Thank you for trying Sticky AMP!!

বিদেশগামীদের অর্ধেকই অদক্ষ শ্রমিক

জমি বিক্রি করে ১২ লাখ টাকা দালালদের হাতে তুলে দিয়ে রাজবাড়ীর ছেলে কবির খান মাস চারেক আগে যখন সৌদি আরবে পা রাখেন, তখন কোনো পেশাতেই তাঁর বিন্দুমাত্র দক্ষতা ছিল না। তাঁকে সৌদি আরবে পাঠানো হয়েছিল পরিচ্ছন্নতাকর্মীর চাকরি দেওয়ার নাম করে। গিয়ে দেখেন, তার জন্য কোনো চাকরি অপেক্ষা করছে না। কারণ তিনি কিছুই পারেন না। অনেক কষ্টে দেশি এক ‘ভাইয়ের’ দোকানে ফাইফরমাশ খাটার কাজ জুটিয়ে নিয়েছেন।

বাংলাদেশ থেকে যাওয়া প্রবাসীদের একটা বড় অংশেরই দশা কবিরের মতো। কোনো ধরনের দক্ষতা ছাড়াই বিদেশে পাড়ি জমান তাঁরা। ফলে তাঁদের খুবই নিম্ন মজুরির কায়িক শ্রমের কাজ জোটাতে হয়।
সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্য অনেক দিন ধরেই বিদেশগামীদের দক্ষতা বাড়ানোর কথা বলা হচ্ছে। দক্ষতা বাড়ানোর জন্য ২০১১ সালে জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতিও করা হয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতির কোনো হেরফের হয়নি।

প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে বিদেশে শ্রমিকদের পাড়ি জমানোর পরিমাণ ক্রমাগত বাড়লেও এসব শ্রমিকের অর্ধেকই অদক্ষ।

অন্যদিকে নতুন শ্রমবাজার খুঁজে না পাওয়ায় এখনো মধ্যপ্রাচ্যের প্রচলিত বাজারগুলোই বাংলাদেশিদের গন্তব্য। কিন্তু সেখানে তেলের দাম কমে যাওয়ায় অর্থনৈতিক মন্দায় চরম বিপাকে আছেন প্রবাসীরা। তাই গত আট বছরের মধ্যে ২০১৬ সালে প্রবাসী আয় কমেছে।

এমন পরিস্থিতির মধ্যেই আজ ১৮ ডিসেম্বর সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস। এ বছর দিবসটির স্লোগান ‘উন্নয়নের মহাসড়কে, অভিবাসীরা সবার আগে’।

প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী নুরুল ইসলাম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, শ্রমিকদের দক্ষতা বাড়াতে নানা রকম কারিগরি প্রশিক্ষণ কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। আগে জেলা পর্যায়ে শুধু কারিগরি প্রশিক্ষণকেন্দ্র ছিল। দক্ষতা বাড়ানোর জন্য এখন উপজেলা পর্যায়ে প্রশিক্ষণকেন্দ্র চালুর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে ৪০টি কেন্দ্র নির্মাণের কাজ শুরু হওয়ার পথে।

৫০ শতাংশই অদক্ষ

বাংলাদেশ থেকে যাঁরা বিদেশে যান, তাঁদের তথ্য থাকে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোতে (বিএমইটি)। ১৯৭৬ সাল থেকে চলতি বছরের ১৪ ডিসেমম্বর পর্যন্ত ১ কোটি লোক বিদেশে গেছেন। তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এ পর্যন্ত যাঁরা বিদেশে গেছেন, তাঁদের ৪৯ দশমিক ৬৫ শতাংশই অদক্ষ। অবশ্য বিএমইটি কাগজে-কলমে তাঁদের ‘লেস স্কিলড’ বা কম দক্ষ বলে উল্লেখ করেছে। বাকি ৫০ শতাংশের মধ্যে ১৫ শতাংশ আধা দক্ষ (সেমি স্কিলড) এবং ৩১ শতাংশকে দক্ষ (স্কিলড) বলে উল্লেখ করা হয়েছে।আর বিদেশগামীদের মধ্যে মাত্র আড়াই শতাংশ আছেন যাঁরা পেশাদার।

২০১৫ সালের পুরো বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ওই বছর বিদেশে যাওয়া ৫ লাখ ৫৫ হাজার ৮৮১ জনের মধ্যে মাত্র ১ হাজার ৮২৮ জন পেশাদার ছিলেন। মোটামুটি দক্ষ ছিলেন ২ লাখ ১৪ হাজার ৩২৮ জন। আর ২ লাখ ৪৩ হাজার ৯২৯ জন, অর্থাৎ প্রায় ৪৩ শতাংশই অদক্ষ।

