Thank you for trying Sticky AMP!!

বিষয়: বউ পেটানো!

গ্রামে-গঞ্জে লেখাপড়া না জানা মেয়েরা তো বটেই, শহুরে শিক্ষিত মেয়েরাও স্বামীর হাতে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। কেউ মার খেয়েও মুখ বুজে সহ্য করছেন, কেউবা অকালে প্রাণ হারাচ্ছেন। এটা কি মানা যায়?
১৩ মে, ২০১৩ সাল। স্থান কুমিল্লা সেনানিবাস। চিকিৎসক স্ত্রী শেজাদী আপসাকে পেটাতে পেটাতে মেরেই ফেললেন তাঁর সেনা কর্মকর্তা স্বামী। এমনই অভিযোগ পত্রপত্রিকায় খবর হয়ে হলো। মারধরের ঘটনা সেদিনই প্রথম নয়। আগেও বহুবার বহু কারণে শারীরিক নির্যাতন করেছেন স্বামী। তেমনটাই জানা যায় শেজাদীর পরিবার থেকে। এই নির্যাতনের ফলাফল শেষ পর্যন্ত মৃত্যু।
এই দম্পতির বিয়ে হয়েছিল ২০০০ সালে। তখন থেকেই নানা রকমভাবে তাঁকে নির্যাতন করা হতো। স্বামী-স্ত্রী দুজনই উচ্চশিক্ষিত। তবু কেন এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তাঁদের দাম্পত্য জীবনে।
রুমানা মনজুরের পর শেজাদী। আরও নাম না-জানা অনেকে প্রতিদিন নির্যাতনের শিকার। কিন্তু তাঁদের এভাবে নির্যাতনের ঘটনা আমাদের অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন করে।

