Thank you for trying Sticky AMP!!

বৈরী প্রকৃতি ও আবহাওয়ার বিপদে দেশ

এ বছর বাংলাদেশের গত ১০০ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় আম্পান আঘাত হানে

২০২০ সালের বন্যা যেন বাংলা ছোটগল্পের মতো—‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’। গত ২৭ জুন শুরু হওয়া বন্যার পানি একবার বাড়ছে, তো আবার কমছে। এক সপ্তাহ আগে দেশের প্রায় সব এলাকা থেকে পানি নেমে গিয়েছিল। তিন দিন ধরে শুরু হওয়া অঝোর ধারার বৃষ্টিতে আবারও ছয়টি এলাকায় পানি বেড়েছে। দুদিন ধরে উপকূলীয় জেলাগুলোয় জোয়ারের পানি গ্রাম ছাপিয়ে শহর অবধি চলে এসেছে। চট্টগ্রাম, পটুয়াখালীসহ বেশ কয়েকটি জেলার বড় অংশ সরাসরি জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়ে পড়ছে।

চলমান বন্যা এরই মধ্যে ১৯৮৮ সালের বন্যাকে অতিক্রম করে গেছে। এই মাসের বাকি সময়জুড়ে চললে তা ১৯৯৮ সালের বন্যাকেও স্থায়িত্বের দিক থেকে টপকে যাবে।

গত এক সপ্তাহে দুবার বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপ সৃষ্টি হয়েছে, বাংলাদেশ ও ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে মেঘমালা পাঠিয়ে দিয়েছে। এ কারণে বৃষ্টি বেড়ে ব্রহ্মপুত্র ও পদ্মার পানি পঞ্চম দফায় বেড়ে গেছে।


তবে এবারের বন্যার সঙ্গে ১৯৮৮ ও ১৯৯৯ সালের বন্যার মিল খুঁজে পাচ্ছেন নদী ও বন্যা বিশেষজ্ঞরা। একটি বড় অমিলও আছে; দেশের ইতিহাসে উচ্চতা ও স্থায়িত্বের দিক থেকে ওই দুই বন্যা সবচেয়ে মারাত্মক ছিল। চলমান বন্যা এরই মধ্যে ১৯৮৮ সালের বন্যাকে অতিক্রম করে গেছে। এই মাসের বাকি সময়জুড়ে চললে তা ১৯৯৮ সালের বন্যাকেও স্থায়িত্বের দিক থেকে টপকে যাবে। কিন্তু আগের দুই বড় বন্যার সঙ্গে চলমান বন্যার একটি বড় অমিল আছে। আর তা হচ্ছে আগের দুই বন্যায় ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা ও গঙ্গা-পদ্মা অববাহিকায় পানি একসঙ্গে বেড়েছিল। এ কারণে পানি আটকে গিয়ে বঙ্গোপসাগরে নামতে পারেনি। এবার একই সঙ্গে পানি বেড়েছে ব্রহ্মপুত্র ও পদ্মা অববাহিকায়।

দেশের ইতিহাসে অন্যতম বড় বন্যা ছাড়াও এ বছরই বাংলাদেশের গত ১০০ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় আম্পান আঘাত হানে।
চলমান বন্যা এরই মধ্যে ১৯৮৮ সালের বন্যাকে অতিক্রম করে গেছে

অতিরিক্ত বৃষ্টি অবশ্য এই কয়েক মাস ধরেই যে হচ্ছে, তা কিন্তু নয়; চলতি বছরের শুরু থেকেই বৃষ্টি জানিয়ে দিয়েছিল, এ বছরটা বৃষ্টিবহুল হবে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় ইউরোপসহ পশ্চিমা দেশগুলোয় দাবদাহ বইছে, কিন্তু বাংলাদেশ ঘটেছে উল্টো ঘটনা। অর্থাৎ জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত প্রতি মাসেই দেশের বৃষ্টিপাত গত ৩০ বছরের গড়ের তুলনায় বা স্বাভাবিকের তুলনায় ছিল বেশি। আর তাপমাত্রা ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে কম। দেশের ইতিহাসে অন্যতম বড় বন্যা ছাড়াও এ বছরই বাংলাদেশের গত ১০০ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় আম্পান আঘাত হানে। কালবৈশাখী ও বজ্রপাতও এবার ছিল অনেক বেশি।


তবে প্রকৃতির এই রুদ্রমূর্তি যে শুধু বাংলাদেশের মানুষ একাই দেখছে, তা কিন্তু নয়; বিশ্বজুড়েই আবহাওয়া বিক্ষুব্ধ ও চরম আচরণ করছে। এই তো গত রোববার ১০০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করেছে পৃথিবী। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার ডেথ ভ্যালি ন্যাশনাল পার্কে রোববার ১৯১৩ সালের পর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ১৩০ ডিগ্রি ফারেনহাইট (৫৪.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস) রেকর্ড করা হয়। এটিকেই এখন পর্যন্ত পৃথিবীর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বলছে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওয়েদার সার্ভিস (এনডব্লিউএস)।

