Thank you for trying Sticky AMP!!

বিদেশি পত্রিকায় একুশে

বিদেশি পত্রিকায় ভাষা আন্দোলন

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সংবাদ তখন শুধু এখানকার বা পাশের দেশ ভারতের পত্রিকাতেই নয়, বিশ্বের বেশ কিছু নামকরা পত্রিকায় সংবাদ ও সংবাদ ভাষ্যসহ ছাপা হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক টাইমস ছাড়াও ব্রিটেনের কিছু পত্রিকা যেমন টাইম, ওয়েস্টার্ন মেইল, ল্যাঙ্কেস্টার মেইল সেই সংবাদ ছেপেছে। বিশেষ করে নিউইয়র্ক টাইমস সংবাদের পাশাপাশি পর্যালোচনায় বলেছে, পূর্ব পাকিস্তানের এই অশান্তির কারণ শুধু ভাষা নয় বরং আর্থিক শোষণ এবং নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা। পূর্ব পাকিস্তানের উৎপাদিত পাটই পাকিস্তানের মূল বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের উৎস ছিল অথচ এই প্রদেশের জন্য বাজেটে অর্থ বরাদ্দ ছিল অপ্রতুল। তা ছাড়া পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রাও পশ্চিমে পাচার হতো। পশ্চিম পাকিস্তানিরা এই আন্দোলনের জন্য বিদেশি এবং কমিউনিস্টরা দায়ী বলে অভিযোগ তুলতে থাকে।

পাকিস্তানের শাসকেরা যে আমাদের বাংলা ভাষাকে একটি রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নেবে না, তা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে দেশটির গণপরিষদ। রয়টার্স পরিবেশিত সে সংবাদটি ছাপা হয় ১৯৪৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারির নিউইয়র্ক টাইমসে। শিরোনাম ছিল ‘উইল নট ইউজ বেঙ্গলি’ (‘বাংলা ব্যবহার করবে না’)। এতে বলা হয়, ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে দাপ্তরিক ভাষায় মেনে নেওয়ার প্রস্তাব গণপরিষদে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে, যদিও পাকিস্তানের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ বাংলায় কথা বলে।

১৯৫২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি করাচি থেকে নিউইয়র্ক টাইমস-এর বিশেষ সংবাদদাতা লেখেন, ‘ইস্ট পাকিস্তান পেপার ইজ ব্যান্ড বাই রেজিম’ (‘পূর্ব পাকিস্তানে সংবাদপত্র প্রকাশে শাসকের নিষেধাজ্ঞা’)। খবরে বলা হয়, খাজা নাজিমুদ্দিনকে আক্রমণ করে ভাষা আন্দোলন নিয়ে সম্পাদকীয় লেখায় আগের রাতে পূর্ব পাকিস্তান সরকার ঢাকার ইংরেজি দৈনিক দ্য পাকিস্তান অবজারভার-এর প্রকাশনা বন্ধ ঘোষণা করে। পুলিশ প্রকাশক হামিদুল হক চৌধুরী ও সম্পাদক আবদুস সালামকে গ্রেপ্তার করলেও পরে মুক্তি দেয়। সংবাদের পরের অংশে বলা হয়, ‘ক্রিপ্টো ফ্যাসিজম’ (‘গুপ্ত ফ্যাসিবাদ’) শিরোনামে সম্পাদকীয় লেখার জন্যই ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে পত্রিকাটি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। সংবাদটি একই দিনে ইংল্যান্ডের ল্যাঙ্কেস্টার ইভনিং মেইল পত্রিকাতেও ছাপা হয়।

২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় মিছিলে গুলি হলে ২২ ফেব্রুয়ারি করাচি থেকে নিউইয়র্ক টাইমস–এর সংবাদদাতা যে সংবাদ পাঠান, তার শিরোনাম ছিল ‘সিক্স স্লেইনিন টু–ডে রায়টিং ইন ইস্ট পাকিস্তান’ (‘পূর্ব পাকিস্তানে ২ দিনের দাঙ্গায় নিহত ৬’)। প্রতিবেদনে বলা হয়:

গতকাল ২২ ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে ঢাকা থেকে পাওয়া ঘটনার সংবাদকে করাচিতে সংশোধন করে প্রকাশ করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের সরকার গতকাল সকালে এক প্রেসনোটে জানায়, ৭ হাজার ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশের লাঠি ও রিভলভারের আক্রমণে ঘটনাস্থলে একজন নিহত হয় এবং দুজন আহত হয়ে পরে মারা যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর চৌধুরী মোহাজ্জান হোসেইন (সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেইন) বলেন, আজ ছাত্ররা শান্তিপূর্ণ ছিল এবং মেডিকেল কলেজের মাঠে অবস্থান করছিল, সেখানে এই ঘটনা ঘটে। সরকার দাবি করছে, ১৮ জন আহত হয়েছে। ছাত্রদের দাবি ছয়জন গুলিবিদ্ধ হয়েছে এবং আহত ৪০ জনকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।

