Thank you for trying Sticky AMP!!

বিদেশ গমন বনাম টমেটো চাষ

টমেটো বা সবজি চাষ করে নিজে স্বাবলম্বী হওয়া যায়। ছবি: সংগৃহীত

২০১৮ সালের প্রথম ৮ মাসে প্রায় ৩ লাখ বাংলাদেশি মধ্যপ্রাচ্যে গিয়েছিলেন (ঢাকা ট্রিবিউন, ২৬ ‌‌‌আগস্ট, ২০১৯)। বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর বহু অল্পশিক্ষিত তরুণ সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার, ওমান, জর্দান, লেবানন ও বাহরাইনে যান। এসব দেশে যেতে প্রায় সাড়ে ৫ থেকে ৬ লাখ টাকার মতো লাগে। যাওয়ার সময় তাঁদের প্রত্যাশা থাকে মাসে ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা বেতন। কিন্তু বাস্তবে সেখানে তাঁরা পান ২৫-২৬ হাজার টাকার মতো। অনেক সময় তাঁদের থাকা–খাওয়াও মেলে না, ভীষণ কষ্টে দিন কাটে।


আমরা মোটামুটি সবাই জানি, তরুণেরা তাঁদের নিজের বাবার জমি, দোকান বিক্রি, অনেক সময় আত্মীয়স্বজন বা গ্রামের মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা নিয়ে অথবা টাকা ধারদেনা করে, অনেক সময় জীবনের শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করে বা বন্ধক রেখে বিদেশে যান। আর বিদেশ যান একটি স্বপ্ন নিয়ে, একটু সুখের আশায়। যখন ওখানে গিয়ে কোনো ভালো চাকরি বা কর্মসংস্থান হয় না, হলেও নিজেদেরই চলে না, কীভাবে তাঁরা পরিবারের কাছে টাকা পাঠাবেন। সেই সঙ্গে আছে মহাজনের চড়া সুদের মাসিক কিস্তি। যা তাঁদের মস্তিকের ওপর বিশাল চাপ তৈরি করে। এরপর আছে আরও অনেক প্যারা। যেমন, যখনতখন চাকরি যাওয়ার ভয়। কারণ, দালালদের কারণে অনেক সময় বৈধ ভিসা থাকে না। অনেক সময় ওয়ার্ক পারমিট থাকে না। কারাগারে যাওয়ার ঘটনা তো প্রায় শোনা যায়। সেই সঙ্গে আছে নানা রকম দুর্ঘটনা। যেমন, সড়ক দুর্ঘটনা, উঁচু ভবন থেকে পড়ে যাওয়া, আগুন লাগার ঘটনা ইত্যাদি। আরও কিছু অমানবিক ঘটনা আছে। যেমন, ‘ছাগল’ ভিসা নিয়ে যাওয়া, মানে ধু ধু মরুভূমিতে মাসকে মাস ধরে ছাগল চরাতে হয় বলে অনেকে একে ‘ছাগল’ ভিসা বলেন। অনেকে ১২ ঘণ্টা ডিউটি করার পর, আবার স্টোর পরিষ্কার করেন। অনেকে ভিক্ষা করেন শুধু ৫০০ অতিরিক্ত রিয়াল অর্জনের জন্য। এতক্ষণে হয়তো আপনারা ভাবছেন বিদেশ গমনের সঙ্গে টমেটো চাষের সম্পর্ক কি? আসলে আমি একজন কৃষিবিদ হিসেবে এই বিষয়টিকে যেভাবে দেখি, সেটাই লেখার চেষ্টা করছি।

