Thank you for trying Sticky AMP!!

ভারত-নেপাল সীমান্ত সংঘাত: নেপথ্যে কী

সম্প্রতি (১৩ জুন) প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলির নেতৃত্বাধীন পার্লামেন্টে ২৭৫টি ভোটের মধ্যে ২৫৮ ভোট পেয়ে পাস হয় নেপালের মানচিত্র পরিবর্তনের বিল। প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে ঐতিহাসিকভাবে বিবদমান লিম্পিয়াধুরা, কালাপানি ও লিপুলেখ অঞ্চলকে নিজেদের মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত করার এ বিল প্রেসিডেন্ট বিদ্যাদেবী ভান্ডারী দ্রুততম সময়ের মধ্যে অনুমোদনও করেছেন। নেপালের দীর্ঘদিনের বন্ধু ও প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত এ বিলের অনুমোদন আটকে দিতে জোর তৎপরতা চালিয়েও ব্যর্থ হয়েছে এবং এ নিয়ে তীব্র অসন্তোষ জানিয়েছে। নেপালের এই নতুন মানচিত্র তাদের পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি জাতীয় প্রতীকেও স্থায়ী চিহ্ন হিসেবে বসবে বলে জানিয়েছে সে দেশের সরকার।

বিবাদের শুরু
গত ৮ মে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং উত্তরাখন্ডের ধারচুলা থেকে চীন সীমান্তঘেঁষা লিপুলেখ পর্যন্ত ৮০ কিমি দীর্ঘ একটি রাস্তার উদ্বোধন করেন, যেটি দিল্লি থেকে তীর্থযাত্রার দীর্ঘ পথকে হ্রাস করবে এবং চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক পথ হিসেবেও ব্যবহৃত হবে। উল্লেখ্য, লিপুলেখ হচ্ছে হিমালয়ের একটি গিরিপথ, যেখানে ভারতের উত্তরাখন্ড, তিব্বত ও নেপালের সীমান্ত একসঙ্গে মিশেছে। ভারতের দাবি, রাস্তাটি কৈলাস-মানসসরোবরের প্রাচীন তীর্থপথকেই অনুসরণ করেছে। তবে নেপাল এ দাবি প্রত্যাখ্যান করে জানিয়েছে, লিপুলেখ ঐতিহাসিকভাবে নেপালের ভূখণ্ড এবং রাস্তাটির কমপক্ষে ১৭ কিলোমিটার নেপালের ভূখণ্ড দিয়ে গেছে। হুট করে কোনো আলোচনা ছাড়াই ভারতের রাস্তা উদ্বোধনের ঘটনাকে তারা সার্বভৌমত্বের প্রতি আঘাত হিসেবে চিহ্নিত করেছে। পরবর্তীকালে নেপাল শুধু ভারতের হাইকমিশনকে তলব করে কূটনৈতিক নোট প্রদান করেই ক্ষান্ত হয়নি, সঙ্গে বিবদমান অঞ্চলে নিজেদের নিরাপত্তা বাহিনীও মোতায়েন করেছে। এটি ছিল ভারত ও নেপালের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্কে একট অভূতপূর্ব ঘটনা। কারণ, এ ধরনের পরিস্থিতি এর আগে শুধু পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ে চিঠি চালাচালিতেই শেষ হতো।

