Thank you for trying Sticky AMP!!

ব্যক্তি বিদেশে পাচার হয়েছিলেন, এমন প্রমাণ ছাড়াই অভিযোগপত্র দিচ্ছে পুলিশ

পাচার হওয়া ব্যক্তি বিদেশে পাচার হয়েছিলেন, এমন সাক্ষ্যপ্রমাণ ছাড়াই মানব পাচার মামলার বেশির ভাগ অভিযোগপত্র জমা দিচ্ছে পুলিশ। সাড়ে তিন শর বেশি মামলা পর্যালোচনা করে একটি বেসরকারি সংস্থা এ তথ্য জানিয়েছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক জাস্টিস অ্যান্ড কেয়ার নামের সংস্থাটি এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেছে।
বাংলাদেশে মানব পাচার রোধে দুটি কমিটি রয়েছে। জাস্টিস অ্যান্ড কেয়ার ওই দুই কমিটিরই সদস্য। কমিটি দুটি হলো সরকারি-বেসরকারি সংস্থার সমন্বয় কমিটি এবং রেসকিউ, রিকভারি, রিপ্যাট্রিয়েশন অ্যান্ড ইন্টিগ্রেশন কমিটি। মূলত মানব পাচারের শিকার ব্যক্তিদের উদ্ধার, আইনগত সহযোগিতা এবং পুনর্বাসন করে থাকে জাস্টিস অ্যান্ড কেয়ার।

জাস্টিস অ্যান্ড কেয়ার মোট ৩৫৪টি মামলা পর্যালোচনা করে। এর মধ্যে ১০৮টি মামলা করা হয়েছে ঢাকায়। এর বাইরে খুলনায় ৮৮টি, যশোরে ৪৩, সাতক্ষীরায় ৩৪, বাগেরহাটে ২৬, নড়াইলে ২০, মাগুরায় ১৯ ও ঝিনাইদহে ১৬টি মামলা হয়।

মামলাগুলোর মধ্যে মাত্র আটটিতে ভুক্তভোগীদের বিদেশে পাচারের সাক্ষ্যপ্রমাণ পুলিশ অভিযোগপত্রে যুক্ত করেছে। বিচার পর্যায়ে সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থাপনের সংখ্যা আরও কম। মাত্র তিনটি মামলায় ভুক্তভোগী বিদেশে পাচার হয়েছিলেন, সেই তথ্য আদালত জানতে পেরেছে।

জাস্টিস অ্যান্ড কেয়ারের এ–দেশীয় পরিচালক তারিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, উদাহরণ হিসেবে ভারতের কথা ধরা যাক। ওই দেশে যখন পাচারের শিকার একজন নারী বা শিশু উদ্ধার হয়, তখন প্রথমেই তার একটা বক্তব্য রেকর্ড করা হয়। ওখানেও একটা মামলা হয়। কে উদ্ধার করেছে, কী অবস্থায় উদ্ধার করেছে, সে–সম্পর্কিত বিস্তারিত বিবরণ থাকে ওতে। কিন্তু বাংলাদেশের হাতে এই তথ্যগুলো থাকছে না। উদ্ধারের পর এ দেশেও একটা মামলা হয়। নিয়ম অনুযায়ী, আদালতে অপরাধ প্রমাণের দায় পড়ে ভুক্তভোগীর ওপর। কাগজপত্র না থাকায় মামলা দুর্বল হয়ে যাচ্ছে।

তারিকুল ইসলাম আরও বলেন, ‘আসামিপক্ষের উকিল আদালতে যুক্তি দেন, প্রেমের সম্পর্কে ভেঙে যাওয়ায় ভুক্তভোগী নারী মামলা করে দিয়েছেন। তাঁরা আসলে পারস্পরিক সম্মতিতে ভারতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। আমি নিজে আদালতে এই যুক্তি শুনেছি। যদি ওই দেশে উদ্ধারের কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ থাকত, তাহলে এটা হতো না।’

ভারতসহ বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে পাচারের শিকার ব্যক্তিদের উদ্ধার ও প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশের মিউচ্যুয়াল লিগাল অ্যাসিস্ট্যান্স ট্রিটি (এমএলএটি) রয়েছে। কিন্তু এই চুক্তির বাস্তবায়ন কীভাবে হবে, সে সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকার কোনো উদ্যোগ নেয়নি। মূলত সে কারণেই এ ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে বলে মনে করে জাস্টিস অ্যান্ড কেয়ার। ভারতেরও বিভিন্ন দেশের সঙ্গে এই চুক্তি আছে। এই চুক্তির বাস্তবায়ন কীভাবে হবে, বিভিন্ন পর্যায়ে কোন কর্মকর্তা কোন কাজটি করবেন, তা–ও সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে।

পুলিশের একটি সূত্র বলেছে, পাচারের শিকার ব্যক্তিকে উদ্ধারের জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট ডেস্ক নেই। কেউ নিখোঁজ হলে পুলিশ ইন্টারপোলকে অনুরোধ করে। এর বাইরে পুলিশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অনুরোধ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যে দেশে পাচারের শিকার নারী-পুরুষ অবস্থান করছেন, সে দেশে যোগাযোগ করেন। এতে অনেক সময় চলে যায়। তা ছাড়া মানব পাচারের মামলার সংখ্যা অগণিত। আলাদা আলাদাভাবে প্রতিটি মামলায় নজরদারি করা এককভাবে পুলিশের পক্ষে কঠিন।

মামলা পর্যালোচনায় আরও যা পাওয়া গেল

এই ৩৫৪টি মামলার মধ্যে ১৪৪টি মামলা এক থেকে তিন বছর ধরে ঝুলছে। ১১৬টি মামলা ঝুলছে ৪-৫ বছর ধরে, ৫৫টি মামলা ৬-৭ বছর ধরে এবং ৩৯টি মামলা আট বছর বা এর বেশি সময় ধরে ঝুলছিল। মামলাগুলোর ১৮৩টিই ভারতে পাচার হয়ে যাওয়ার ঘটনায়। এই মুহূর্তে ২২৩টি মামলার বিচার চলছে। দেখা যাচ্ছে, ৭৩ দশমিক ৩৯ শতাংশ ক্ষেত্রে মামলার পক্ষে কোনো সাক্ষী উপস্থিত হননি। কমপক্ষে ৮৫ দশমিক ২৫ শতাংশ ক্ষেত্রে পরিচিত লোকজন পাচার করেছেন, ১০ দশমিক ৮২ শতাংশ ক্ষেত্রে পাচার করেছেন আত্মীয়। মাত্র ৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ ক্ষেত্রে পাচার করেছেন অপরিচিত লোক।

বিচারপ্রক্রিয়ার এ অবস্থা কেন?

যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট প্রতিবছর ‘ট্রাফিকিং ইন পারসন’ শিরোনামে মানব পাচারবিষয়ক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে ৩৪৮টি মামলার বিচারকাজ শুরু হয়, এর আগের বছর এই সংখ্যা ছিল ৪০৩। গত বছর সাতজনের সাজা হয়েছে, ১৪ জন ছাড়া পেয়ে গেছেন। এর আগের বছর ২৫ জনের সাজা হয়েছিল। মোটের ওপর মামলা আছে চার হাজার।

ওই প্রতিবেদনে বিচারপ্রক্রিয়ার এ অবস্থার জন্য বেশ কিছু কারণকে দায়ী করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাচারের শিকার ব্যক্তিদের উদ্ধার ও প্রত্যাবাসনে অন্য দেশগুলোর সঙ্গে জোরালো যোগাযোগ নেই বাংলাদেশের। বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ আন্তসীমান্ত মামলার ক্ষেত্রে সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহে পাচার হয়ে ভুক্তভোগী যে দেশে গেছেন, সে দেশে যান না। তবে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে একটি নৈশ ক্লাবে বাংলাদেশি মেয়েদের পাচারের ক্ষেত্রে সরকারি কর্তৃপক্ষগুলো একজোটে কাজ করে। দেশের ভেতর আরও বেশ কিছু সমস্যার বিচার নিশ্চিতে বাধা সৃষ্টি করে বলে জানাচ্ছে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব জি এস এম জাফরউল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহে সরকারি কর্মকর্তাদের অনীহা নেই। সবাই চেষ্টা করছেন। আর মানব পাচারে সরকারি লোকজনের জড়িত থাকার অভিযোগ তাঁরা পাননি। পেলে ব্যবস্থা নেবেন। ট্রাইব্যুনাল না থাকায় মামলা ঝুলে যায়। সাতটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে। আরও হবে। সমস্যা হলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাদী আসামিপক্ষের সঙ্গে আপস করে ফেলেন।

আপসের কারণ হিসেবে ওয়াকিবহালসূত্রগুলো ভুক্তভোগীদের দারিদ্র্যকে দায়ী করেছেন। অনেকে আবার পুলিশি ঝামেলা এড়াতে চান। তাঁরা সাধারণ ডায়েরিও করতে চান না।

জাস্টিস অ্যান্ড কেয়ার দেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় একটি জেলায় পাচারের শিকার একজন কিশোরীকে আইনগত সহযোগিতা দিচ্ছে। উদ্ধারের পর ভুক্তভোগী নিজ এলাকার একজন ‌‘গণ্যমান্য’ নারীকে আসামি করে মামলা করে। মামলা করার সময় মেয়েটিকে বারবার জেরার মুখে পড়তে হয়। অভিযুক্ত নারীকে শেষ পর্যন্ত পুলিশ গ্রেপ্তার করলেও সাত দিনের মাথায় তিনি জামিন নিয়ে বেরিয়ে আসেন। এসেই প্রথমে ভুক্তভোগী কিশোরীটির পরিবারের বৈদ্যুতিক সংযোগ কেটে দেন। পুলিশ তৎপর হলে অভিযুক্ত নারী কিছুদিনের জন্য চুপচাপ থাকেন।

অন্যদিকে ভারতের বেঙ্গালুরুতে পাচার ও যৌন নির্যাতনের ঘটনায় রিফাদুল ইসলাম ওরফে হৃদয় ওরফে টিকটক হৃদয়কে আসামি করে হাতিরঝিল থানায় দুটি মামলা হয়েছে। কিন্তু ভুক্তভোগী দুজন কিশোরীর স্বজনই বলেছেন, তাঁরা সাধারণ ডায়েরি করেননি। হাতিরঝিল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মহিউদ্দীন ফারুক বলেন, মেয়েরা পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে পালিয়ে আসে। পরিবার কোনো জিডি করেনি।