Thank you for trying Sticky AMP!!

বিষণ্ন দিনের বিক্ষিপ্ত লিপি

করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ–বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: dp@prothomalo.com

১৭ মে ২০২০
একই দিনে আমাদের হাউজিং সোসাইটিতে দুটি ঘটনা। একজনের মৃত্যুসংবাদ পেলাম। আর আমাদের বিল্ডিংয়ে একজনের করোনা পজিটিভ। দুই মাস আমাদের সোসাইটি পুরো লকডাউন ছিল। সবাই খুব মেনে চলেছে। তবু তাঁরা আক্রান্ত হলেন।
রাত সোয়া ১২টা। ব্যালকনিতে বেরিয়ে দেখি, পুলিশ এসেছে। রাতে বেল বাজাল পুলিশ। তাঁরা জানালেন একজনের করোনা পজিটিভ হওয়ার কথা। ১৪ দিন লকডাউনে থাকতে হবে আমাদেরকে। কেউ ঢুকতে বা বেরোতে পারবেন না।
বিকেলে আমার স্বামী চলে গেল শিপে। লকডাউনে সারা বিশ্ব বন্ধ, কিন্তু জাহাজ–বাণিজ্য নয়।
বাচ্চাদের নিয়ে আমি বাসায় একা। মন অস্থির। বাচ্চাদের সাহস দিয়ে বললাম, কিচ্ছু হয়নি।

১৯ মে ২০২০
বাচ্চারা নিজেরাই নিজেদের পথ বের করে নিচ্ছে। ইমুতে ভিডিও কল দেওয়া শুরু করেছে। মেয়েরা চিঠি লিখছে ছোট ভাইদের কাছে। খামের ভেতর চকলেটও ভরে রাখছে ভাইদের জন্য।
আমাদের বিল্ডিংয়ে করোনায় আক্রান্ত ব্যাংকার ভাইয়ের খবর নিচ্ছি ভাবির কাছে। তিনি সুস্থ হয়ে উঠছেন।
ওদিকে ঘূর্ণিঝড় আম্পান শক্তি সঞ্চয় করে এগোচ্ছে। সিএনএন বলেছে, বঙ্গোপসাগরে এ–যাবৎ রেকর্ড হওয়া সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় এটি।

মধ্যসমুদ্রে আমার স্বামী। আমি বাসায় একা।

২০ মে ২০২০
আজ ২৬ রোজা। কিছু ফলমূল নিয়ে ইফতার করতে বসলাম। ইফতারের ঠিক আগে আগে পৃথিবী অন্ধকার করে ঝড় এল। ঝরঝর বৃষ্টির সন্ধ্যায় এমন অন্ধকারে আমার পৃথিবীতে আমি যেন একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেলাম। যেন আমার কেউ নেই। ইফতার করতে বসে অঝোরে কাঁদলাম। বাচ্চাদের সামনেই।
গভীর সমুদ্রে আমার স্বামী জাহাজে ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলা করছে। বাচ্চাদের নিয়ে আমি করোনা মোকাবিলায় ব্যস্ত।

২২ মে ২০২০
আজ বিশ্ব জীববৈচিত্র্য দিবস। সুন্দরবন প্রমাণ করল, এটা বাংলাদেশে জীববৈচিত্র্যের সবচেয়ে বড় আশ্রয়ই শুধু নয়, আমাদের প্রাকৃতিক রক্ষীও।
হালদায় অপূর্ব ঘটনা ঘটেছে। সাধারণত মার্চ-এপ্রিলে বজ্রসহ বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢল পেলে হালদায় ডিম ছাড়ে কার্প–জাতীয় মাছ রুই, কাতলা, মৃগেল। গত দিনগুলোতে ডিম ছাড়ার পরিবেশ পাচ্ছিল না মা মাছেরা। আম্পানের অঝোর বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢল মা মাছদের এনে দিয়েছে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। হালদার প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্রে ডিম ছাড়তে শুরু করেছে তারা। ডিম সংগ্রহে গত ১৪ বছরের রেকর্ড ভেঙেছে এবার। ডিমের পরিমাণ ২৫ হাজার ৫৩৬ কেজি। গত বছর ছিল সাত হাজার কেজি।

২৩ মে ২০২০
ঈদের চাঁদ দেখা যায়নি। বাচ্চাদের জন্য কিছু জামা বেছে দিলাম, মাস কয়েক আগে কেনা। আমার তিন সন্তানের কখনোই কিছুর চাহিদা নেই। না নতুন কাপড়ের, না খাবারের, না কোথাও বেড়াতে যাওয়ার। আল্লাহ ওদের উঁচু মূল্যবোধের মানুষ করুক।

২৪ মে ২০২০
আগামীকাল অবশ্যই ঈদ হবে। করোনাকালের ব্যতিক্রমী ঈদের সাক্ষী হতে চলেছি আমরা।
আজ আমার স্বামী জাহাজ নিয়ে জেটিতে এসেছে। চাইলে বাসায় আসতে পারত, কিন্তু বাসা লকডাউন বলে না আসাই উত্তম।
আজ রাত জেগে রান্না হচ্ছে না। ঈদের কোনো আয়োজন নেই। কারণ, কাল ঈদে কোনো মেহমান আসবে না।

২৫ মে ২০২০
নির্ঘুম রাত শেষে ভোর হলো। ঈদের কোনো চিহ্ন নেই পৃথিবীতে। বারান্দা থেকে দেখছি, মুখে মাস্ক পরে কেউ কেউ ঈদের নামাজে যাচ্ছেন। হাতে জায়নামাজ, কিন্তু পরনে পুরোনো পাঞ্জাবি।
আমাদের বিল্ডিং থেকে কেউ যাচ্ছে না নামাজে। গুমোট পরিবেশ, উৎকণ্ঠাময় সময়।

৩০ মে ২০২০
আজ আমাদের বিল্ডিং লকডাউন মুক্ত হলো। ১৪টি দিন সবাই খুব সতর্কতার সঙ্গে দিন পার করেছি। আজ অন্য রকম স্বাধীনতা। সবাই ফোন করে জানাচ্ছে।
যতই স্বাধীন হই না কেন, ভালো থাকতে হলে নিয়ম মানতে হবে, সুশৃঙ্খলভাবে চলতে হবে। নিজেদের স্বাধীনতার মর্যাদা দিতে হবে নিজেকে। নিজেদের নিজে রক্ষা করতে না পারলে কে এসে আমাদের সুরক্ষা দেবে?

নুসরাত সুলতানা, চট্টগ্রাম ডিওএইচএস, চট্টগ্রাম