Thank you for trying Sticky AMP!!

ভোট দিলেও যে ফল, না দিলেও...!

এবারের সিটি ভোটে অনেক কেন্দ্রই এমন চিত্র ছিল। প্রথম আলো ফাইল ছবি

প্রাণের পরশ বা উৎসবমুখর পরিবেশ ছাড়াই ১ ফেব্রুয়ারি শেষ হলো ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। নির্বাচনী মাঠে সর্বত্র দৃশ্যমান ছিল একপক্ষীয় প্রাধান্যের ছাপ। রাজনৈতিক দলের কাজ ভোটারদের সঙ্গে, জনগণের সঙ্গে। কিন্তু ভোটারদের বিমুখ হওয়াটা চিন্তার বিষয়।

নির্বাচন নিয়ে প্রত্যাশার চেয়ে শঙ্কার দাগটাই বেশি মোটা হয়ে উঠেছিল এবং বাস্তবে এরই প্রতিফলন দেখ গেল। নির্বাচনে কে জিতবেন, কে হেরেছেন, কে হবেন নগরপিতা—এসব বিষয় এখন আর মোটেই মুখ্য নয়। নির্বাচনী ফলাফল মানুষ কেবল আগাম বোঝেই না, জেনেও যায়! সাধারণ ভোটাররা এখন মনে করছেন, ভোট দিলেও যে ফল হবে, না দিলেও তা–ই হবে। আওয়ামী লীগের সাধারণ ভোটাররাও মনে করেন, ভোট দিতে না গেলেও তাঁদের প্রার্থী জয় পাবেন। এ কারণে তাঁরাও ভোট দিতে যাচ্ছেন না।

প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) কে এম নূরুল হুদার কথায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ভোটদাতার সংখ্যা ২৫ শতাংশের কিছু বেশি। আর দক্ষিণে ২৯ শতাংশ। কোনো গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনে এত কমসংখ্যক ভোটারের উপস্থিতি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত। খামাখা ইলেকশন নিয়ে এতে হইচই–ডামাডোল করে, আমাদের জীবনের নিরাপত্তা সংশয়ে ফেলে, পরিবেশ দূষণ করে, রাস্তায় জ্যাম বাড়িয়ে, বিপুল অর্থ ব্যয় করে ভোটের আয়োজন করার পর মানুষ যদি ভোট দিতে না চান, তাহলে এ নির্বাচন দিয়ে কী হবে? অনেক বড় অঙ্কের নির্বাচনী ব্যয়ের সঙ্গে জনভোগান্তি করে তামাশা করার কোনো অর্থ হয় না! বাস্তবতা হলো মানুষ নির্বাচনবিমুখ হয়ে নির্বাচনব্যবস্থাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। স্বাধীন গণতান্ত্রিক কোনো সভ্য দেশে নাগরিক অধিকার হরণের এমন প্রদর্শনী মোটেই কাম্য নয়। ভোটের প্রতি মানুষের অনাগ্রহ বা অনাস্থা কোনোভাবেই ভালো লক্ষণ নয়। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশনের ওপর জন-আস্থা ধ্বংস হওয়ার যে উদ্বেগজনক বার্তা ক্রমেই পুষ্ট হচ্ছে, তা কোনোভাবেই স্বস্তির বিষয় নয়।

আমরা মনে করি, নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হতে পারত। কিন্তু রাজনৈতিক দল, প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন—সবাই এ ব্যাপারে আন্তরিকতা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। সাধারণ ভোটারদের মনোভাব রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য ভালো কিছু নয়। নির্বাচন কমিশনের প্রতি এক ধরনের আস্থাহীনতা–অবিশ্বাসের প্রকাশ ঘটিয়েছে মানুষ। বিএনপি কর্মীরা কেন্দ্রে যাননি মামলা-হামলার ভয়ে। কিন্তু আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা কেন যাবেন, যখন তাঁরা বুঝে গেছেন, ভোট দিতে না গেলেও তাঁদের প্রার্থী জয় পাবেন।