তবে এ বছরের শুরুতে অস্ট্রেলিয়াজুড়ে প্রায় ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ওঠায় সেখানকার বনভূমিতে দাবানল সৃষ্টি হয়। এরপর ইউক্রেনে ও ব্রাজিলের আমাজানেও একই ধরনের দাবানল তৈরি হয়। ওই আগুনে দেশ তিনটির বিপুল বনভূমি ধ্বংস হয়ে গেছে।


যশোর শহরের বাসিন্দা ও কপোতাক্ষ বাঁচাও আন্দোলনের আহ্বায়ক অনীল বিশ্বাসের মতে, বদ্বীপের মানুষ হিসেবে এই অঞ্চলের অধিবাসীরা ঝড়-জলোচ্ছ্বাস ও বন্যা মোকাবিলা করেই এত দিন টিকে ছিল। এখন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তা বেড়েছে, মানুষের ক্ষতি বেশি হচ্ছে। কিন্তু তা মোকাবিলার জন্য যেভাবে নদীতে বাঁধ দেওয়া হচ্ছে, তা ক্ষতি আরও বাড়াচ্ছে। ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস সামলাতে সুন্দরবনের মতো উপকূলীয় বন হতে পারত আমাদের সবচেয়ে বড় রক্ষাকবচ, কিন্তু তা না করে বন ধ্বংস করে বেড়িবাঁধ দেওয়া হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন অনীল বিশ্বাস। তিনি বলেন, প্রকৃতির পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার জন্য প্রকৃতিবান্ধব পদ্ধতিতে কাজ করা উচিত।

তাপ জমা হচ্ছে সাগরে

দেশে এবার দাবদাহ তুলনামূলকভাবে কম ছিল। এটা যেমন ঠিক, আবার দেশের ভূখণ্ডে তাপের প্রভাব একদম পড়েনি, এটাও বলা যাবে না। এই শতাব্দীর প্রথম ২০ বছরে এরই মধ্যে বিশ্বের তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেছে। বাংলাদেশের মতো দেশে অল্প ভূখণ্ডে প্রচুর অবকাঠামো থাকায় এবং জলাভূমি-বনভূমি কমে আসায় সেই তাপমাত্রা বৃদ্ধির পরিমাণ আরও একটু বেশি। ভূমিতে জমা হওয়া ওই তাপমাত্রা বর্ষার বৃষ্টি ও নানাভাবে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে জমা হয়।


ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, মে মাসে হঠাৎ করে বঙ্গোপসাগরের তাপমাত্রা ১ থেকে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়ে যাচ্ছে। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার পর্যবেক্ষণেও একই ধরনের তথ্য উঠে এসেছে।


যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার পর্যবেক্ষণ অনুযায়ীও বঙ্গোপসাগরের তাপমাত্রা বেড়ে গেছে। দুই সপ্তাহ ধরে আন্দামান সাগর থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকার তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে ১ থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল। এ কারণে সেখানে দ্রুত ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হওয়ার পাশাপাশি প্রচুর জলীয় বাষ্প তৈরি হচ্ছে, যা মৌসুমি বায়ুর সঙ্গে মিশে বাংলাদেশ ও ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে। এ কারণে এখানে বৃষ্টি ও বন্যা বেড়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে মে মাসে এই বাড়তি তাপমাত্রার কারণে বজ্রপাত ও কালবৈশাখীর পরিমাণও বাড়ছে।

ঘূর্ণিঝড় বাড়ছে

আবহাওয়া অধিদপ্তরে সংরক্ষিত ১৯৬০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত দেশে আঘাত হানা ঐতিহাসিক ঘূর্ণিঝড়ের তালিকা ও পরের তিন বছরের ঘূর্ণিঝড়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এই সময়ে মোট ৩৬টি ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশে আঘাত হেনেছে, যার মধ্যে ১৫টি এসেছে মে মাসে।


এই একই কারণে গত ২১ মে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় আম্পান বাংলাদেশ উপকূলে আঘাত হানে। ঘণ্টায় ২২০ কিলোমিটার গতি নিয়ে আসা ওই ঝড়ের বাতাসের বেগ অবশ্য সুন্দরবনের কারণে ৭০ কিলোমিটারে নেমে আসে। এর জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতাও ৩ থেকে ৪ ফুট কমিয়ে দেয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় শ্বাসমূলীয় এই বন।

রেকর্ড বন্যা

গত পাঁচ বছরে দেশে তিনটি মাঝারি থেকে বড় বন্যা হয়ে গেছে। মূলত, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই এমনটা হচ্ছে