সুগাউলি চুক্তি
নেপাল ও ভারতের মধ্যকার সীমানা নির্ধারিত হয় ১৮১৬ সালের ৪ মার্চ ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও নেপালের রাজার মধ্যে স্বাক্ষরিত সুগাউলি চুক্তির মাধ্যমে। এই দুই দেশের মধ্যে প্রায় ১ হাজার ৮০০ কিলোমিটার মুক্ত সীমান্ত রয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ৬০০ কিলোমিটার সীমানাজুড়েই নদী। সুগাউলি চুক্তি অনুসারে, নেপালের পশ্চিমে অবস্থিত মহাকালী নদীই হবে দুই দেশের মধ্যকার সীমানা। আপাতদৃষ্টিতে সহজ এই সীমানায় জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে মহাকালী নদীর উৎস নিয়ে দুই দেশের নীতিনির্ধারকদের ভিন্ন ভিন্ন তত্ত্বের ফলে। নেপালের দাবি, এই নদীর উৎপত্তি হয়েছে লিম্পিয়াধুরা থেকে। যে জায়গা লিপুলেখ থেকে পশ্চিম দিকে অনেক ভেতরে। অন্যদিকে ভারতের দাবি, মহাকালী নদীর উৎপত্তি হয়েছে লিপুলেখ থেকে। এর বিপরীতে নেপাল বলছে, ভারত যে নদীকে মহাকালী নদীর উৎস বলছে, সেটি আসলে ওই নদীরই একটি উপনদী। এদিকে বিতর্কিত ভূখণ্ডটি পড়েছে দুটি নদীর মাঝখানে।

ফলে চুক্তি অনুসারেই নেপাল লিপুলেখ গিরিপথকে নিজেদের দাবি করে আসছে। এদিকে ভারতও গত নভেম্বরে নিজেদের মানচিত্রে কালাপানি অঞ্চলকে অন্তর্ভুক্ত করেছে, নেপাল প্রতিবাদ জানালেও কোনো কর্ণপাতই করেনি তারা। নেপালের দাবি, ১৯৬২ সালে ভারত-চীন যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর থেকে ভারত নেপালের সীমান্তবর্তী ভূখণ্ডে সেনাচৌকি বসানো শুরু করে। যুদ্ধে হারের পরপরই চীনের গতিবিধি দেখার জন্য তারা নেপালের কালাপানিতে সেনাক্যাম্প তৈরি করে, যেখান থেকে পরবর্তীকালে আর সেনা প্রত্যাহার করেনি, বরং সেনাচৌকির সংখ্যা ক্রমেই বাড়িয়েছে। তবে ভারত বরাবরই এ দাবি অগ্রাহ্য করে আসছে। তাদের দাবি, ১৮৭৯ সালে হওয়া ভিন্ন একটি জরিপের মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান করা হয়েছিল এবং নেপালের পূর্ববর্তী রাজারা সেটি জানতেন। চীন কর্তৃক তিব্বত দখলের পর থেকে তারা এই অঞ্চলে সেনাচৌকি বসিয়েছে এবং কখনোই নেপাল কর্তৃক কোনো বাধার সম্মুখীন হয়নি। এর বিপরীতে নেপালের দাবি, ভারত তাদের রাজাকে অনুরোধ করে সেনাচৌকিগুলো রেখেছিল। ফলে তাদের পক্ষ থেকে কোনো আপত্তি তখন ছিল না।