নির্বাচনের উৎসব এখন উৎকণ্ঠার বিষয়
একসময় বাংলাদেশে যে নির্বাচনকে তুলনা করা হতো উৎসবের সঙ্গে, তা এখন উৎকণ্ঠার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দলীয় মনোনয়ন, প্রতীক ও টাকাপয়সার ভূমিকাই এখন মুখ্য। চারদিকে সব সুযোগসন্ধানীর ভিড়। ঘাটে ঘাটে এখন সুবিধাভোগীদের উৎপাত। এ সুবিধাবাদীরা কথায় কথায় আদর্শিক নীতিমালা ঝাড়ে। নানা বুলি আওড়ায়। বাস্তব জীবনে তাদের লক্ষ্য বাণিজ্য করে যাওয়া। এতে সর্বনাশটা হয় দেশের। অনেকটা দলেরও। মানুষ আস্থা হারিয়েছে সরকারি নানা সেবামূলক প্রতিষ্ঠান ও সাংবিধানিক কতিপয় প্রতিষ্ঠানের প্রতি। সে প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি সর্বসাধারণের আস্থা হারালে রাষ্ট্র ভীষণভাবে দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেই সময়টা চলছে এখন। গণতন্ত্রে নির্বাচনকে উৎসবে রূপ দেওয়ার নজির বিশ্বের অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের মতো বাংলাদেশেও ছিল। কিন্তু আমরা সে রকমটি দুর্ভাগ্যবশত কী কারণে এখন আর তেমনভাবে প্রত্যক্ষ করতে পারছি না? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সবাইকে, দেশ-জাতির বৃহৎ স্বার্থ ও প্রয়োজনেই। ভোটারদের কম উপস্থিতি গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত। ভোটের প্রতি আস্থাহীনতা তৈরির দায়ভার কারও একার নয়। এখানে সবার ভুলই কমবেশি দায়ী। আমরা একটা জটিল সময় পার করছি। বহির্বিশ্বের আমরা বর্বর জাতিতে পরিণত হচ্ছি। রাষ্ট্র, সরকার, সমাজের বিভিন্ন স্তর এখন প্রশ্নবিদ্ধ। সাধারণ মানুষ হতাশ।

১ ফেব্রুয়ারি দুই সিটির নির্বাচনে অনেক কেন্দ্রে কর্মকর্তারা এভাবে বসে অলস সময় কাটিয়েছেন। প্রথম আলো ফাইল ছবি

আমরা জানি নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ কিংবা প্রশ্নমুক্ত করার জন্য ইসির সংবিধানপ্রদত্ত ক্ষমতা প্রয়োগে কারও মুখাপেক্ষী হয়ে থাকারও কথা নয়। এই অপসংস্কৃতির থেকে মুক্ত হতে না পারাও আমাদের অমঙ্গলের কারণ। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন হয়েছিল, সেই নির্বাচন বাংলার মানুষ অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখেছে।

বুথে বহিরাগতের উপস্থিতি ইভিএমের সাফল্য ম্লান করেছে
নির্বাচন কমিশন ও তাদের সহযোগীদের মুখ্য দায়দায়িত্ব হচ্ছে ভোটাধিকার সুরক্ষা করা। কিন্তু তা করতে দায়িত্বশীলরা এর আগে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন বলেই আজ নির্বাচন নিয়ে এত নেতিবাচক কথা। ভোটারের ভোটাধিকার প্রয়োগে উৎসাহ হারিয়ে ফেলা মোটেও স্বস্তির কোনো বিষয় নয়। অতীতের নির্বাচনগুলোয় যেভাবে অনিয়ম হয়েছে, তাতে ইসি ও আমাদের নির্বাচনপ্রক্রিয়ার প্রতি জন-আস্থা একেবারে তলানিতে ঠেকেছে। ভোটকেন্দ্রের মধ্যে বুথের গোপন কক্ষে বহিরাগতের উপস্থিতি ইভিএমের সাফল্য অনেকটাই ম্লান করে দিয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন। পাশাপাশি সাধারণ ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে বাধাদান, প্রকাশ্যে ভোট দিতে বাধ্য করা ও হুমকি–ধমকি দেওয়ার অভিযোগেও প্রশাসনের ভূমিকা যথাযথ ছিল না বলে অভিযোগ উঠেছে। এ কারণে সুষ্ঠু ভোটের বিষয়ে ইসির ওপর জনগণের আস্থাহীনতা এই ভোটের পরও একই অবস্থায় রয়েছে বলে মনে করেন নির্বাচন বিশ্লেষকেরা।

