Thank you for trying Sticky AMP!!

ভোটের উৎসব নেই মালোপাড়ায়

যশোরের অভয়নগর উপজেলার চাঁপাতলা গ্রামের মালোপাড়ায় পুলিশ ফাঁড়ি। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর ব্যাপক সহিংসতার শিকার হন এখানকার বাসিন্দারা। ছবি: প্রথম আলো

উত্তর থেকে দক্ষিণে বয়ে যাওয়া ভৈরব নদ বড় বাঁক নিয়েছে চাঁপাতলায়। এই নদ চাঁপাতলার মালোদের জীবিকার একটা উৎস। ভৈরবের পশ্চিম পারে মালোদের ছোট্ট পাড়া। নির্বাচনের এই সময়টায় এখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে উৎসব নেই। উল্টো ভোটের আগে–পরে কী হবে তা নিয়ে অনেকের মনে শঙ্কা রয়েছে।

মালোরা মূলত মৎস্যজীবী। মৎস্যজীবীরা অঞ্চলভেদে মালো নামে পরিচিত। চাঁপাতলা গ্রামের মালোপাড়ায় ১১৫টি পরিবারে প্রায় ৭০০ লোকের বসবাস। তাঁদের মধ্যে ভোটার চার শতাধিক। তাঁরা ভোট দেবেন চাঁপাতলা চেঙ্গুটিয়া আলিম মাদ্রাসা কেন্দ্রে। এই কেন্দ্রে ভোটার আছেন প্রায় ২ হাজার ৬০০ জন।

গত শনিবার এই পাড়ায় এসেছিলেন যশোর-৪ (অভয়নগর-বাঘারপাড়া উপজেলা ও যশোর সদর উপজেলার বসুন্দিয়া ইউনিয়ন) আসনের সাংসদ রণজিত কুমার রায়। তিনি এবারও এই আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন। পাড়ার লোকজনকে নির্ভয়ে থাকতে বলে গেছেন। কড়া সুরে এও বলেছেন, মালোরা যেন তাঁদের সমস্যা নিয়ে অহেতুক সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা না বলেন। এরপর থেকে নাকি মালোরা ‘ভালো’ আছেন।

গত রোববার দুপুরে যশোরের অভয়নগর উপজেলার চাঁপাতলা গ্রামের মালোপাড়ায় গিয়ে বিভিন্ন বয়সী নারী ও পুরুষের সঙ্গে কথা বলে প্রথম আলো। তাঁদের অধিকাংশই বলেছেন, ভালো আছেন। কেউ বলেছেন, ‘ভালো না থেকে যাব কোথায়?’

এই মালোপাড়ার বাসিন্দারা ব্যাপক সহিংসতার মুখে পড়েছিলেন ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি একতরফা জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ভোট দেওয়ার অপরাধে সেদিন সন্ধ্যায় জামায়াত ও বিএনপির আড়াই শ থেকে তিন শ নেতা-কর্মী রামদা, হকিস্টিক, রড, লাঠি ও নিয়ে তাঁদের ওপর অতর্কিত হামলা চালান। হামলাকারীরা ১০-১৫টি বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পুরো পাড়ায় আতঙ্ক সৃষ্টি করেন। লোকজন বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে থাকে। পাড়ার শতাধিক বাড়িঘর ভাঙচুর করা হয়। মালামাল লুটপাট হয়। অন্তত ১০টি বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। হামলায় বিশ্বজিৎ সরকার, সুনীল বিশ্বাস, কমল সরকার, সুশীল সরকারসহ অন্তত ২০ জন আহত হন। জীবন বাঁচাতে অনেকে ভৈরব নদ পাড়ি দেন। ঘটনার পর পাড়ায় একটি অস্থায়ী পুলিশ ফাঁড়ি করা হয়।

এ ঘটনায় অভয়নগর থানার পুলিশ ৩৯ জনের নাম উল্লেখ করে এবং দুই থেকে আড়াই শতাধিক অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির নামে মামলা করে। ২০১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ১০০ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করে। মালোপাড়ার বাসিন্দাদের অভিযোগ, হামলাকারীদের অনেকের নাম অভিযোগপত্রে নেই।