নেপাল কীভাবে ভারতবিমুখ হলো
লিপুলেখ গিরিপথে ভারতের রাস্তা নির্মাণের জের ধরে হঠাৎ করেই নেপালের মানচিত্র পরিবর্তনের মতো তীব্র প্রতিক্রিয়া সাম্প্রতিক কোনো ঘটনা নয়, বরং দীর্ঘদিন ধরে অল্প অল্প করে জমতে থাকা তিক্ততার বিস্ফোরণ। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির কাঠমান্ডু সফরের সময়েও হাজার হাজার নেপালিকে রাস্তায় অভ্যর্থনা জানাতে দেখা গিয়েছিল। অথচ এর ঠিক ১৩ মাসের মাথায় নতুন সংবিধান রচনা নিয়ে ভারতের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়ে নেপাল। ফলে, নেপালের ওপর অঘোষিত তেল অবরোধ আরোপ করে ভারত। নেপালে জ্বালানি তেলের পুরো চালানই আসে ইন্ডিয়ান অয়েল করপোরেশন থেকে, তাদের সব ট্রাক সীমান্তে আটকে পড়ে। সে সময়ে নেপালের ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হয় পরাশক্তি চীন। জ্বালানি তেল আমদানি করতে অনেকটা বাধ্য হয়েই চীনের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয় নেপাল। তখন থেকেই নেপালের সাধারণ জনগণের মধ্যে ভারতবিমুখতা স্পষ্ট হতে শুরু করে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এ ছাড়া ভারত সীমান্তবর্তী ২৩টি জেলার প্রায় ৬০ হাজার হেক্টর জমি ভারতীয় বাহিনী কর্তৃক দখলের অভিযোগ বহুদিন ধরেই করে আসছে নেপাল। এ নিয়ে নেপালের সাধারণ জনগণের দীর্ঘদিনের অভিযোগ কখনো আমলেই নেয়নি ভারত। গত নভেম্বরে ভারত যখন কালাপানি এলাকাকে নিজেদের বলে দাবি করে, তখনো প্রতিবাদ জানিয়েছিল নেপাল। তবে বরাবরের মতোই সেখানে কর্ণপাত করেনি ভারত। এসব ঘটনায় নেপালের সাধারণ জনগণের মধ্যে ভারতের প্রতি একটু স্থায়ী আস্থাহীনতার জায়গা সৃষ্টি হয়েছে, যার বহিঃপ্রকাশ এই প্রতিবাদের মাধ্যমে ফুটে উঠছে।

চীনের ভূমিকা কী
দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বপরায়ণ প্রতিবেশী নেপালের এমন তীব্র প্রতিবাদে ভারতজুড়ে একাধারে বিস্ময় ও উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। ভারতের সেনাপ্রধান এম এম নারাভানে তো সরাসরি বলেই ফেলেছেন যে তৃতীয় একটি দেশ হয়তো নেপালকে উসকে দিয়েছে। এ মন্তব্যে মূলত চীনের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন তিনি। ভারতে অনেক পর্যবেক্ষকও একই রকম সন্দেহ করছেন।

ভারতের এই অনুমান একদম অমূলক নয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় চীন-নেপাল সম্পর্ক ক্রমে কেবল উন্নতি হচ্ছে। চীন ইতিমধ্যে নেপালে বিদেশি বিনিয়োগকারীপ্রধান দেশে পরিণত হয়েছে। স্থলবন্দী রাষ্ট্র নেপাল ২০১৬ সালের এক চুক্তির ফলে চীনের সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করতে পারছে, যা তাদের ভারত–নির্ভরশীলতা অনেকাংশেই কমিয়ে দিচ্ছে। এ ছাড়া নেপালে একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং বিআরআই প্রকল্পের আওতায় নেপালের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও বিভিন্ন মেগা প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে তারা। ফলে ভারতের ওপর থেকে পুরোনো নির্ভরশীলতা ক্রমেই কমাতে যাচ্ছে নেপাল। ভারতের সাবেক কূটনীতিক দেব মুখার্জি, যিনি ২০০০ সাল থেকে দুই বছর কাঠমান্ডুতে ভারতের হাইকমিশনার ছিলেন, এখনই এই বিরোধে চীনের সম্ভাব্য ইন্ধনের প্রসঙ্গ তুলতে রাজি নন। বিবিসির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ১৯৫৪ সালে চীন ও ভারতের মধ্যে যে ‘ঐতিহাসিক’ এক বাণিজ্য চুক্তি হয়, তাতে এই অঞ্চলকে চীন কার্যত ভারতের অংশ বলে মেনে নেয়। ১৯৯৬ সাল থেকে লিপুলেখ দিয়ে ভারত ও চীনের মধ্যে নতুন করে বাণিজ্য শুরু হয়, যা এখনো চলছে। সাবেক এই ভারতীয় কূটনীতিক নেপালের এই প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে প্রধানত তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির সম্পর্ক দেখছেন।