ছাত্ররা ঘোষণা করেছে, তারা আজ একটি স্মরণ বিক্ষোভ ও ৪০ দিনের শোক পালন করবে। পূর্ব পাকিস্তানের রেডিও শিল্পীরা অনুষ্ঠান করতে অস্বীকার করেন এবং গতকাল বিকেলে বেশির ভাগ পূর্ব পাকিস্তানের সাংসদ “পুলিশি বর্বরতার” প্রতিবাদে পার্লামেন্ট থেকে বের হয়ে আসেন।

গত সপ্তাহে একটি বহুল প্রচারিত ইংরেজি সংবাদপত্র বাতিলের পর পূর্ব পাকিস্তানে সমস্যা দানা বাঁধতে থাকে।

ব্রিটেনের ওয়েস্টার্ন মেইল ২৩ ফেব্রুয়ারি রয়টার্স পরিবেশিত একটি সংবাদ প্রথম পাতায় ছাপে। তাতে পুলিশের গুলিতে ৮ বছর বয়সী এক বালকের মৃত্যুর খবর ছাপা হয়। একই সঙ্গে দুই দিনে পুলিশের গুলিতে মোট ৬ জনের মৃত্যুর খবর দেওয়া হয়।

‘ট্রুপস কলড আউট টু এন্ড ঢাকা রায়ট: ইস্ট পাকিস্তান ক্যাপিটাল সিজ অ্যানাদার ডে অব ভায়োলেন্স—নিউজপেপার অফিস বার্নড’ (‘ঢাকার দাঙ্গা বন্ধে সেনা তলব: পূর্ব পাকিস্তানে আরও এক দিন সহিংসতা, সংবাদপত্র অফিসে আগুন), এই শিরোনামে ২৪ ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্ক টাইমস আরেকটি সংবাদ প্রকাশ করে। করাচি থেকে নিউইয়র্ক টাইমস-এর বিশেষ সংবাদদাতার পাঠানো এ খবরে বলা হয়:

পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় সহিংসতা দমাতে পুলিশ বাহিনীকে সহায়তা করতে সেনা ইউনিট ডাকা হয়েছে। গতকাল আরও গুলি ও সহিংসতা এবং একটি সংবাদপত্র অফিস পোড়ানো হলে সেনা ডাকা হয়। একটি বিশ্বস্ত কিন্তু অসমর্থিত খবরে বলা হয়, আরও পাঁচ ব্যক্তি আহত হয়েছেন।

গতকালের ঘটনাসহ মোট নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮ জন এবং আহত হয়েছেন ১০০ জনের বেশি।

পুলিশের কার্যকলাপের প্রতিবাদে গতকাল একটি সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। পুলিশ সব মোটরগাড়ি ও কিছু বাস রিকুইজিশন করেছে এবং রাত ১০টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত সান্ধ্য আইন জারি করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে গতকাল জনতা ঢাকা মর্নিং নিউজ-এর অফিস জ্বালিয়ে দিয়েছে। সংবাদপত্রটির মালিক খাজা নুরুদ্দিন। তিনি প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের ভগ্নিপতি।

গতকাল পূর্ব পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ বাংলাকে উর্দুর পাশাপাশি দাপ্তরিক ভাষা করার সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেছে। করাচি সরকার কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ হারাবে কারণ বাংলাকে তারা রাষ্ট্রভাষা করার বিরোধিতা করছিল। সাধারণভাবে মনে করা হয়, বিদেশিরা পাকিস্তানকে অশান্ত করতে সাম্প্রতিক সহিংসতায় ভাষা সমস্যাকে ব্যবহার করছে।

২৫ ফেব্রুয়ারি করাচি থেকে পাঠানো নিউইয়র্ক টাইমস-এর বিশেষ সংবাদদাতা মাইকেল জেমসের প্রতিবেদনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সেটির শিরোনাম ‘ডিজঅর্ডার্স এন্ডেড ইন পাকিস্তান: করাচি হিন্টস ইন্ডিয়ান সাপোর্ট দ্য আউটব্রেকস—ডিসকন্টেন্ট ওভার বাজেট ইজ ফ্যাক্টর’ (‘পূর্ব পাকিস্তানে বিশৃঙ্খলার সমাপ্তি: ঘটনার জন্য করাচির ভারতীয় সমর্থনের প্রতি ইঙ্গিত— অসন্তোষের হেতু বাজেট’)।

খবরটির সংক্ষিপ্ত অনুবাদ এ রকম:

তিন দিনের সহিংসতার পর পূর্ব পাকিস্তানে অস্বস্তিকর শান্তি নেমে এসেছে। সরকার আভাস দিয়েছে, এ আন্দোলন হয়েছে বিদেশি প্ররোচনায়। বিদেশি বলতে এখানে ভারতকে বোঝানো হয়েছে। এদিকে গভর্নর জেনারেল পূর্ব পাকিস্তানের আইনসভাকে বাতিল করেছেন। আইনসভা প্রদেশের নাজুক প্রাদেশিক বাজেট সংকট নিয়ে আলোচনা করতে যাচ্ছিল।

পর্যবেক্ষকেরা মনে করছেন, গত সপ্তাহে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা নিয়ে আন্দোলনের শুরু কেবল ভাষার জন্য নয়, প্রাদেশিক বাজেট নিয়েও সংকট ছিল।

