Thank you for trying Sticky AMP!!

ভাষা নিয়ে উৎসব! এ-ও সম্ভব!

চট্টগ্রাম অঞ্চল : মাথায় কত প্রশ্ন আসে!

প্রথম প্রথম শুনলে একটু খটকা লাগে। ভাষা নিয়ে উৎসব! এ আবার কী! নিজ চোখে না দেখলে বোঝানো শক্ত, এ আবার কী! হ্যাঁ, ভাষা নিয়ে উৎসব। ‘এইচএসবিসি-প্রথম আলো ভাষা প্রতিযোগ’ নামে এক যুগ এক বছর ধরে প্রতিবছর দেশব্যাপী অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে এই উৎসব। এখানে ভাষা ও সাহিত্যবিষয়ক একটা নামমাত্র পরীক্ষা হয় বটে, কিন্তু সেটাকে আমরা এবং অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীরা বলে থাকি পরীক্ষা পরীক্ষা খেলা।
এই খেলা ও উৎসবের এবারের অন্যতম ভেন্যু ছিল ফেনী। তারিখ ছিল ৩১ মার্চ। উৎসব পরিচালনার জন্য এবং ছেলেমেয়েদের উৎসবকে আরও অর্থবহ-আনন্দময় করতে ঢাকা থেকে গিয়েছিলেন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঘা বাঘা অধ্যাপক। শুক্রবার সকাল সাড়ে আটটায় আমরা ঢুকলাম ফেনী সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে। স্কুলের গেট দিয়ে ঢুকতেই বয়ে গেল একটা এলোমেলো বাতাস। ভাষা প্রতিযোগের মূল মঞ্চে যাওয়ার আগে বাতাসে দুলে উঠল রাস্তার দুপাশের সবুজ গাছ আর বিভিন্ন রঙের পতাকা। উৎসবের হাওয়া লাগল আমাদের মধ্যেও। স্কুলের মাঠে ঢুকতেই দেখা গেল কুমিল্লার ছেলেমেয়েরা আলাপ জমিয়ে দিয়েছে লক্ষ্মীপুরের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে। আবার চাঁদপুরের অনেকে এবার এসে পেয়ে গেছে গতবারের নোয়াখালীর বন্ধুদের। কে বলবে একটু পরেই জাতীয় সংগীত গেয়ে পতাকা উত্তোলন করে উদ্বোধন ঘোষিত হলেই তাদের যেতে হবে ৪০ মিনিটের পরীক্ষার জন্য রুমে রুমে!

পরীক্ষায় মগ্ন: মানিকগঞ্জ অঞ্চল


আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হলো। এবার সবাই নড়েচড়ে দাঁড়াল। সবার নজর রঙিন বেলুনগুলোর দিকে। বেলুন উড়ল। সবার চোখ নীল আকাশের দিকে। বেলুন দৃষ্টিসীমার বাইরে যেতে না–যেতেই ঘোষণা এল সবাইকে পরীক্ষার হলে যাওয়ার জন্য। পরীক্ষা শেষে শুরু হলো নতুন মজা। মজা এ জন্য যে, শিক্ষকেরা সব সময় প্রশ্ন করেন ছাত্রছাত্রীদের। কিন্তু এখানে ঠিক উল্টো। সঞ্চালক মজা করে বললেন, ‘আমাদের ভয়ে বুক কাঁপছে।’ উপস্থিত শিক্ষার্থীদের মধ্যে হাসির রোল পড়ে গেল। সঞ্চালক বললেন, ‘আমি কি তোমাদের একটা প্রশ্ন করতে পারি?’ সঙ্গে সঙ্গে এক কণ্ঠে আওয়াজ এলে, ‘না, না। আজ আমরা প্রশ্ন করব।’ প্রশ্ন করার জন্য হাত ওঠানোর রেওয়াজ। দেখা গেল অধিকাংশই হাত তুলেছে। অথচ প্রশ্ন করতে পারবে মাত্র ৩০ থেকে ৩৫ জন। কেন এত হাত? জানা গেল, তাদের মধ্যে বাংলা ভাষা আর সাহিত্যবিষয়ক অসংখ্য প্রশ্ন রয়েছে। আজ বড় স্যারদের কাছ থেকে জেনে নিতে চায় এসব প্রশ্নের উত্তর। আর ভালো প্রশ্নের জন্য পুরস্কারের হাতছানি তো আছেই। কিছুক্ষণ প্রশ্ন নেওয়ার পর একজনকে বলা হলো নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় একটি গান করার জন্য। মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বলল, ‘আমার একটা প্রশ্ন আছে স্যার।’ প্রশ্ন করার একই ব্যাকুলতা আমরা লক্ষ করেছি ১ এপ্রিল ও ৭ এপ্রিল অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম আর মানিকগঞ্জের আঞ্চলিক উৎসবেও। তাদের এসব প্রশ্ন শুনে বোঝা যায় প্রশ্নটি তাকে ভোগাচ্ছিল দীর্ঘদিন। আজ উত্তরটি পেয়ে যেন তার ভোগা‌​ন্তির উপশম হলো।

নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় কথা শুনে চারদিকে হাসির রোল

চট্টগ্রামের এক শিক্ষার্থী প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা, রাজনৈতিক স্লোগান বা বিভিন্ন দাবিদাওয়ার যে কথা দেয়ালে দেয়ালে লেখা হয়, এই লেখাকে চিকা মারা বলা হয় কেন?’ সঞ্চালক বললেন, তাই তো! এ তো আমারও প্রশ্ন! উত্তর দিয়ে সে যাত্রায় আমাদের রক্ষা করলেন কবি সাজ্জাদ শরীফ। সিলভার বেলস্ কিন্ডারগার্টেন অ্যান্ড গার্লস হাইস্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী তাহসিন জুলনুন প্রশ্ন করল, ‘যে ভাষার জন্য আমরা প্রাণ দিয়েছি, সেই ভাষার যথাযথ মর্যাদা কি আমরা দিতে পারছি?’ মঞ্চ থেকে শিক্ষক বললেন, ‘তোমার কেন মনে হচ্ছে আমরা পারছি না?’ ছাত্রী তো রীতিমতো অবাক করে দিয়ে বলল, ‘উচ্চশিক্ষা থেকে শুরু করে আদালতের রায় পর্যন্ত সবখানেই ইংরেজির দাপট। বাবা-মা বাংলার চেয়ে ইংরেজি শেখার ওপর গুরুত্ব দেন বেশি। এসব থেকে আমার মনে হয়েছে।’ শিক্ষকের উত্তর পেয়ে মনে হলো বাংলা ভাষা নিয়ে তার উদ্বেগ কেটেছে। ভালো প্রশ্নের জন্য পুরস্কার পেয়ে মন তার আরও যেন ভালো হয়ে গেল। দেখে মনে হলো তার প্রশ্ন করার ইঞ্জিনে যেন জ্বালানি পড়েছে।
ফেনী, চট্টগ্রাম আর মানিকগঞ্জ—তিন অঞ্চলেই বানানবীর নামের বানানের প্রতিযোগিতার অনুষ্ঠান দেখার পর অধিকাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছে, ‘আগামী ভাষা প্রতিযোগে বানানবীরে লড়তে চাই। বানান জানলে এত বাহাদুরি করা যায় আগে বুঝিনি।’ মানিকগঞ্জ সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র এইচ এম হাসিবুল সাকি। সে দ্বিতীয় পুরস্কার লাভ করেছে। তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘এসে কেমন লাগছে?’ সে বলেছে, ‘মানিকগঞ্জে এই প্রথম ভাষা প্রতিযোগ হলো। এসে খুবই ভালো লাগছে।’ দুষ্টুমির সুরে বলল, ‘প্রথমে মনে করেছিলাম ভাষা প্রতিযোগ মানে বুঝি ক্লা‌িন্তকর পরীক্ষা। পরে দেখলাম উৎসব! প্রতিবছর মানিকগঞ্জে আমরা ভেন্যু চাই।’ তার মা এস কে সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষক হাবিবা আহমেদ ছেলের সঙ্গে সুর মিলিয়ে শিশুদের মতোই বললেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, মানিকগঞ্জে প্রতিবছর ভেন্যু চাই।’

ফেনী অঞ্চল : আকাশে উড়ল বেলুন, শুরু হলো উৎসব।

ফেনী ও চট্টগ্রামে গান গেয়ে ছেলেমেয়েদের ভাষার উৎসবকে আরও প্রাণবন্ত করে তোলেন ক্লোজআপ ওয়ান তারকা রাশেদ। আর মানিকগঞ্জে দেশের গান ও নিজের গাওয়া জনপ্রিয় গান গেয়ে শিক্ষার্থীদের উৎসবকে আনন্দঘন করে তোলেন শিল্পী অটমনাল মুন।
ফেনীর একটি দৃশ্য এবারের ভাষা প্রতিযোগকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। এই অঞ্চলে ছাত্রছাত্রীদের একটা বড় অংশ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে রেজিস্ট্রেশন করতে না পেরে শুধু প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশ নিতে এসে বসার সিট না পেয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েও অনুষ্ঠান উপভোগ করেছে। এ এক বিরল দৃশ্য। সঙ্গে অভিভাবকেরাও ছিলেন দাঁড়িয়ে।
ফেনী, চট্টগ্রাম আর মানিকগঞ্জের ভাষা প্রতিযোগ দেখে মনে হয়েছে, ভাষা নিয়েও উৎসব হতে পারে। আর যাঁরা বলেন, তরুণ প্রজন্ম বিপথগামী হচ্ছে, তাদের বলব, আমরা যাদের দেখেছি, তাদের দেখে মনে হয়েছে, এরা থাকলে ‘পথ হারাবে না বাংলাদেশ’। এ কারণেই বিজয়ীদের গ্রুপ ছবি তোলার সময় আমরা সামনে বড় করে লিখে দিয়েছি শিক্ষার্থীদের মনের কথা, বাংলাদেশের স্বপ্নের কথা, ‘আমরা করব জয়’।