Thank you for trying Sticky AMP!!

মনের ক্ষত শুকাচ্ছে না

‘দোকানের ভেতরে ছেলেটা পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেল। চোখের সামনে এ ঘটনা ঘটলেও বাপ হয়ে ছেলেকে বাঁচাতে পারলাম না। এর চেয়ে কষ্টের আর কী হতে পারে? দুঃখ, তিন বছরেও এর বিচার পেলাম না।’ পুরান ঢাকার নিমতলীর আমের দোকানি মামুন মিয়া গতকাল রোববার এভাবে কথাগুলো বলছিলেন। কথা বলার সময় তাঁর চোখ ভিজে আসছিল। আগুনে তিনিও দগ্ধ হয়েছিলেন সেদিন। তিন বছর আগে ২০১০ সালের ৩ জুন রাতে নিমতলীর ৪৩ নবাবকাটরার নিচতলায় কেমিক্যালের গুদামে আগুন লাগে। মুহূর্তে প্রায় আধা কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে ভয়াবহ আগুন। এতে ১২৩ জনের মৃত্যু হয়। দগ্ধ হন কয়েক শ মানুষ। কিন্তু এ ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। শাস্তিও হয়নি কারও। ভুক্তভোগী ব্যক্তিরা এখনো বিচারের আশায় বুক বেঁধে আছেন।

দগ্ধ ব্যক্তিদের অনেকের শরীরের ক্ষত হয়তো শুকিয়ে গেছে এত দিনে। কিন্তু মনের ক্ষত তো শুকাচ্ছে না। ভয়াবহ সেই স্মৃতি যে তাঁরা ভুলতে পারছেন না, তা তাঁদের কথায় বারবার ফুটে উঠেছে।

নিমতলীর ভয়াবহ আগুনে পুড়ে যাওয়া ঘরবাড়ি

 একাধিক বাসিন্দা বলেন, বাসায় ঢুকলে অজানা আতঙ্ক এখনো তাঁদের তাড়া করে ফেরে। হঠাৎ রাতে ঘুম ভেঙে যায়। মানসপটে ভেসে ওঠে প্রিয়জনের মুখ, দুঃসহ স্মৃতি। আশপাশের কোথাও আগুন লাগলে বা আগুনের খবর শুনলে আতঙ্কবোধ করেন। এই ভুক্তভোগী ব্যক্তিদের একটাই দাবি, শত মানুষের মৃত্যুর এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার হোক। গতকাল বিকেলে নিমতলীর ছোট্ট আমের দোকানের সামনে কথা হয় মামুন মিয়ার সঙ্গে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, যা ঘটেছিল, তা ভোলার মতো নয়। তিন বছর আগে ৩ জুন রাত নয়টার একটু আগে তাঁর উল্টো দিকের ৪৩ নম্বর পাঁচতলা বাড়ির নিচতলায় কেমিক্যালের গুদামে আগুন ধরে যায়। তখন তাঁর ছেলে বৈশাখী (৭) দোকানের ভেতরে এবং তিনি রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। মুহূর্তের মধ্যে আগুনের গোলা তাঁর দোকানে ঢুকে পড়ে এবং চোখের সামনেবৈশাখী পুড়ে মারা যায়। আগুনে তাঁর নিজের হাত, পিঠসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ পুড়ে যায়। হাসপাতালে অচেতন ছিলেন দীর্ঘদিন। ছেলের দাফনেও অংশ নিতে পারেননি।

মামুন মিয়া অভিযোগ করেন, গত দুই বছরে সরকারের পক্ষ থেকে তাঁদের খোঁজ নেয়নি কেউ। ঘটনার পর সরকার বলেছিল, কমিটি গঠন করে এ মৃত্যুর বিচার করা হবে। তিনি বলেন, ‘ছেলে হারাইছি। জানি, তাকে আর ফেরত পামু না। কিন্তু বিচার হলে কিছুটা সান্ত্বনা তো পেতাম।’

