Thank you for trying Sticky AMP!!

ব্রহ্মপুত্রের পারে হত্যা করা হয় শত শত মানুষ

একাত্তরের গণহত্যা

১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর সকালবেলায় আলবদর নেতা কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে একটি দল যায় ময়মনসিংহের আইএড (আইএ ইন এডুকেশন) হোস্টেলে। সেখানে চূড়ান্ত বর্ষের শিক্ষার্থী মো. আবুল কাসেম ও তাঁর বন্ধু কুতুব উদ্দিনকে চোখ বেঁধে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় আলবদরদের ‘টর্চার সেল’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া ময়মনসিংহ জেলা পরিষদ ডাকবাংলোয়।
সেদিনের কথা মনে করতে গিয়ে গত রোববার মো. আবুল কাসেম প্রথম আলোকে বলেন, ১০ ডিসেম্বর ময়মনসিংহ মুক্ত হওয়া পর্যন্ত তিনি আলবদরদের ওই ক্যাম্পে বন্দী ছিলেন। সেখানে প্রতিদিন ধরে আনা হতো নিরীহ মানুষদের। তাঁদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন ময়মনসিংহের বিশিষ্টজন। ক্যাম্পের ভেতর চলত অমানুষিক নির্যাতন। যাঁদের হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো, তাঁদের ক্যাম্প থেকে বের করে পেছনে ব্রহ্মপুত্র নদের পারে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করা হতো। ভেতর থেকে শোনা যেত গুলির শব্দ আর আর্তনাদ।
মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ইতিহাস গ্রন্থ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ব্রহ্মপুত্র নদে হাঁটুসমান পানিতে নামিয়ে চোখ বেঁধে গুলি করে হত্যা করা হতো ধরে আনা মানুষজনকে। মুক্তিযুদ্ধে শত শত নিরীহ মানুষকে এভাবে হত্যা করেন আলবদর বাহিনীর সদস্যরা।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা জানান, শহরের গোলাপজান রোডের বাসিন্দা টেপা মিয়া, তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ছেলে জহিরুল ইসলাম দারাসহ সাতজনকে কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে আলবদর বাহিনী ধরে নিয়ে যায় জেলা পরিষদ ডাকবাংলোর ক্যাম্পে। রাতভর নির্যাতন শেষে পরদিন কামারুজ্জামানের নির্দেশে টেপা মিয়া, দারাসহ সাতজনকে ব্রহ্মপুত্র নদে নামানো হয়। প্রথমে টেপা মিয়াকে বেয়নেট দিয়ে আঘাত করা হয়। তিনি পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে পালিয়ে বাঁচতে সক্ষম হন। জহিরুল ইসলাম দারাসহ বাকি ছয়জনকে ব্রহ্মপুত্রের পানিতে নামিয়ে গুলি করে হত্যা করে লাশ ভাসিয়ে দেওয়া হয়। আনোয়ার হোসেন সুরুজ ও ক্রীড়াবিদ শাহেদ আলীকেও এভাবেই হত্যা করা হয়েছে।
থানার ঘাট এলাকার বাসিন্দা মাহমুদ হাসান জানান, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাঁর বয়স ছিল ১৭ কি ১৮। তাঁদের বাসা ছিল জেলা পরিষদ ডাকবাংলোর পাশেই। আলবদরদের ভয়ে অনেকেই এলাকা ছেড়ে চলে গেলেও মাহমুদ হাসান রয়ে গিয়েছিলেন। ৪৫ বছর আগের দিনগুলোর স্মৃতিচারণা করে তিনি বলেন, ডাকবাংলোর ভেতর আলবদর ক্যাম্পে নানা বয়সী মানুষদের ধরে আনা হতো। নদের পারে হত্যার দৃশ্য তিনি কখনো চোখে না দেখলেও সন্ধ্যার পর গুলির শব্দ আর আর্তনাদ শুনে বুঝতেন কী ঘটছে। প্রতি সন্ধ্যায় এ রকম গুলির শব্দ আর আর্তনাদ শোনা যেত।
ময়মনসিংহের মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক লেখক বিমল পাল জানান, ১৯৭১ সালে ১৭, ১৮ ও ১৯ এপ্রিল ময়মনসিংহ শহরের নয়টি অবাঙালি কলোনিতে বাঙালি-অবাঙালিদের মধ্যে দাঙ্গা হয়। দাঙ্গায় অগণিত মানুষ প্রাণ হারায়। দাঙ্গার পর অবাঙালিরা পাকিস্তানি সেনাদের কান ভারী করত বাঙালিদের বিরুদ্ধে। যুবক বয়সী বাঙালি দেখলেই অবাঙালিরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে নালিশ করত। এ থেকেই ময়মনসিংহে গণহত্যার শুরু। পরবর্তী সময়ে জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের সেক্রেটারি কামারুজ্জামান ময়মনসিংহ আলবদর বাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড হন। অস্ত্রধারী মূলত কামারুজ্জামানের নেতৃত্বেই পরিচালিত হয় ব্রহ্মপুত্রপারের গণহত্যা। মুক্তিযোদ্ধাদের ধরিয়ে দিলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে পুরস্কার ঘোষণা করা ছিল। টাকার লোভে আলবদররা সাধারণ মানুষজনকেও পাকিস্তানি সেনাদের হাতে তুলে দিত।
২২ এপ্রিল জেলা পরিষদ ডাকবাংলোর সাইনবোর্ড নামিয়ে জেলা শান্তি কমিটির সাইনবোর্ড লাগিয়ে দেওয়া হলেও ডাকবাংলোটি মূলত ছিল আলবদর বাহিনীর ক্যাম্প।
২৩ নভেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী মুসলিম লীগ সমর্থিত স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করে তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়। এরপর থেকে ময়মনসিংহে বেড়ে যায় গণহত্যা।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: দলিলপত্র’র অষ্টম খণ্ডে ময়মনসিংহের গণহত্যা বিষয়ে ১৯৭২ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, ‘ময়মনসিংহের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ব্রহ্মপুত্র নদের এপারে-ওপারে অসংখ্য গর্ত ও অসংখ্য নরকঙ্কাল বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। নরকঙ্কালগুলোর উপরে চট ও কাপড়ের টুকরো টুকরো অংশ। জানা গেছে, বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন ধরে নিয়ে নদীতীরে গুলি করে হত্যা করা হতো। পরে ওই সব লাশের কতক এখানেই মাটিচাপা দিয়ে ফেলতো আর কতক লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হতো।’
একাত্তরের গণহত্যায় নিহত ব্যক্তিদের স্মৃতির উদ্দেশে ২০১১ সালে জেলা পরিষদ ডাকবাংলোর পেছনে নির্মাণ করা হয় স্মৃতিস্তম্ভ। এটি নির্মাণের পর থেকে বেশির ভাগ সময় অবৈধ দখলে ছিল। গত বছরের শেষের দিকে জেলা প্রশাসন অবৈধ দখল উচ্ছেদ করেছে।