পাকিস্তানের সব পাট পূর্ব পাকিস্তানে জন্মায়। পাট তাদের প্রধান রপ্তানি পণ্য। পাটের আয়ের কারণেই পাকিস্তানের অর্থনীতি ভালো অবস্থানে। অথচ পাট থেকে যে রাজস্ব আয় হয়, তা নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানে।

অনুপাতহীন হিস্যা

পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা মনে করে, পাকিস্তানের রপ্তানি থেকে যে আয় হয়, তাতে তাদের আরও বেশি হিস্যা পাওয়া উচিত। গত সপ্তাহে পূর্ব পাকিস্তান সরকার ঘোষিত ঘাটতি বাজেটে দেখা গেছে, করাচির কেন্দ্রীয় সরকারের বরাদ্দ করা বাজেট দিয়ে তাদের প্রয়োজন মেটানো সম্ভব নয়।

প্রতিবেদনটির পরের অংশ এ রকম:

চট্টগ্রামে তিনজন সন্দেহভাজন বিদেশিকে আপত্তিকর কাগজপত্র বিতরণের সময় আটক করা হয়, সরকারি তথ্যে তাদের পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি।

সন্দেহভাজন কলকাতা উৎস

এটি বিশ্বাস করা হয়, কলকাতার বন্ধ হওয়া পাটকলগুলো পাটের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের এই আন্দোলনে অর্থ জোগান দিচ্ছে। সাম্প্রতিক আন্দোলন নিয়ে পাকিস্তানের সরকার ভীত। তারা মনে করে, পূর্ব পাকিস্তান ভারতের পশ্চিম বাংলার সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার মানসিকতা জন্ম নিতে পারে।

করাচিতে এটি মনে করা হয়, পাকিস্তানের উন্নয়ন পূর্ব পাকিস্তান ছাড়া চলতে পারে না
এবং এই আন্দোলন যেভাবেই হোক সফল হয়েছে। এটা নিশ্চিত যে অচিরেই বাংলা দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করবে এবং করাচি তাদের দূরবর্তী প্রদেশের জন্য আর্থিক সহায়তার পুনর্বিন্যাস করবে।

নিউইয়র্ক টাইমস-এর আগের প্রতিবেদনগুলো করাচি ও দিল্লি থেকে পাঠানো হলেও ১০ মার্চের খবরটি এর বিশেষ সংবাদদাতা মাইকেল জেমস পাঠিয়েছিলেন ঢাকা থেকে। সেটি ছাপা হয় ১১ মার্চ। পশ্চিমা বিশ্বজুড়ে তখন কমিউনিস্ট আতঙ্ক। কমিউনিস্ট বোঝাতে সে সময় ব্যবহৃত হতো ‘লাল’ শব্দটি। খবরটির শিরোনাম ছিল ‘রেড ডেন্​জার ইন ইস্ট পাকিস্তান: বেঙ্গল প্রিমিয়ার ফোরসিজ নিউ ট্রাবল, দো রিসেন্ট আউটব্রেকস অয়ার কার্বড’ (পূর্ব পাকিস্তানে লাল ঝুঁকি: বাংলা প্রদেশে নতুন সংকটের আশঙ্কা, তবে সাম্প্রতিক বিক্ষোভ দমন করা হয়েছে’)।

সংবাদটির সংক্ষিপ্ত অনুবাদ এমন:

সরকারি কর্মকর্তা ও বিদেশি পর্যবেক্ষকেরা মনে করেন, কমিউনিস্টদের প্রত্যক্ষ প্ররোচনায় ২১ থেকে ২৩ ফেব্রুয়ারি যে সহিংসতা হয়েছিল, পাকিস্তান তা সাফল্যের সঙ্গে মোকাবিলা করতে পেরেছে।

উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা না করায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জটিলতার সূত্রপাত। সবাই সাধারণভাবে একমত, সেটি ছিল একটি অরাজনৈতিক আন্দোলন। কিন্তু কমিউনিস্টরা তাদের কলাকৌশল প্রয়োগ করে আন্দোলনকে সাংঘর্ষিক করে তোলায় শান্তিপূর্ণ আন্দোলনটি সহিংসতায় রূপ নেয়। ফলে বহু মানুষ প্রাণ হারায়।

আরও ঝামেলার আশঙ্কা

দেশভাগের সময় বাঙালিদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা খুব খারাপ ছিল। মেধাবী হিন্দুরা বেশির ভাগই ভারতে চলে গেলে স্থানীয় মেধাবীদের অভাবে সেসব জায়গায় পশ্চিম পাকিস্তানিদের নিয়োগ দেওয়া হয়।

বাংলা ও উর্দু ভাষা নিয়ে অসন্তোষ দীর্ঘদিন ধরে চলছিল। তবে ‘কারও পছন্দ হোক বা না হোক, উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা,’ ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিনের এ ঘোষণার পর আগুন জ্বলে ওঠে।

আবদুল্লাহ জাহিদ: কুইন্স লাইব্রেরি রলিস, নিউইয়র্ক শাখার ব্যবস্থাপক