ওই হামলায় যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাঁদের অন্তত চারজন আওয়ামী লীগের প্রার্থী রণজিত কুমার রায়ের পক্ষে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট চাচ্ছেন বলে মালোপাড়ার বাসিন্দারা অভিযোগ করেছেন। এমনকি হামলাকারীদের একজন রণজিতের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য, একজন সাংসদের সহায়তায় হতদরিদ্রদের জন্য খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ডিলারশিপ পেয়েছেন। সাংসদের সুপারিশে অন্য এক হামলাকারী চাঁপাতলা চেঙ্গুটিয়া আলিম মাদ্রাসার পরিচালনা কমিটির সভাপতি হয়েছেন। তাঁর নাম মো. কামরুজ্জামান। সুপারিশপত্রে সাংসদ তাঁকে ‘বিশিষ্ট সমাজসেবক, রাজনীতিবিদ, শিক্ষানুরাগী’ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। আসন্ন নির্বাচনে সাংসদের পক্ষে তাঁদের ভোট চাইতে দেখে চাঁপাতলা গ্রামের মালোরা আতঙ্কিত।

অভিযোগের বিষয়ে মো. কামরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, তিনি আওয়ামী লীগ করেন এবং নৌকা প্রতীকের প্রচারণায় আছেন। এমপি সাহেবের সুপারিশে তিনি মাদ্রাসার গভর্নিং বডির (পরিচালনা কমিটি) সভাপতি হয়েছিলেন। তিনি বলেন, মালোপাড়ায় আগুন দেওয়ার ঘটনায় তিনি জড়িত ছিলেন না। ষড়যন্ত্র করে তাঁকে এ ঘটনায় জড়ানো হয়েছিল এবং তাঁকে জেলে পাঠানো হয়েছিল।

>২০১৪ সালের নির্বাচনে মালোপাড়ায় সহিংস হামলা হয়েছিল। সেই স্মৃতি মালোরা ভোলেনি। নির্বাচনে তাঁদের অভয় দেওয়ার চেষ্টা করছে প্রশাসন।

মালোপাড়ার হামলাকারীরাও নৌকার পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছেন, এ বিষয়ে জানতে গত রোববার ও গতকাল সোমবার মুঠোফোনে একাধিকবার সাংসদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কী বিষয়ে বক্তব্য নেওয়া হবে তা উল্লেখ করে তাঁর মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠানো হয়। কিন্তু তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

পরে সাংসদের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক (অভয়নগর উপজেলা) গাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। তিনি বলেন, মালোপাড়ার হামলাকারীরা নৌকার প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন কি না তা তাঁর জানা নেই। তিনি বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখবেন।

পাড়ার কয়েকজন বাসিন্দা প্রথম আলোকে জানান, নির্বাচনের কারণে পাড়ার কয়েকজন বাড়ি থেকে অন্যত্র চলে গেছেন। ৩০ তারিখের নির্বাচনের পর পরিস্থিতি বুঝে তাঁরা বাড়ি ফিরবেন।

গত নির্বাচনের সংহিসতার কারণে অনেকেরই দৃষ্টি এখন মালোপাড়ার দিকে। গণমাধ্যমকর্মীরা সেখানে নিয়মিত যাচ্ছেন। পাড়ার বেশ কয়েকজন অভিযোগ করেছেন, তাঁদের বক্তব্য খণ্ডিতভাবে, ভুলভাবে গণমাধ্যমে প্রকাশ পাওয়ায় তাঁরা চাপের মধ্যে পড়েছেন। এ কারণে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বললেও মালোপাড়ার কেউ নাম প্রকাশ করতে চান না। অন্তত ১০ জনের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের এই অসহায়ত্বের কথা জানা গেছে।

মালোপাড়ার বাসিন্দারা বলেছেন, ধানের শীষ বা অন্য প্রতীকের প্রার্থীরা এই পাড়ায় ভোট চাইতে আসেননি। নৌকার প্রার্থী গত শনিবার এসেছিলেন। তিনি পাড়ার সবাইকে ভোটকেন্দ্রে যেতে বলেছেন। তাঁদের আশ্বস্ত করতে একই দিনে অভয়নগর থানার পুলিশও পাড়ায় এসেছিল।