দক্ষতা বাড়াতে প্রশিক্ষণ

বিএমইটির আওতায় বর্তমানে সারা দেশে ৭০টি কারিগরি প্রশিক্ষণকেন্দ্র রয়েছে। তবে এসব প্রশিক্ষণের মান নিয়ে প্রশ্ন আছে। আবার এখান থেকে সনদ নিয়ে বের হলেও সবাই বিদেশে যেতে পারেন না, কারণ সেখানে এখনো মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য।

প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বিএমইটি ও কারিগরি প্রশিক্ষণকেন্দ্র (টিটিসি) থেকে প্রতিবছর গড়ে ৬০ থেকে ৭০ হাজার ছেলেমেয়ে নানা ধরনের সনদ নিয়ে বের হচ্ছেন, কিন্তু তাঁদের মধ্যে কতজন বিদেশে যেতে পারছেন, সেই তথ্য তাদের কাছে নেই। এমনকি দক্ষতাভিত্তিক ডেটাবেজ করে সেখান থেকে বিদেশে লোক পাঠানোর কথা থাকলেও সরকার সেই উদ্যোগ নিতে পারেনি।

ঝুঁকিপূর্ণ কাজ শুধু বাংলাদেশিদের জন্য

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) বিদেশগামীদের দক্ষতা নিয়ে ২০১৪ সালে একটি গবেষণা করে। তাতে দেখা গেছে, দক্ষ লোকজনের সংখ্যা খুবই কম। বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি কর্মী সৌদি আরবে গেছেন ২০০৭ সালে। ওই বছর যাওয়া ২ লাখ শ্রমিকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২৫ হাজারই গেছেন পরিচ্ছন্নতা কর্মী হিসেবে। আর ১ লাখ ২৫ হাজার ৬৫০ জন গেছেন সাধারণ শ্রমিক হিসেবে। অর্থাৎ তাঁরাও অদক্ষ। দক্ষ নির্মাণশ্রমিক হিসেবে গেছেন মাত্র ৫ হাজার ২৮৫ জন।

বর্তমানে সৌদি আরবে যাঁরা যাচ্ছেন, তাঁদের ৭০ শতাংশই নারী। তাঁরা সবাই যাচ্ছেন গৃহকর্মী হিসেবে।

অভিবাসনবিষয়ক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ওয়্যারবির চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুল হক প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ থেকে যেসব শ্রমিক যান, তাঁরা মূলত ঝুঁকিপূর্ণ কায়িক শ্রমের কাজগুলো করেন। এর কারণ বাংলাদেশিদের দক্ষতা ও ভাষাজ্ঞানের অভাব। তা ছাড়া তাঁদের কোনো চুক্তিপত্র থাকে না।

 জানতে চাইলে বিএমইটির মহাপরিচালক সেলিম রেজা প্রথম আলোকে বলেন, ‘যাঁরা বিদেশে যাচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে অদক্ষরাই সবচেয়ে বেশি। আমরাও বুঝতে পারছি, দক্ষতার উন্নয়নই এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ। কারণ অদক্ষ লোকের বিদেশে যেতে খরচ বেশি হয়। কিন্তু তাঁরা আয় কম করেন। আর দক্ষ লোকের যেতে খরচ হয় কম, অথচ তাঁরা আয় করেন বেশি।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ সাম্প্রতিক প্রবাসী আয় কমে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশের শ্রমবাজার মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক। এর বাইরে নতুন বাজার খোঁজা উচিত। আর দক্ষ লোক পাঠানোর দিকে নজর দেওয়া উচিত।’

অভিবাসীবিষয়ক গবেষণা সংস্থা রামরুর চেয়ারপারসন তাসনিম সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, ‘দক্ষতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। এ কারণে সমন্বিত পরিকল্পনা নেওয়া প্রয়োজন। আর কর্মঘণ্টা, বেতন, সুরক্ষাসহ অনেক সমস্যা আছে, যেগুলো একা বাংলাদেশের পক্ষে সমাধান করা সম্ভব নয়। এ জন্য দ্বিপক্ষীয়র চেয়েও আন্তর্জাতিকভাবে বেশি জোর দিতে হবে।’

মন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন

আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস উপলক্ষে গতকাল দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী নুরুল ইসলাম পদে পদে প্রবাসীদের হয়রানির অভিযোগ প্রসঙ্গে বলেন, ‘দূতাবাসগুলো নিয়ন্ত্রণ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বিমানবন্দরও আমাদের এখতিয়ারে নয়। তারপরও আমরা সবাইকে নির্দেশনা দিয়েছি কোথাও যেন প্রবাসীরা হয়রানির শিকার না হন। এ জন্য প্রয়োজনে নজরদারি করা হবে। দেশে তাঁদের সম্পদ বা বাড়িঘর দখল হয়ে যাচ্ছে এমন অভিযোগ পেলেও আমরা ব্যবস্থা নেব।’