Thank you for trying Sticky AMP!!

বিদেশ থেকে শিক্ষক আনা হবে, হবে না

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বাজেট বক্তৃতায় বিদেশ থেকে শিক্ষক আনার কথা বলেন। তাঁর এই বক্তব্য নিয়ে চলছে নানা আলোচনা। ছবি: বাসস

শিক্ষার মান উন্নয়নে প্রয়োজনে বিদেশ থেকে শিক্ষক আনার কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বাজেট বক্তৃতায় এ কথা জানানোর পর এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে নানামুখী আলোচনা হচ্ছে। কী পদ্ধতিতে, শিক্ষার কোন পর্যায়ে বিদেশি শিক্ষক আনা হবে, সে ব্যাপারেও রয়েছে ধোঁয়াশা।

বাংলাদেশের শিক্ষার মান নিয়ে অভিযোগ রয়েছে। শিক্ষাব্যবস্থায় মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠার মধ্যেই নিত্যনতুন পরীক্ষণ, বদলে যাওয়া নীতি এবং শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি, প্রশ্নপত্র ফাঁস ও কোচিং–বাণিজ্য শিক্ষার মানকে নাজুক করেছে। অর্থমন্ত্রী বিদেশ থেকে শিক্ষক আনার কথা বললেও শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, এটা শুধুই একটি উপমা। বিদেশ থেকে শিক্ষক এনে শিক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে দেশীয় শিক্ষকদের কাজের সুযোগ তাঁরা নষ্ট করতে চান না।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে শিক্ষার উন্নয়নে সরকারের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানালেও এই উদ্যোগের চ্যালেঞ্জ নিয়ে উদ্বেগ জানান বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা মনে করেন, বিদেশ থেকে শিক্ষক আনার ক্ষেত্রে যাচাই-বাছাই, নীতিনির্ধারণ ও কর্মপদ্ধতি চূড়ান্ত করতে হবে। প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে না পারলে সুফল পুরোপুরি আসবে না। তাঁরা মনে করেন, বিদেশ থেকে শিক্ষক আনার আগে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি, শিক্ষা–বাণিজ্য এবং ক্রমে দরিদ্রদের নাগালের বাইরে নিয়ে যাওয়া শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে।

শিক্ষার বর্তমান পরিস্থিতির মধ্যেই ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণায় অর্থমন্ত্রী শিক্ষার মান উন্নয়নে প্রয়োজনে বিদেশ থেকে শিক্ষক আনার বিষয়টি তুলে আনেন। বাজেট বক্তৃতায় ১৮০০ শতকের (শাসন আমল ১৮৬৮ থেকে ১৯১২) জাপানের সম্রাট মেইজির উদাহরণ দিয়ে বলা হয়, সে সময় পাশ্চাত্যের শিক্ষক এনে জাপানের শিক্ষাব্যবস্থাকে পুনর্গঠন করা হয়, যা পরে জাপানকে জ্ঞান–বিজ্ঞানে একটি সফল রাজ্যে পরিণত করে।

বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আঠারো শতকের শেষার্ধে মেইজি পুনর্গঠন শুরুর আগে জাপান ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞানে একটি পশ্চাৎপদ দেশ। সম্রাট মেইজি জাপানিজদের, এমনকি রাজপুত্রকেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোয় পাঠিয়ে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও প্রযুক্তিজ্ঞান আহরণ করার তাগিদ দেন। সম্রাট মেইজি বুঝতে পারলেন, জাপানে ছাত্রের অভাব নেই। অভাব আছে উপযুক্ত শিক্ষকের। তাই তিনি পাশ্চাত্য দেশসমূহ থেকে বিভিন্ন প্রযুক্তিনির্ভর কয়েক হাজার শিক্ষককে জাপান নিয়ে এলেন জাপানের শিক্ষাব্যবস্থাকে সময় উপযোগী করে তোলার জন্য। এরূপ প্রাজ্ঞ ও দূরদর্শী নীতির কারণে জাপান শুধু পশ্চিমাদের সমকক্ষ হয়েই থাকেনি, বরং সারা বিশ্বে সবার আগে শতভাগ শিক্ষিতের দেশ হওয়ার গৌরব লাভ করেছে। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও শিক্ষাকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করেছেন। দক্ষ জনশক্তি তৈরির উদ্দেশ্যে শিক্ষার সার্বিক মানোন্নয়নে, শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য দূরীকরণ, গুণগত উৎকর্ষ সাধন ও শিক্ষা সম্প্রসারণের লক্ষ্য নির্ধারিত হয়েছে। আমরা মনে করি, সম্রাট মেইজিকে অনুসরণ করার সময় আমাদেরও এসেছে।’

শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামও বিদেশ থেকে শিক্ষক আনার বিষয়টিকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখেন। তবে তিনি প্রশ্ন রাখেন, ‘বিদেশ থেকে শিক্ষক আনার অর্থের জোগান কোথা থেকে আসবে?’ তিনি আরও বলেন, ‘এ বছর শিক্ষায় বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে, যার বড় অংশ পরিচালনায় ব্যয় হবে। উন্নয়নে যে এক-তৃতীয়াংশ রাখা হয়েছে, তা যদি বিদেশি শিক্ষক আনার ব্যয় আসে, তবে সেটা চলমান উন্নয়ন ব্যাহত হতে পারে।’ সব স্তরে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও দলীয়করণের অভিযোগ করে সৈয়দ মনজুরুল বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষাব্যবস্থায় একটা বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করছে। প্রায় প্রতিটি নিয়োগপ্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক প্রভাব থাকে। যাঁরা নিয়োগ পান, তাঁদের দায়িত্ব পালনের চেয়ে রাজনৈতিক দলের নেতাদের সন্তুষ্ট রাখার প্রচেষ্টা থাকে। এ ছাড়া শিক্ষা–বাণিজ্য, কোচিং শিক্ষার দাপট ও প্রশ্নপত্র ফাঁস শিক্ষাব্যবস্থাকে শুধু মানহীন করেনি, ক্রমেই দরিদ্রদের নাগালের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে।’ এসব অরাজকতা বন্ধ না করে শুধু আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষক আনা বা শিক্ষক প্রশিক্ষণ কতটা কাজে আসবে, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন তিনি।

বিদেশ থেকে শিক্ষক আনার বিতর্কে বিষয়টিকে ‘গণমাধ্যমের অপব্যাখ্যা’ বলে উল্লেখ করেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী। তিনি বলেন, বাজেট বক্তৃতায় জাপানের সম্রাট মেইজির উদাহরণ টেনে যা বলা হয়েছে, তা শুধুই একটি উপমা। এর অর্থ কখনো এমন নয় যে বাস্তবেই অন্য কোনো দেশ থেকে শিক্ষক আনা হবে। শিক্ষা উপমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা কিছুতেই অন্য কোনো দেশের শিক্ষক দিয়ে আমাদের দেশের শিক্ষকদের কাজের সুযোগ নষ্ট করতে চাই না। বরং আমাদের চাওয়া, শিক্ষকেরা যেন পাঠদানে আরও দক্ষ ও কার্যকর হয়ে ওঠেন। এ লক্ষ্যে আমরা শিক্ষকদের আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণের পরিমাণ ও ব্যাপ্তি বাড়াতে চাই।’

মেইজির উদাহরণ দেওয়া হলেও শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে ঠিক মেইজি যেভাবে বিদেশ থেকে শিক্ষক এনেছেন, তা হুবহু অনুসরণের কোনো সুযোগ নেই বলে মনে করেন মহিবুল হাসান চৌধুরী । তিনি বলেন, ‘মেইজির যুগে তথ্যপ্রযুক্তি তেমন উন্নত ছিল না বলে বিদেশ থেকে শিক্ষক এনে শিক্ষাব্যবস্থাকে উন্নত করতে হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে আমরা অনলাইনে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে বা প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেই শিক্ষাব্যবস্থা উন্নত করতে পারব বলে বিশ্বাস করছি।’

দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের শিক্ষার মান নিয়ে কাজ করা গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, শিক্ষার উন্নয়নে বিদেশ থেকে শিক্ষক আনার এই প্রস্তাব প্রমাণ করে, সরকার শিক্ষার উন্নয়নে আন্তরিক এবং তারা অবস্থার উত্তরণের চেষ্টা করছে। শিক্ষাব্যবস্থার ঠিক কোন স্তরে বিদেশি শিক্ষক আনার পরিকল্পনা করছেন, এ বিষয়টি সুস্পষ্ট করে না বলায় এই উদ্যোগ শিক্ষা ব্যবস্থাকে কতখানি পরিবর্তন করতে পারবে, সে বিষয়ে মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক এই উপদেষ্টা।

শিক্ষা উপমন্ত্রী নওফেল মনে করেন বিদেশ থেকে শিক্ষক আনার বিষয়টি একটি উপমা। ফাইল ছবি

রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, শিক্ষার মান উন্নয়ন একটি দীর্ঘদিনের চাওয়া। সরকারও এই বিষয়ে অনেক দিন ধরেই কাজ করছে। সে পরিক্রমায় ২০১০ সালে আওয়ামী লীগ সরকার একটি শিক্ষানীতি প্রস্তাব করে, যা নয় বছরেও সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয়নি। বিদেশি শিক্ষক আনার এই প্রস্তাব কত দিনে বাস্তবায়ন করা হয় এবং তার সুফল কত দিনে বাংলাদেশ পেতে পারে, তা নিয়েও প্রশ্ন রাখেন তিনি।

সরাসরি বিদেশি শিক্ষক নিয়ে দ্বিধা প্রকাশ করেন প্রকৌশলী ও শিক্ষাবিদ মুহাম্মদ কায়কোবাদ। তিনি বলেন, যদি বিদেশি শিক্ষক এসে একটা নির্দিষ্ট সময় থেকে শিক্ষাব্যবস্থাকে উন্নত করতে পারেন, তবে সেটা অবশ্যই একটা ভালো উদ্যোগ। তবে প্রস্তাবটি ভাবা হচ্ছে একটা আদর্শ অবস্থা থেকে, যা কার্যক্ষেত্রে নাও থাকতে পারে। বিদেশি শিক্ষক নিয়োগে কী ধরনের সাবধানতা সরকারের নেওয়া উচিত, এ বিষয়ে মুহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, বিশেষজ্ঞ নিয়োগ বাংলাদেশের নতুন কিছু নয়। শিক্ষায় যখন এ রকম বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করা হবে, তখন তাদের মান যাচাইয়ের বিষয়ে জোর দেওয়া আবশ্যক। এ ক্ষেত্রে মান নিশ্চিত না করতে পারলে পুরো প্রচেষ্টা বিফলে যাবে বলে মনে করেন তিনি।

শিক্ষা উপমন্ত্রী বলেন, ‘শিক্ষা উন্নয়নে বিদেশ থেকে শিক্ষক আসার বিষয়টি নতুন নয়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় প্রায়ই আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষক খণ্ডকালীন ভিত্তিতে আসেন। এ ছাড়াও বিভিন্ন পেশাদার প্রশিক্ষণে বিদেশ থেকে শিক্ষক আনা হয়। আমরা বরং চাই, এ দেশে আরও বেশি “মাস্টার ট্রেইনার” তৈরি হোক। এ ছাড়া কারিগরি শিক্ষা উন্নয়নে স্কিলস অ্যান্ড ট্রেনিং এনহ্যান্সমেন্ট প্রকল্পের (এসটিইপ) আওতায় কারিগরি শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের পরিকল্পনা সরকার বাস্তবায়ন করছে। ইতিমধ্যেই প্রায় পাঁচ হাজার শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, আরও দেওয়া হবে।’

নতুন অর্থবছরে শতকরার হিসাবে সবচেয়ে বেশি শিক্ষা বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষায়। গত বছরের বরাদ্দের প্রায় ২৮ দশমিক ৪ শতাংশ বাড়িয়ে এ বছর এখাতে বাজেট বরাদ্দ ৭ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা।

২০১৯-২০ অর্থবছরে শিক্ষার একটি মন্ত্রণালয় ও দুটি বিভাগে মোট বরাদ্দ ৬১ হাজার ১১৮ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের তুলনায় ১৭ শতাংশ বেশি। আপাতদৃষ্টিতে এই বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে মনে হলেও এই বরাদ্দ মোট বাজেটের ১১ দশমিক ৭ শতাংশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরেই এর মান ছিল বাজেটের মোট বরাদ্দের ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ।

শিক্ষায় বরাদ্দের প্রায় ৬৬ শতাংশ অর্থ রাখা হয়েছে পরিচালনার কাজে এবং মাত্র ৩৪ শতাংশ ব্যয় করা হবে শিক্ষার উন্নয়নে। এই উন্নয়ন বরাদ্দ কীভাবে ব্যয় হবে, তার কোনো সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা বাজেট বক্তৃতায় ছিল না। তবে বিদেশ থেকে শিক্ষক আনার উদাহরণ থেকে ধারণা করা হয়, ব্যয়ের বড় অংশ যাবে শিক্ষকদের উন্নয়ন করে শিক্ষাব্যবস্থা উন্নয়নে।

আর্থিক বিষয়টিকে সুরক্ষিত রাখতে পারলে বিদেশ থেকে আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষক এনে শিক্ষার মান উন্নয়নের বিষয়টির পক্ষেই মত দেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার উন্নয়নে সরাসরি বিদেশের ওপর নির্ভর না হয়ে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কর্মরত বাংলাদেশি শিক্ষকদের ব্যবহার করা যেতে পারে প্রস্তাব দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা যাঁরা বিশ্বের নাম করা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যান, তাঁরা প্রায় সবাই ভালো করেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিদ্যমান নিয়মনীতি অনুযায়ী তাঁরা দেশে এসে কাজ করার সুযোগ পান না। এসব প্রবাসী শিক্ষককে শিক্ষা ও গবেষণার কাজে সংযুক্ত করা যেতে পারে।’