প্রতিবছর কাজের সন্ধানে বিদেশে যাচ্ছেন হাজারো লোক। ছবি: সংগৃহীত

ধরা যাক, রাজশাহীর পবা ও গোদাগাড়ি উপজেলা, দিনাজপুরের সদর ও চিরিরবন্দর উপজেলা, কুমিল্লার চান্দিনা, ময়মনসিংহের সদর উপজেলা, জামালপুরের সদর উপজেলা, কুষ্টিয়ার মিরপুর এবং পঞ্চগড়ের সদর উপজেলার অল্পশিক্ষিত তরুণের পৈতৃকভাবে পাওয়া এক বিঘা (৩৩ শতাংশ) জমি যদি থাকে, তিনি বিদেশ গমনের চিন্তা বাদ দিয়ে এ জমিতে যদি টমেটো চাষ করেন, তাহলে তার কী অবস্থা দাঁড়ায়। এক বিঘা জমিতে উন্নত জাতের টমেটো চাষ করতে হলে জমি তৈরি, সার, উন্নত মানের বীজ সংগ্রহ, চারা তৈরি, মূল জমিতে লাগানো, আন্তপরিচর্যা, স্টেকিং বা কাঠি দেওয়া, প্লাস্টিকের দড়ি কেনা, সেচ দেওয়া, প্লাকিং বা ফসল তোলার জন্য লেবার সংগ্রহ, গ্রেডিং করা, লোকাল আড়ত পর্যন্ত পৌঁছানোসহ নানা কাজে প্রায় ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়। ১ গ্রাম টমেটো বীজে থাকে ২৫০টি বীজ, একটি বীজ মানে একটি টমেটোগাছ আর একটি টমেটো গাছ মানে ৬ কেজি টমেটো। এক বিঘা জমিতে টমেটো বীজ লাগবে ২০ গ্রাম বীজ অর্থাৎ ২০ x ২৫০টি বীজ সমান ৫ হাজার টমেটোগাছ। ১০ শতাংশ গাছ বিভিন্ন কারণে মারা গেলেও (১০ শতাংশ মানে ৫০০ গাছ) আরও থাকে সাড়ে ৪ হাজার গাছ। তাহলে মোট ফলন হয় ৪৫০০টি গাছ x ৬ কেজি (প্রতিটি টমেটোগাছে গড়ে যদি ৬ কেজি টমেটো হয়) = ২৭ হাজার কেজি। এটাকে যদি ৪০ কেজি দিয়ে ভাগ দিই, তাহলে ফলন হয় ৬৭৫ মণ। আগাম জাতের এক কেজি টমেটোর দাম কম পক্ষে ৬০ টাকা। তাহলে ২৭ হাজার কেজি x ৬০ টাকা = ১৬ লাখ ২০ হাজার টাকা। আমরা যদি খরচ বাবদ ৩০ হাজার টাকা, শ্রমের মূল্য মাসে ১৫ হাজার টাকা ধরি, তাহলে ৪ মাসে ৬০ হাজার টাকা (কারণ, আগাম জাতের টমেটো সাড়ে তিন মাসে উঠে যায় অর্থাৎ ১০৫ দিনের ফসল, চারাতে লাগে= ২৫ দিন, ফল আসতে সময় লাগে= ৬০ দিন এবং ফল তুলতে সময় লাগে ২১ দিন, তাহলে মোট দিন হয়= ২৫+৬০+২১= ১০৬ দিন, সেখানে আমরা চার মাস ধরলাম)। তাহলে এক বিঘা জমিতে মোট হচ্ছে ৩০+৬০= ৯০ হাজার টাকা। অতএব, ১৬ লাখ ২০ হাজার টাকা থেকে ৯০ হাজার টাকা বাদ দিলে মোট লাভ হয় = ১৫ লাখ ৩০ হাজার টাকা। এটাকে ১২ মাসে ভাগ দিলে মাসিক আয় দাঁড়ায় ১ লাখ ২৭ হাজার ৫০০ টাকা, অথচ তাঁর হাতে আরও আট মাস সময় রয়ে যাচ্ছে, সেই জমিতে তিনি অন্য ফসলও করতে পারবেন। এভাবে আমাদের দেশের বেকার তরুণেরা যদি সঠিক পরিকল্পনা করেন, মানুষের কথায় কান না দিয়ে অথবা পাছে লোকে কিছু বলে, এই ভয় না করে কাজকে কাজ হিসেবে দেখেন আর আমরা বা আমাদের সমাজও যদি শ্রমের মর্যাদা দিই অর্থাৎ ওই ছেলেটিকে যদি কটু কথা না বলি, তাহলে এসব টগবগে তরুণের আর জীবনের শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করতে হবে না, থাকতে হবে না প্রিয়তম স্ত্রী, প্রাণের চেয়েও প্রিয় সন্তান, স্নেহের ছোট ভাইবোন, হাড়ভাঙা পরিশ্রমকারী বাবা ও গর্ভধারিণী জননীকে ফেলে হাজার কিলোমিটার দূরে সুদূর ধু ধু মরুভূমিতে। হতে হবে না প্রতিনিয়ত বিদেশিদের হাতে লাঞ্ছিত। আসলে ছোট্ট এই জীবনে ছোট্ট একটি স্বপ্ন নিয়ে পরিকল্পনামাফিক চললে আমার মনে হয়, কোনো মায়ের বুক খালি হবে না, বিধবা হতে হবে না কোনো প্রিয়তম স্ত্রীকে। বঞ্চিত হতে হবে না আদরের ভাইবোনদের অকৃতিম ভালোবাসা থেকে। তাই আসুন বিদেশ গমনের আগে আমরা যারা বেকার তরুণেরা আছি, আমাদের জীবনটাকে আমাদের মতো করে সাজাই। কল্পনাবিলাসী না হয়ে, বাস্তবসম্মত কাজ করি। নিশ্চিন্তে রাতে ঘুমাই, মা-বাবাকে সেবা করি। ভবিষ্যৎ বংশধরদের শিক্ষিত করে তোলার চেষ্টা করি, টমেটো চাষ করলে গ্রামের মানুষ কী বলবে, এসব কথা না শোনার জন্য কানে তুলা দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাই। দেশ, মাটি, মানুষ ও লাল–সবুজের পতাকার সঙ্গে নিজেকে সঁপে দিয়ে, আত্মসম্মান বোধ নিয়ে চলাফেরা করি।