এক. মানুষে মানুষে ভিন্নমত থাকতেই পারে। তাই বলে শারীরিক নির্যাতন করতে হবে কেন? নাকি স্ত্রী মানেই ব্যক্তিগত সম্পত্তি! স্ত্রীকে শারীরিক নির্যাতনের মানসিকতা কেবল রিকশাওয়ালা, দিনমজুর বা বস্তির মাদকসেবী শ্রমিকের নয়, এ সমাজের অনেক পুরুষের ভেতর তা প্রোথিত হয়ে আছে, এতে কি তা-ই প্রমাণিত হয়? 
দুই. এ দেশে নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে যে মেয়েটি শেষ পর্যন্ত একজন চিকিৎসক, প্রকৌশলী বা অধ্যাপক হয়েছেন, তাঁকে আমরা দেশের মেধা, সম্পদ ও গর্বই বলব। সেই মেয়ে কেন, কী করে দিনের পর দিন এমন অত্যাচার ও অপমান সহ্য করেছেন? কেন চিৎকার করে প্রতিবাদ করার, শৃঙ্খল ভেঙে বেরিয়ে আসার সাহসটুকু তিনি অর্জন করতে পারেননি? কোন ভরসায় ভালোবাসাহীন এই সংসারে মুখ বুজে মেয়েটি পড়ে ছিলেন তার খবর কি কেউ রেখেছেন? নাকি বাইরের নিরাপত্তাহীনতা, ভ্রুকুটির ভয় আর পারিবারিক, সামাজিক সম্মানহানির ভয় তাঁকে বাধ্য করেছিল সহ্য করতে? 
পরিসংখ্যান খুঁজলেও দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত মেয়েরা নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এ রকম কিছু পরিসংখ্যান জেনে নেওয়া যাক।
৬০ শতাংশ বাংলাদেশি মেয়ে তার জীবনে কোনো না কোনো সময় পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। (সূত্র: আইসিডিডিআরবি, ২০০৬)।
বাংলাদেশের ৬২ শতাংশ স্বামী মনে করেন, স্ত্রীকে যুক্তিসংগত কারণে পেটানো তেমন কোনো মন্দ ব্যাপার নয় (সূত্র: ইমিগ্রেশন অ্যান্ড রিফিউজি বোর্ড, কানাডা)।
বাংলাদেশে যত নারী পারিবারিক নির্যাতনের শিকার, তার ৪৭ শতাংশই সংঘটিত হয় ‘প্রাণাধিক স্বামী’ কর্তৃক (সিপিডি, ২০০৯)।
নিজের বাড়িতে চার ধরনের সন্ত্রাসের শিকার হয় মেয়েরা—শারীরিক (৯৩ শতাংশ), যৌন (১৩ শতাংশ), অর্থনৈতিক (৯১ শতাংশ) ও মানসিক (৮৪ শতাংশ)। (সিপিডি, ২০০৯)। 
বাংলাদেশ শিক্ষা, বিশেষত নারীশিক্ষা সূচকে এগিয়েছে অনেক। কিন্তু বউ পেটানোর এই অদ্ভুত মানসিকতা থেকে কেন শিক্ষিত বা লেখাপড়া না জানা কেউ বেরিয়ে আসতে পারছেন না? সমাজবিজ্ঞান বা আইন একে কোন দৃষ্টিতে দেখে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক শাহ এহসান হাবীব বলেন, ‘আমাদের সমাজে মেয়েদের শিক্ষা দেওয়া হয় যেভাবেই হোক, সংসার টিকিয়ে রাখতে হবে। পরিবারের সম্মান হারানো যাবে না। এ ধরনের ক্ষেত্রে নারীরা এক চরম দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যায়। কারও কারও অর্থনৈতিক ঝুঁকি থাকে, সেটাও বড় কারণ। তার চেয়ে বেশি থাকে সামাজিক সম্মানহানির ঝুঁকি।’
দেখা যায়, নারীরা পরিবার, সমাজ, কর্মক্ষেত্র বা রাষ্ট্রে কোথাও সেই অর্থে সমর্থন পান না। অপর দিকে দমন-পীড়নের একটা মানসিকতা অনেক পুরুষের মধ্যে এমনিতেই গড়ে ওঠে। সেসব পুরুষের মানসিকতা পরিবর্তনের জন্য পারিবারিক শিক্ষাটা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাও। তাহলেই তিনি নারীকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করতে শিখবেন।
২০১০ সালে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে পারিবারিক নির্যাতন (প্রটেকশন অ্যান্ড প্রিভেনশন) বিল পাস হয়। এ ধরনের আইন কি ভবিষ্যতে নারীদের নিজের বাড়িতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে? এই প্রশ্নের উত্তরে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী বলেন, ‘ভালো ভালো আইন থাকা মানেই অপরাধ কমে আসা নয়। এ ধরণের অপরাধ কমানোর জন্য দরকার ব্যাপক সচেতনতা, সম্পূর্ণ নারীবান্ধব প্রশাসন, সমাজ ও রাষ্ট্রযন্ত্রের ভূমিকা।’
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অপর পক্ষ প্রভাব, অর্থ, হুমকি, ধমক যেভাবেই হোক অপরাধ ঢাকতে চেষ্টা করে। আর মেয়েরাও তখন হয়রানির ভয়ে, সম্মানের ভয়ে আপস করতে বাধ্য হয়। এসব অন্যায় আপসের চূড়ান্ত পরিণতি এ ধরনের করুণ মৃত্যু। কয়টি অপরাধের সুবিচার আমরা দেখতে পাই সমাজে যে তা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে ভবিষ্যৎ অপরাধীদের কাছে? এই সমাজে একটি পরিবার একটা মেয়ের জন্য ঝামেলায় জড়াতে চায় না। যত দিন এ পরিস্থিতির উন্নতি না হবে, তত দিন আইন করে কি মেয়েদের নিরাপত্তা বাড়ানো যাবে? তাহলে কি মেয়েরা উচ্চশিক্ষিত হয়েও এভাবে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবে?