উদ্যোগ গ্রহণ সম্পর্কে বিভাগীয় কমিশনার খোন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাল্যবিবাহ একটি সামাজিক ব্যাধি এবং এর প্রভাবে সমাজে বিভিন্ন ধরনের অসংগতি তৈরি হচ্ছে। আর কোনো কিশোর-কিশোরী যেন বাল্যবিবাহের শিকার না হয়, সে জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে কঠোর নজরদারি করা হবে। এ ছাড়া বাল্যবিবাহের কুফল ও ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে প্রচারণা চালানো হবে এবং দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষকে সচেতন করা হবে।

[ভালুকার তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ভালুকা প্রতিনিধি মাহমুদুল হাসান]