নেপালের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি
২০১৫ সালে নেপালের নতুন সংবিধান প্রণয়নের পর প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন নেপাল কমিউনিস্ট পার্টির কেপি শর্মা ওলি। নেপালি জাতীয়তাবাদের প্রচারের মাধ্যমে প্রতিবেশী ভারতের ওপর থেকে একক নির্ভরশীলতা কমানোর ঘোষণার মাধ্যমেই ক্ষমতায় আসেন তিনি। ‘বেল্ট রোড ইনিশিয়েটিভ’ প্রকল্পের আওতায় চীনা বিনিয়োগের প্রসারের মাধ্যমে অনেকটা সফলও হয়েছেন। এ বছরের শুরুতে তিনি ভারতের বিহারের কিছু অঞ্চল, কালাপানি, লিপুলেখসহ বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড় ও রংপুরের কিছু অঞ্চলও নেপালের আদি সীমানা বলে ঘোষণা দেন। যদিও বাংলাদেশের অঞ্চলগুলো নতুন মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। দুই কমিউনিস্ট পার্টির মিলনের পর অলি প্রধানমন্ত্রী হলেও প্রথম থেকেই তাঁর সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ান মাওবাদী নেতা প্রচন্ড ও মাধব নেপাল। প্রশাসনিক নানা কারণে ওলি জনপ্রিয়তা হারাচ্ছিলেন। দাবি উঠছিল প্রধানমন্ত্রী বদলের। ২০১৯ সালের নভেম্বরে দ্বিখণ্ডিত জম্মু-কাশ্মীরের যে ম্যাপ ভারত প্রকাশ করে, তাতে কালাপানির অন্তর্ভুক্তি অলিকে নতুন সুযোগ এনে দেয়। এরপর রাজনাথ সিংয়ের নতুন রাস্তা উদ্বোধনের প্রতিবাদ জানায় নেপাল। আলোচনার প্রস্তাব দেয়। ভারতের পক্ষ থেকে এরপর কোনো সাড়া দেখা যায়নি, বরং তারা দীর্ঘসূত্রতার আশ্রয় নিয়ে করোনাভাইরাস পরিস্থিতির উন্নতি হলে আলোচনার কথা জানায়। নেপালের রাজনৈতিক মহলে ভারতের এ আচরণ তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। ফলে সরকারি দল ও বিরোধী দল—উভয়েই ভারতের বিপক্ষে শক্ত অবস্থানে চলে যায়।
নেপালি বিশ্লেষকদের যুক্তিতে, ভারতের মূলত আলোচনার সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। কারণ, করোনা মহামারির সময়ে রাস্তা উদ্বোধন করা গেলে আলোচনায় বসাও সম্ভব ছিল। নেপালের সাধারণ জনগণের মধ্যে ২০১৫ সালের অঘোষিত তেল অবরোধের স্মৃতি এখনো টাটকা রয়েছে। ফলে সাধারণ জনগণও ভারতের এ আচরণে অসন্তোষ দেখিয়েছে, যা অলির সমর্থনেই কাজ করছে।

পরিশেষে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জাতীয়তাবাদের তাসেই তাঁকে পরাজিত করতে চলেছেন নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি। দুদেশের সম্পর্কের এ দূরত্ব নিরসনে ভারতকেই দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। ত্রিদেশীয় সীমান্ত মোহনা লিপুলেখে এ ধরনের অচলাবস্থা হয়তো ভবিষ্যতে দোকলাম সংকটের মতো মারাত্মক পরিস্থিতিতে রূপ নিতে পারে। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সুবিধা–অসুবিধা না দেখার সংকীর্ণ ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতির পরিবর্তন না হলে ভারতের প্রভাববলয় থেকে আরও একটি দেশের বেরিয়ে যাওয়া হয়তো অনিবার্য হয়ে দাঁড়াবে। চীনের উপস্থিতিতে যা দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতির নতুন মেরুকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

* শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, তৃতীয় বর্ষ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়