ঘূর্ণিঝড় আম্পানের ধকল সইতে না সইতেই গত ২৭ জুন শুরু হয় দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় দীর্ঘতম বন্যা। সাধারণত বদ্বীপ এলাকা ও হিমালয়ের পাদদেশে হওয়ায় বাংলাদেশে প্রতিবছরই বন্যা হয়। স্বাভাবিক বন্যায় সাধারণত দেশের ২০ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয়। এ বছর ৫১ দিন ধরে চলা বন্যায় এরই মধ্যে দেশের ৩৭ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। আক্রান্ত হয়েছে ৯০ লাখ মানুষ।


সরকারের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভূঁইয়ার হিসাব অনুযায়ী, দেশে প্রতি ৭ থেকে ১০ বছর পরপর একটি বড় বন্যা হয়। কিন্তু গত পাঁচ বছরে দেশে তিনটি মাঝারি থেকে বড় বন্যা হয়ে গেছে। মূলত, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই এমনটা হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।


এ বছর বন্যা বেশি হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণ বলছে, ২০২০ সালে বাংলাদেশের উজানে ভারতের আসাম ও মেঘালয়ে স্বাভাবিকের চেয়ে ২৫ ও ২৮ শতাংশ বেশি বৃষ্টি হয়েছে। ফলে তা ঢল হিসেবে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। এতে বন্যার স্থায়ীত্বকাল বেশি হচ্ছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্স স্টাডিজের (বিসিএএস) পৃথক দুটি গবেষণায় দেশের বৃষ্টিপাতের ধরন বদলের চিত্র উঠে এসেছে। তাতে দেখা গেছে, গত ৩০ বছরে দেশের চট্টগ্রাম বিভাগে বৃষ্টিপাত ক্রমাগত বাড়ছে। এতে ওই এলাকায় পাহাড়ধস বাড়ছে। অন্যদিকে, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বৃষ্টিপাত কমে আসছে। প্রাকৃতিকভাবেই লবণাক্ত ওই এলাকায় বৃষ্টি কমায় পানি ও মাটির লবণাক্ততা আরও বাড়ছে। এ কারণে ওই এলাকার ফসলের উৎপাদন কমছে।


আবহাওয়া অধিদপ্তরের ‘বাংলাদেশের জলবায়ু’ শীর্ষক গবেষণার অন্যতম গবেষক বজলুর রশীদের মতে, দেশে বর্ষার আগে বৃষ্টি বাড়ছে। আর বজ্রপাতের পরিমাণও বাড়ছে। বৃষ্টি বেড়ে যাওয়ায় বন্যার পরিমাণও বাড়ছে। এ কারণে সামগ্রিকভাবে জলবায়ু পরিবর্তন দেশে দুর্যোগের পরিমাণ ও তীব্রতা বাড়িয়ে দিচ্ছে।

বজ্রপাতে মানুষ মরছে বেশি

সামনের দিনগুলোয় জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মানুষের ক্ষতি আরও বাড়বে
অধ্যাপক আইনুন নিশাত

বাংলাদেশ দুর্যোগ ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, গত এপ্রিল ও মে মাস তো বটেই, জুনে এসেও বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যু আগের বছরের চেয়ে বেড়ে গেছে। এই দুর্যোগে গত ছয় মাসে মারা গেছে ২২০ জন, যাদের ২৪ জনই শিশু। ২০১৯ সালে সারা বছরে মারা গেছে ২৩১ জন। আর গত ১০ বছরে বজ্রপাতে মারা গেছে ২ হাজার ৭৫১ জন।


অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আশরাফ দেওয়ানের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত দেশে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয়। আর তা সবচেয়ে বেশি আঘাত করে দেশের হাওর এবং উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোয়। এই সময়ে মূলত সন্ধ্যার পর সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয়। এ কারণে বজ্রপাতপ্রবণ এলাকা ও সময়কে বিবেচনায় নিয়ে তা থেকে মানুষের জীবন ও সম্পদ বাঁচানোর উদ্যোগ নেওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।


গত বছর বিশ্বখ্যাত নেচার সাময়িকীতে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বিশ্বজুড়ে বজ্রপাত বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, কোথাও তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে বজ্রপাতের পরিমাণ ১২ শতাংশ বেড়ে যায়। গত ৩০ বছরে বিশ্বের তাপমাত্রা ইতিমধ্যে ১ ডিগ্রি বেড়ে গেছে, ফলে বজ্রপাতও বাড়ছে।


ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত সামনের দিনগুলোয় জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মানুষের ক্ষতি আরও বাড়বে বলে মনে করেন। ফলে, আমাদের সরকার ও জনগণের সামগ্রিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় জলবায়ু পরিবর্তনকে বিবেচনায় আনার পরামর্শ দেন তিনি।