Thank you for trying Sticky AMP!!

বিদ্যা, বুদ্ধি ও জ্ঞানের দেবী

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

‘ওঁ জয় জয় দেবী চরাচর সারে,

কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে

বীণারঞ্জিত পুস্তক হস্তে,

ভগবতী ভারতী দেবী নমোহস্তুতে।’

প্রতিবছর মা সরস্বতী ধরণিতে আসেন আমাদের বিদ্যাবুদ্ধি দিতে, বিদ্যার ভান্ডারকে সমৃদ্ধ ও পরিপূর্ণ করতে। বিদ্যার্থীরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে ১২টি মাস, ৩৬৫ দিন—কখন বিদ্যাদেবী আসবেন তাদের শিক্ষাঙ্গনে। সব শিক্ষার্থী একত্র হয়ে মাকে আগমন জানাতে শুরু করে প্রস্তুতি, সিদ্ধান্ত নেয় মা সরস্বতীকে পূজা দিতে এবারে কী কী আয়োজন থাকবে। প্রথমেই তারা দেবীর মূর্তি তৈরির জন্য নির্দিষ্ট কারিগরের কাছে চলে যায়, দেখেশুনে মূর্তি প্রাপ্তির তারিখ নিশ্চিত করে। তারপর শুরু হয় তাদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মহড়া; সেই সঙ্গে মণ্ডপ তৈরি, পুরোহিতকে সময়-তারিখ নিশ্চিত করার সঙ্গে সঙ্গে আলপনা আঁকা আর মণ্ডপ সাজানোর কাজ চলতে থাকে।

সরস্বতীপূজা দুর্গাপূজার মতোই সর্বজনীন পূজা। দলমত-নির্বিশেষে আবালবৃদ্ধবনিতা সরস্বতীপূজায় শরিক হয়। মায়ের কাছে বিদ্যা চাইতে সবাই জোড় হাত তুলে প্রণাম করে। মা তো বিদ্যার দেবী, তাই তাঁর কাছেই বিদ্যা চাইবে সবাই। বিদ্যা যদি না পাই, তবে তো পূর্ণাঙ্গ মানুষ হতে পারব না। একজন পরিপূর্ণ মানুষ হতে হলে বিদ্যার বিকল্প নেই। আচার-আচরণ, স্বভাব-প্রকৃতি সবকিছুই পরিপূর্ণতা পায় বিদ্যার গুণে। তাই বিদ্যার দেবীকে অঞ্জলির মাধ্যমে নিবেদন করে শিক্ষার্থীরা—তাদের মনস্কামনা যেন দেবী সরস্বতী পূরণ করেন, এই প্রার্থনাই পূজার মূলমন্ত্র।

বাঙালির ঘরে ঘরে যে পূজা আবহমান কাল থেকে হয়ে আসছে, তা হচ্ছে সরস্বতীপূজা। দেবী সরস্বতী বিদ্যার দেবী, তাই শিক্ষার্থীদের জন্য আসেন বিদ্যার স্বরূপ হয়ে। বিদ্যা-বুদ্ধিতে সন্তানেরা সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে মায়ের আশীর্বাদে, এই দিন তাই সকালে পূজার আয়োজন চলে ঘরে ঘরে। অঞ্জলি আর প্রসাদ বিতরণের মধ্য দিয়ে পূজার মণ্ডপ হয়ে ওঠে আনন্দ-উৎসবে মুখর।

মা দেবী সরস্বতী আমাদের বিদ্যা, বুদ্ধি, জ্ঞান আর সুরের মূর্ছনায় ভরিয়ে দিতে আসেন প্রতি মাঘে। শীতের এই কুয়াশাঢাকা সকালে স্নান করে বই, খাতা, কলম নিয়ে মা দেবী সরস্বতীর কাছে আমরা হাজির হই পুষ্পাঞ্জলি দিতে। কারণ, মাকে আমার ভক্তি নিবেদন করতে হবে। কেননা বিদ্যা, বুদ্ধি আমার চাই। কথায় বলে, শিক্ষার শেষ নেই। আমার যতই ডিগ্রি থাকুক আর পদবি থাকুক, জানার যেমন শেষ নেই, তেমনি আমার বিদ্যাকে, আমার বুদ্ধিকে আরও আমি বাড়াতে চাই। তাই বলে বিদ্যার জাহাজ হওয়ার জন্য নয়। বিদ্যার একটি ছোট ডিঙি তো হতে পারি!

সরস্বতীপূজাতে শিক্ষাঙ্গনের শুধু ছাত্রছাত্রী নয়, তাদের সঙ্গে মিলিত হন সব শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী। সবাই মিলেই পূজাকে সার্থক ও পরিপূর্ণভাবে উদ্‌যাপন করে। অঞ্জলি আর দেবীর প্রসাদ বিতরণের পর শুরু হয় যজ্ঞ, তারপর ভোগ। সবাই আমন্ত্রিত হয়ে আসে পূজামণ্ডপ দর্শন আর প্রসাদ গ্রহণ করতে। সবশেষে আরতি আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করে বাড়ি ফিরে যায় সবাই। বিদ্যাদেবী সরস্বতীপূজার দিন অঞ্জলি দিয়ে দেবীর কাছে প্রার্থনা করে, তাদের যেন বিদ্যাবুদ্ধি হয়, জীবনে তারা যেন শিক্ষিত হয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে সংসার, সমাজ আর দেশসেবা দিয়ে মানবতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে।

সরস্বতীপূজা যে শুধু হিন্দুধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীদের নিয়েই হয় তা কিন্তু নয়, তাদের সঙ্গে ধর্মবর্ণ-নির্বিশেষে সব শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ থাকে এ পূজার আকর্ষণীয় দিক। পূজামণ্ডপে ছেলেমেয়েদের সুন্দর সাজে সজ্জিত হয়ে গান, আরতি, অঞ্জলি, প্রসাদ বিতরণ, রঙিন সাজে ধূপধূনা আর ফুল দিয়ে অঞ্জলি দিতে দেখা যায়। এ দৃশ্য দেখলে মন আনন্দে ভরে যায়, কে হিন্দু, কে মুসলমান, কেই-বা খ্রিষ্টান—বোঝা কঠিন। এ যেন এক মিলনমেলা। তখনই সত্যিকারভাবে ফুটে ওঠে সেই চিত্র—‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’।

মানবকল্যাণমূলক চেতনাকে মনেপ্রাণে ধারণ করে আমাদের মানবসেবায় আত্মনিয়োগ করতে হবে। তবেই মনুষ্যত্বের বিকাশ সম্প্রসারিত হবে। আর মনুষ্যত্বের বিকাশের মাধ্যমেই সাধিত হবে মানুষের, তথা সমাজের কল্যাণ। এর ফলে মানুষের মধ্যে প্রকাশিত হবে মানবিক মূল্যবোধ। বাংলাদেশে আমরা যেন এভাবে সবাই মিলেমিশে চলতে পারি। পূজার দিনে আমরা কামনা করি, দেশটি যেন সত্যিকারভাবেই অসাম্প্রদায়িক চেতনায়, মুক্তিযুদ্ধের আলোকে সাংস্কৃতিক অঙ্গন ভরে থাকে বছরের সারাটা দিন। সরস্বতী দেবীর কাছে আমাদের প্রার্থনা একটিই, ‘মাগো, তুমি বিদ্যা দাও সকলেরে’।

ডা. অরূপ রতন চৌধুরী: অধ্যাপক, ডেন্টিস্ট্রি, ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ ডেন্টাল ইউনিট।