গত ১০০ বছরের যেকোনো নির্বাচনের তুলনায় এবারের সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে বলে মন্তব্য করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। যদিও বাংলাদেশের ১০০ বছরের ইতিহাস নেই! স্বাধীনতা লাভের ৪৯তম বছরে আমরা। বাকি ৫১ বছরের হিসাব কীভাবে মেলালেন, ক্ষমতাসীন নেতাই তা জানেন। রাজনৈতিক নেতাদের মনে রাখতে হবে, অন্যায়, অনাচার, অবিচার, অত্যাচার জন্ম দেয় জাতির জীবনে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা।

ইভিএমে ভোট দিতে গিয়ে অনেকেই নানান ঝক্কিতে পড়েছিলেন। প্রথম আলো ফাইল ছবি

যে নির্বাচনটা হয়ে গেল, তা স্থানীয় সরকারের নির্বাচন হলেও খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্থানীয় সরকার নির্বাচন। একটি দেশের রাজধানী বলে সরকারের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সরকারের প্রমাণ করার সুযোগ ছিল, একটা স্বচ্ছ নির্বাচন করা গেছে এবং ইভিএমের ব্যবহারে বিভ্রান্তির কোনো অবকাশ নেই। এটা তারা প্রমাণ করতে পারেনি। দেশের মানুষের দৃষ্টি ছিল নির্বাচনের দিকে। বিদেশিদেরও দৃষ্টি কম ছিল না। বিগত জাতীয় নির্বাচনের তুলনায় বিভক্ত ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ভোটের প্রচার নির্বিঘ্নœথাকলেও শেষ পর্যন্ত ভোট গ্রহণ পর্বে সেই ধারা অব্যাহত থাকেনি। ভোটারদের কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় ভোটকেন্দ্রমুখী না হওয়াটাও কোনো সুবার্তা বহন করে না। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোট আয়োজনে ইসি সাংবিধানিক দায়িত্ব প্রশ্নমুক্তভাবে পালন করতে না পারায় নতুন করে নানা প্রশ্ন দেশব্যাপী ঘুরপাক খাচ্ছে।

১ ফেব্রুয়ারি দুই সিটির নির্বাচনে অনেকেই এভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দিয়েছেন। প্রথম আলো ফাইল ছবি

পরিশেষে কথা হলো নির্বাচন নিয়ে নানা রকম সমালোচনা চলবে, বিএনপি ইতিমধ্যে এই নির্বাচন প্রত্যাখ্যানও করেছে। বিশেষজ্ঞরা নানা মতামত দেবেন। কিন্তু তাতে ভোটের ফলাফল বদলাবে না। কিন্তু তারপরও আমরা আশা করব, ঢাকাকে ঐতিহ্যের ঢাকা, সুন্দর ঢাকা, সচল ঢাকা, সুশাসিত ঢাকা ও উন্নত ঢাকা গড়া এবং মানুষের দোরগোড়ায় নাগরিক সেবা পৌঁছে দেওয়ার যে বার্তা প্রার্থীরা দিয়েছিলেন, প্রতিশ্রুতিগুলো তাঁরা মনে রাখবেন। প্রার্থীরা তাঁদের দায়বদ্ধতা থেকে একটি পরিকল্পিত নগরী নির্মাণের প্রত্যয় ও ঢাকাকে একটি মানবিক শহরে পরিণত করার যে অঙ্গীকার করেছিলেন, আমরা আশা করি, সেভাবে কাজ করবেন। নির্বাচিত দুই মেয়রকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানিয়ে বলার কথা এটাই, আপনারা ভোটের আগে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তা অনুগ্রহ করে মনে রাখবেন। ভোটের ত্রুটি–বিচ্যুতি নিয়ে যে সমালোচনা, তা মানুষ ভুলে যাবে, যদি আপনারা নাগরিক জীবনকে স্বস্তিময় করতে পারেন। আপনারা ব্যর্থ হলে, আপনারা অঙ্গীকার ভুলে গেলে, ক্ষতি হবে দেশের, বদনাম হবে দলের।