Thank you for trying Sticky AMP!!

বিশ্ব মানবাধিকারের কণ্ঠস্বর ছিলেন তিনি

পাকিস্তানের মানবাধিকার কর্মী আসমা জাহাঙ্গীরের স্মরণসভায় বক্তব্য দিচ্ছেন মানবাধিকার কর্মী হামিদা হোসেন। মঞ্চে আছেন (বাঁ থেকে) খুশী কবির, সুলতানা কামাল, সিগমা হুদা এবং ড. কামাল হোসেন।

নির্ভীক, স্পষ্টবাদী, দরদি, সাহসী—এমন শব্দগুলো তাঁর জন্য সবচেয়ে মানানসই। তিনি জন্মেছিলেন পাকিস্তানে। দেশের নারী-পুরুষসহ পীড়িত সব মানুষের জন্য ছিল তাঁর অকৃত্রিম ভালোবাসা। সারা জীবন লড়েছেন তাদের হয়ে। তবে শুধু দেশের মানুষ নয়। নিজ দেশের সীমান্তের গণ্ডি পেরিয়ে তাঁর কণ্ঠস্বর পৌঁছে গেছে দক্ষিণ এশিয়ায়, সারা বিশ্বে। যেখানে ভূলুণ্ঠিত মানবাধিকার, সেখানেই আসমা জাহাঙ্গীর। তাই আসমা জাহাঙ্গীর ছিলেন বিশ্ব মানবাধিকারের কণ্ঠস্বর।

পাকিস্তানের সদ্যপ্রয়াত মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবী আসমা জাহাঙ্গীর স্মরণে তাঁর পরিচিতজনেরা এমন কথাই বললেন। তাঁরা বললেন, আসমা জাহাঙ্গীর শুধু তাঁর প্রজন্মের মানুষের জন্য লড়েননি, পরবর্তী প্রজন্মের মানুষের জন্য রেখে গেছেন নানা অবদান। তাঁর কর্মময়, সংগ্রামী জীবন তাই আগামী প্রজন্মের মানুষের পাঠ্য। এ পাঠ মানুষকে আলোকিত ও বিকশিত করবে।

হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে ১১ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের লাহোরে মারা যান বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু আসমা জাহাঙ্গীর। মৃত্যুর সময় বয়স হয়েছিল ৬৬ বছর। তাঁর এই মৃত্যু ব্যথিত করেছে সারা বিশ্বের মানবাধিকারকর্মীদের। বাংলাদেশে তাঁর বন্ধু, সহযোদ্ধা আছেন অনেকে। ব্যথী তাঁরাও। তাঁদেরই আয়োজনে আজ সোমবার আসমা জাহাঙ্গীর স্মরণসভার আয়োজন করা হয়। আয়োজন করে সাউথ এশিয়ানস ফর হিউম্যান রাইটস (সাহার) এবং সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন। ‘মরণেরে ঢেকে রাখি, স্মরণে ও অঙ্গীকারে’—এই অঙ্গীকারে এ সভার আয়োজন করা হয় রাজধানীর আগারগাঁওয়ের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনে।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে আসমা জাহাঙ্গীর স্মরণসভার আয়োজনকে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ মনে করেন অনুষ্ঠানের আলোচক প্রবীণ আইনজীবী ড. কামাল হোসেন। এর কারণ হিসেবে কামাল হোসেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এবং পরে বিভিন্ন সময়ে এ দেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং মানবাধিকারের প্রতি আসমা জাহাঙ্গীরের অকৃত্রিম ভালোবাসার কথা উল্লেখ করেন। কামাল হোসেন স্মরণ করেন আসমা জাহাঙ্গীরের বাবা মালিক গুলাম জিলানির কথা। পাকিস্তানি এই আওয়ামী লীগ নেতা ১৯৭১ সালের এপ্রিলে ইয়াহিয়া খানকে লেখা দীর্ঘ চিঠিতে বাংলাদেশে সে সময় চলা গণহত্যার জন্য নিজের ঘৃণা প্রকাশ করেন। এ দেশের মানুষের ওপর চলা বর্বরতা এবং পাকিস্তানি শাসক চক্রের অন্যায্য আচরণের প্রতিবাদ জানান। ফল হয়, কারাবাস। আর মাত্র ১৯ বছর বয়সে বাবার প্রতি এই রাষ্ট্রীয় অনাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন আসমা জাহাঙ্গীর।

ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘বাবার মতোই, যা ন্যায্য বলে মনে করতেন, তার পক্ষে দাঁড়াতেন আসমা জাহাঙ্গীর। তাঁর নির্ভয়ে কথা বলার শক্তি সব মানবাধিকারকর্মীর কাজের প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।’ তিনি আরও বলেন, তাঁর প্রয়াণ এক বিরাট শূন্যতা সৃষ্টি করে গেল।