পাঠক আপনারা ইতিমধ্যে বুঝতে পেরেছেন বিদেশ যাওয়া বনাম টমেটো চাষের সম্পর্ক। লাখো টাকা খরচ না করে, টমেটো বা সবজি চাষ করে সহজে মাসে লাখ টাকা আয় করা যায়। এর শত শত উদাহরণ আছে আমাদের দেশে। তাই অজানা দেশে আলাদিনের চেরাগের স্বপ্ন না দেখে, আমাদের দেশে আমরা নিজেরাই নিজেদের পায়ে দাঁড়াই, আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাই। সব শেষে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপ্রতি এ পি জে আবদুল কালামের একটি উক্তি দিয়ে শেষ করি, ‘স্বপ্ন সেটা নয় যা তুমি ঘুমিয়ে দেখো। স্বপ্ন সেটাই যা তোমায় ঘুমাতে দেয় না।’ সুতরাং ভালো করার সবচেয়ে কার্যকরী সূত্র হলো KAP, K=Knowledge, A=Attitude and P=Practice. জ্ঞান, দৃষ্টিভঙ্গি ও ধৈর্যসহকারে বারবার চেষ্টা করা স্বপ্ন পূরণের অন্যতম হাতিয়ার। সুতরাং নিজের গ্রামে, নিজের জমিতে স্বাধীনভাবে টমেটো বা সবজি চাষ করুন। অদক্ষ হয়ে বিদেশ যাওয়ার জন্য পাগলামি বন্ধ করুন এবং নিজেকে নিজের চেষ্টায় স্বাবলম্বী করে তুলুন এটাই আমার আপনাদের কাছে প্রত্যাশা।