মামুন মিয়ার দোকানটিতে লেখা, ‘চোখের সামনে আব্বু ডাক দিয়ে চিরতরে চলে গেল বৈশাখী। কী যে বুকভরা কষ্ট নিয়ে ও স্মৃতিমাখা বেদনা নিয়ে আজও এই হতভাগ্য বাবা দোকান চালিয়ে যাচ্ছে।’

বংশাল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আবুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, নিমতলীর মৃত্যুর ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছিল। সেই জিডির সূত্র ধরে ১২৩ জনের মরদেহ ঢাকা জেলা প্রশাসকের নির্দেশে ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফনের জন্য স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

৪৩ নবাবকাটরা, এই ভবনের নিচতলায় অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়েছিল। পাঁচতলা সেই ভবনটি ঘেঁষে নিহত ব্যক্তিদের জন্য স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। গতকাল সেখানে ছিল স্বজনহারা ব্যক্তিদের ভিড়। স্মৃতিস্তম্ভের উল্টো দিকে দোতলা একটি বাড়ি বিধ্বস্ত অবস্থায় পড়ে আছে এখনো। আগুনে সেটির দেয়াল ধসে পড়েছে। এখন পুড়ে যাওয়া কালো চিহ্ন দেয়ালে। আগুনে ওই বাড়ির বাসিন্দা ফরিদউদ্দিনসহ ১১ জনের মৃত্যু হয়। এখন বাড়িটিতে কেউ থাকেন না। বেঁচে যাওয়া ফরিদউদ্দিনের তিন ছেলে পাশের এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন।

এলাকার এমন আরও কয়েকটি ভবনের পোড়া চিহ্ন আজও সে দিনের ভয়াবহতাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। কেউ নতুন করে ঘর ও দোকান বানিয়েছেন। স্বাভাবিক কাজকর্ম করছেন।

গতকাল স্থানীয় মসজিদ থেকে আজ সোমবার আসর বাদ মৃত ব্যক্তিদের জন্য দোয়া ও মিলাদের ঘোষণা দেওয়া হচ্ছিল।

কেমিক্যালের গুদামের পাশে মুদি দোকানে পুড়ে মারা যান দোকানি মো. শফিকের ভাই আবদুর রহিম ও পণ্য কিনতে আসা দুই নারী। পুড়ে ছাই হয়ে যায় দোকানটিও। ওই ভবনে থাকা রহিমের দুটি মেয়েও মারা গেছে সেদিন। শফিক জানান, ঘটনার দুই বছর পর বাড়ির মালিক কেমিক্যালের গুদামটি সরিয়ে দিয়েছেন।

শফিক জানান, ঘটনার পর একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এসে এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত দোকানের তালিকা করেছেন। ক্ষতিপূরণের আশ্বাস দিলেও তিন বছরে তা পাওয়া যায়নি। তিনি বলেন, রহিমের শোকে তাঁর বাবা দৃষ্টি ও স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। দুই বছর আগে তিনি মারা যান। বৃদ্ধা মায়ের কান্না এখনো থামছে না।

ব্যবসায়ীদের অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করে বর্তমান ঢাকার জেলা প্রশাসক শেখ ইউসুফ হারুন গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, দুর্ঘটনায় মৃত ব্যক্তিদের জন্য জেলা প্রশাসনের বরাদ্দ রয়েছে সর্বোচ্চ ২০ হাজার টাকা। অতিরিক্ত অর্থ দিতে হলে সরকারি আলাদা বরাদ্দ লাগে। তিনি বলেন, নথিপত্রে দেখা যায়, ২০১০ সালে নিমতলীর ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত দোকানিদের অতিরিক্ত বরাদ্দ দেওয়া হয়নি।

নিমতলীর বাসিন্দা ও ঢাকা সিটি করপোরেশনের কর্মী মো. ফালান জানান, আগুনে তাঁর বড় বোন পারভীন আক্তার ও দুই ভাগনি মারা গেছেন। তিনি বলেন, এতগুলো মানুষ মারা গেলেন, কেন এ ঘটনায় বিচার হবে না?