আজকের অনুষ্ঠানে আসমা জাহাঙ্গীরের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান। বললেন, আসমার কাজের ক্ষেত্রের সঙ্গে তাঁর কাজের ক্ষেত্র ভিন্ন। তবুও তিনি এই মানবাধিকারকর্মীর নানা কাজের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। সেই বর্ণময় জীবনের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে রেহমান সোবহান বলেন, ‘তাঁকে চরম প্রতিকূলতার মধ্যে কাজ করতে হয়েছে। একদিকে বৈরী রাষ্ট্র অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শক্তি। এদের বিরুদ্ধে দেশের নারী, সংখ্যালঘুসহ সব পীড়িত মানুষের পক্ষে লড়েছেন তিনি। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এ লড়াই অব্যাহত ছিল তাঁর।’ তিনি বলেন, ‘আসমা জাহাঙ্গীর শুধু তাঁর প্রজন্মের জন্য কাজ করেননি, তিনি উত্তর প্রজন্মের প্রেরণার উৎস।’

আজকের অনুষ্ঠান শুরু হয় ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে’ গানটি দিয়ে। শিল্পী মিলিয়া আলী ও আজিজুর রহমানের পরিবেশনায় গানটি নিবেদন করা হয় আলোকবাহী আসমা জাহাঙ্গীরের উদ্দেশে।

আসমা জাহাঙ্গীরের এই আলোকময় জীবনের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে মানবাধিকারকর্মী হামিদা হোসেন বলেন, আদালতে ও আদালতের বাইরে সর্বত্র তিনি ছিলেন সরব। তিনি ছিলেন এক প্রতিবাদী নারী।

অনুষ্ঠানের সভাপতি ও সাহারের চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল বলেন, ‘আসমা জাহাঙ্গীরকে আমি এভাবেই দেখি, যখনই কারও বিপদ দেখেছেন, তাঁর মনে ধাক্কা লেগেছে। মানুষের বিপদে যদি কারও মনে ধাক্কা না লাগে, তবে তিনি মানবাধিকারকর্মী হতে পারেন না।’

সুলতানা কামাল তাঁর বক্তব্যে আসমা জাহাঙ্গীরের জীবনের সাহসী সব উদাহরণ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, আসমা কৃতী আইনজীবী ছিলেন। তাঁকে তাই বিচারপতি হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি তা এই বলে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, যে দেশে এত অন্যায্য আইন থাকে, সে দেশের বিচারক আমি হতে পারি না।’

অনুষ্ঠানে আসমা জাহাঙ্গীরের সঙ্গে তাঁর নানা সময়ের সাক্ষাৎ এবং তাঁর জীবনের নানা ঘটনার স্মৃতিচারণা করেন প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমরা যারা ভয়ের মধ্যে আছি, তারা আসমা জাহাঙ্গীরের কর্মজীবন থেকে শিক্ষা নিতে পারি। সাহস সঞ্চয় করতে পারি।’ তিনি বলেন, যদি তাঁর মতো করে কাজ করতে পারি, তাহলেই এই মানবাধিকার যোদ্ধার প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হবে।

মতিউর রহমান বলেন, আসমা জাহঙ্গীর পাকিস্তানের মতো বৈরী পরিবেশে থেকেও সাহসের সঙ্গে লড়াই করেছেন। বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় আসমা জাহাঙ্গীরের সমর্থনের কথা স্মরণ করেন তিনি।

আসমা জাহাঙ্গীরকে ‘সারা বিশ্বের বিবেক’ হিসেবে তুলনা করেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ বাংলাদেশের চেয়ারপারসন শামসুল বারী। তিনি বলেন, আসমা জাহাঙ্গীরের লেখা মানবাধিকারসংক্রান্ত অসংখ্য লেখা একেকটি মূল্যবান দলিল। এসব মানবাধিকারকর্মীদের জন্য অবশ্যপাঠ্য।

স্মৃতিচারণায় অংশ নিয়ে মানবাধিকারকর্মী সিগমা হুদা বলেন, মানুষের পক্ষে থাকার জন্য নানা পীড়ন সহ্য করতে হয়েছে আসমা জাহাঙ্গীরকে। তবে তাঁর পথ থেকে কেউ সরাতে পারেনি।

আজকের অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন নিজেরা করির সমন্বয়কারী খুশী কবির। অনুষ্ঠানের শুরুতে আসমা জাহাঙ্গীরের কর্মময় জীবনের ওপর একটি তথ্যচিত্র দেখানো হয়।