Thank you for trying Sticky AMP!!

ভোলার কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দী দুই মাস

চারদিকে থই থই পানি। দুই মাস ধরে জোয়ারের পানিতে বন্দী ভোলার প্রায় পাঁচ লাখ পরিবার। ঘরে পানি, গোয়ালে পানি। বাধ্য হয়ে বোরহানউদ্দিনের বড় মানিকা ইউনিয়নের হাসিনা-তাহের দম্পতি গবাদিপশু নিয়ে এই সেতুর ওপর আশ্রয় নিয়েছেন। ছাউনি টানিয়ে সেখানেই চলছে তাঁদের গৃহস্থালির কাজ। গত মঙ্গলবার বিকেলে তোলা ছবি ষ প্রথম আলো

ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার পক্ষীয়া ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কালুমাঝি বাড়িতে ৪০টি ঘর। ভাটার সময় প্রতিটি ঘরে হাঁটুপানি থাকে, আর জোয়ারে গলাপানি। ঘরের মাচাতেই তাঁরা রাত্রি যাপন করছেন। দুই মাসের বেশি সময় ধরে এ অবস্থা চলছে।
দীর্ঘদিন চারদিকে জোয়ার আর বৃষ্টির পানি থই থই করায় পরিবারগুলোর রান্না-খাওয়া-থাকা-চলাচলে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। চুলা পানিতে ডুবে থাকায় বাড়ির সামনে সেতুর ওপর রান্না করছেন কেউ কেউ। সড়ক থেকে সেতু পার হয়ে ঘরে যাওয়ার জন্য উঁচু সাঁকো বানিয়েছেন অনেকে। যাঁরা সাঁকো করতে পারেননি, তাঁরা কলাগাছের ভেলা বানিয়েছেন।

চারদিকে থই থই পানি। দুই মাস ধরে জোয়ারের পানিতে বন্দী ভোলার প্রায় পাঁচ লাখ পরিবার।


ওই বাড়ির বাসিন্দা অজিউল্যাহ মিয়া বলেন, ‘সত্তর সনের বন্য আছিল একদিন। মরছে-বাঁচছে একদিনে শ্যাষ। কিন্তুক এইড্যা কী শুরু অইলো জনম দুক, শ্যাষই অয় না! আর কতকাল থাকপো কইতাম পারি না। আমরা কী পাপ করছিলাম যে সরকার আমগো দিক হিররাও (ফিরেও) চায় না।’ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এমন দুর্ভোগে আছে উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের দুই লাখ পরিবার। শুধু বোরহানউদ্দিন নয়, গত দুই মাস ধরে ভোলা সদর, দৌলতখান, তজুমদ্দিন, লালমোহন, চরফ্যাশন ও মনপুরা উপজেলার ৩৮টি ইউনিয়নের পাঁচ লক্ষাধিক পরিবার কাদাপানির সঙ্গে বসবাস করছে। এসব এলাকার মানুষের ঘরবাড়ি, গাছপালা ধসে যাচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা এখন সড়ক ও সেতুতে আশ্রয় নিচ্ছে। গত ১৬ মে মহাসেনের পর থেকে এমন অবস্থা চলছে ভোলায়।
২৯, ৩০ ও ৩১ জুলাই সরেজমিনে দেখা যায়, মেঘনার তীর সংরক্ষণ বাঁধ না থাকায় জোয়ারের পানি উঠে এসব লোকালয় প্লাবিত হচ্ছে। কমিউনিটি ক্লিনিক ও গভীর নলকূপ, পুকুর, শৌচাগার, ঘরবাড়ি সব ডুবে আছে। মানুষের থাকার ও রান্নার কোনো ঠাঁই নেই। ২৯ জুলাই বোরহানউদ্দিন উপজেলার বাটামারা গ্রামে গিয়ে পাটওয়ারি বাড়ির আঙিনায় কয়েকটি শিশুকে কাদাপানিতে খেলতে দেখা গেল। নাক দিয়ে তাদের সর্দি ঝরছে। ওই এলাকার গভীর নলকূপটিও ডুবে গেছে। ডুবে গেছে হাবিব পণ্ডিতবাড়ি কমিউনিটি ক্লিনিকটি। এলাকায় বেড়েছে পানিবাহিত রোগ। পানিবন্দী মানুষেরা এখন পানির সন্ধানে অন্যত্র যাচ্ছেন।
বাটামারা গ্রামের নয়ামিয়ার বাজারের পল্লি চিকিৎসক শাহ আলমগীর বলেন, কাদাপানিতে ডুবে বানভাসিদের চর্মরোগ, শ্বাসকষ্ট-সর্দি, নিউমোনিয়া, কলেরা, আমাশয়সহ পানিবাহিত রোগ দেখা দিচ্ছে। ক্লিনিকগুলো ডুবে থাকায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ ঠিকমতো চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন না।
ভোলার সিভিল সার্জন ফরিদ আহমেদ জানান, প্লাবিত অঞ্চল পরিদর্শন করে মানুষের দুর্দশা দেখেছেন। জোয়ারের পানিতে ৫০টির মতো কমিউনিটি ক্লিনিক ডুবে আছে। তার পরও তিনি স্বাস্থ্যকর্মীদের ক্লিনিকগুলো খোলা রেখে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সেবা নিশ্চিত করতে বলেছেন। ওষুধের কোনো ঘাটতি নেই। পর্যাপ্ত স্যালাইন ও পানি বিশুদ্ধকরণ বড়ি রয়েছে। এদিকে ভোলা সদর উপজেলার কাচিয়া-ধনিয়া ও পূর্ব ইলিশা এলাকা ঘুরেও একই চিত্র দেখা গেল। প্লাবিত এলাকায় শুধু খাওয়ার পানিই নয়, খাবারেরও অভাব আছে।
পূর্ব ইলিশার ১ নম্বর ওয়ার্ডের মো. শাজাহান বলেন, ‘কাম-কাজ করতাম পানির মাইধ্যে। নদীতে মাছও নাই। ঘরের মানুষ না খাইয়্যা রোজা রাখছে। পোলাপাইন না খাইয়্যা কানতে আছে। কী করুম বুঝি না!’
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্যমতে, গত বর্ষা মৌসুমে, ঘূর্ণিঝড় মহাসেনে ও মহাসেন-পরবর্তী অস্বাভাবিক জোয়ার-জলোচ্ছ্বাসে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আংশিক ক্ষতি হয়েছে আরও ৭০ কিলোমিটার বাঁধ। ওই বাঁধ এ বছর আর সংস্কার বা নির্মাণ করা হয়নি।
পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল হান্নান বলেন, এলাকাবাসী জমি না দেওয়ায় দরপত্র হওয়ার পরও বাঁধ নির্মাণ আটকে আছে। এখানে আরেকটি সমস্যা হচ্ছে তহবিলে টাকা নেই। ঠিকাদার বাকিতে কাজ করতে চায় না।
ভোলার জেলা প্রশাসক খোন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে জানান, জেলায় কী পরিমাণ মানুষ পানিবন্দী সে হিসাব তাঁদের কাছে নেই। তবে জনপ্রতিনিধিরা যে হিসাব দিয়েছেন, সেটাও ঠিক নয়। তিনি আরও জানান, ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সাহায্যার্থে আট মেট্রিক টন চাল ও এক কোটি ২২ লাখ টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। পরিবারপ্রতি এক হাজার টাকা সহায়তা দেওয়া হবে।