Thank you for trying Sticky AMP!!

মনে বড় আশা ছিল যাব মদিনায়...

মক্কা থেকে মদিনার দূরত্ব ৪২৩ কিলোমিটার। যেতে সময় লাগে ছয় ঘণ্টা। চার লেনের একমুখী সড়ক। সবচেয়ে বেশি গতির যানবাহনগুলো চলে সড়কের প্রথম লেন দিয়ে। কম গতিতে চলা গাড়িগুলো চলে ভিন্ন ভিন্ন লেনে। সর্বোচ্চ গতিসীমা ১২০ কিলোমিটার। 


সকাল ১০টায় আমাদের বাসবহর মক্কা থেকে মদিনার উদ্দেশে রওনা দিল। গাড়িতে উঠে বসার পর একটা সুর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। ‘মনে বড় আশা ছিল যাব মদিনায়, সালাম আমি করব গিয়ে নবীরও রওজায়...।’

এই মদিনায়ই প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) চিরনিদ্রায় শায়িত। এই শহরের মানুষ দুর্দিনে নবী করিম (সা.)-কে আশ্রয় দিয়েছিলেন। সেই শহর আমাদের গন্তব্যস্থল।

আগে মদিনার নাম ছিল ইয়াসরিব। নবীর আগমনে আনন্দে উদ্বেলিত জনতা নিজ শহরের নাম বদলে ফেলে রাখলেন মদিনাতুন নবী, অর্থাৎ নবীর শহর।

মক্কা-মদিনার পথে কয়েক কিলোমিটার পরপর রয়েছে যাত্রাবিরতির জন্য বিশ্রামকেন্দ্র। রয়েছে মসজিদ, খাবারের হোটেল। এই পথে বেশি লোকজন যাত্রাবিরতি করে সাসকোতে।

সাসকোতে কথা হলো সৌদি আরবপ্রবাসী বাংলাদেশি সেকান্দারের সঙ্গে। তিনি জানালেন, দেশ থেকে সাত লাখের বেশি টাকা খরচ করে এখানে এসেছেন। তাঁর অভিজ্ঞতা, হজের মৌসুমে জিলকদ, জিলহজ দুই মাসে হাজিদের যাতায়াত বেশি থাকে। এ ছাড়া ওমরাহ, রমজান মাস, বৃহস্পতি ও শুক্রবার লোক বেশি আসে এখানে। যাঁরা বাংলাদেশে দূরপাল্লার বাসে যাতায়াত করেছেন, তাঁরা পথে থাকা এ ধরনের রেস্তোরাঁর সঙ্গে পরিচিত।

বিদেশে পথের মধ্যে এ ধরনের জায়গায় গাড়ি থেকে নামলে গাড়ির নম্বর টুকে নেওয়া খুব জরুরি। হয়তো নামার সময় দেখলেন একটি বা দুটি গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু ২০ থেকে ২৫ মিনিট পরে গাড়িতে ওঠার জন্য এসে দেখলেন, একই চেহারা এবং রঙের বেশ কয়েকটি গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। এ অবস্থায় গাড়ির নম্বর জানা না থাকলে নিজের গাড়ি খুঁজে বের করা কষ্টকর।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, ষোড়শ, সপ্তদশ বা অষ্টাদশ শতাব্দীর দিকে নানা পথে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে মিসরের কায়রো, সিরিয়ার দামেস্ক আর ইরাকের বাগদাদে জড়ো হতেন হজযাত্রীরা। সেখান থেকে স্থলপথে মক্কা-মদিনার দিকে রওনা হতো বিশাল বিশাল হজ কাফেলা। কায়রোর একেকটি দলে নাকি ৩০ থেকে ৪০ হাজার হজযাত্রী থাকতেন। সমুদ্রোপকূলঘেঁষা রাস্তা ধরে আসা এসব কাফেলা মক্কায় পৌঁছাতে সময় লাগত ৩৫ থেকে ৪০ দিন। প্রাচীন ট্রান্স-জর্ডান বাণিজ্যপথ ধরে দামেস্ক থেকে রওনা হতো সিরিয়ার কাফেলা। দামেস্ক থেকে মদিনায় পৌঁছাতে সেই দিনে সময় লাগত এক মাস। দুর্গম মরুভূমি পাড়ি দেওয়ার সময় থাকত নানা প্রতিবন্ধকতা।

ইতিহাস বলছে, প্রায়ই এই অভিযাত্রীদের ওপর হামলা হতো। পরে অবশ্য যেসব গোত্রের এলাকা দিয়ে হজ কাফেলাগুলো যেত, তাদের গোত্রপ্রধানদের সঙ্গে চুক্তি করে হজ কাফেলাগুলোর ভ্রমণ নিরাপদ করত মক্কার কর্তৃপক্ষ। সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতেন আফ্রিকার হজযাত্রীরা। হেঁটে আর নদীপথে হজ করে নিজ নিজ দেশে ফিরে যেতে কারও কারও দুই বছরও লেগে যেত।

মক্কা থেকে মদিনায় আসার পথে রাস্তার দুই ধারে কেবল মরুভূমি। পাহাড় কেটে মাঝখান দিয়ে রাস্তা করা হয়েছে। কখনো কখনো উট বা বানর চোখে পড়ল। কেবল মানুষের দেখা পাওয়া যেন দুষ্কর। বাস ছুটে চলছে। গুল্মজাতীয় ছোট গাছ, কোথাও যত্ন করে লাগানো খেজুরগাছের সারি, আর দল বেঁধে উটদের চলাফেরা। হনুমান বা বেবুন বড় পাথরের ওপরে নির্বিকার বসে আছে পথের কিনারে। কেউ কেউ পলিথিনে ভরা রুটি-কলা ছুড়ে মারছেন। বেবুনরা চমৎকার ভঙ্গিতে তা তুলে নিয়ে পলিথিন থেকে খাবার বের করে খাচ্ছে। কেমন করে এই মরুতে এরা টিকে আছে?

মক্কা থেকে মদিনা যাচ্ছিলেন গোপালগঞ্জের রাজপাট থেকে আসা সৈয়দ আকমাল আলী মীর। তিনি বললেন, ‘এখন ছয় ঘণ্টায় মক্কা থেকে মদিনায় যাওয়া যায়। কোনো কারণে দেরি হলে এক-দুই ঘণ্টা বেশি লাগে, এতেই আমরা অস্থির। আজ থেকে প্রায় ১ হাজার ৫০০ বছর আগে নবীজি ও সাহাবিরা কীভাবে এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছেন, তা ভাবলে অবাক লাগে।’

আমাদের গাড়ি মাগরিবের ওয়াক্তের কিছু আগে পবিত্র মদিনা শরিফে প্রবেশ করল। মন ভরে গেল অনাবিল আনন্দে। শহরে ঢুকেই আমাদের গাড়ি এসে থামল সৌদি সরকারের এক অফিস প্রাঙ্গণে। সেখানে আমাদের পাসপোর্ট ও আনুষঙ্গিক কাগজপত্র দেখা হলো। বিভিন্ন দেশের হাজিদের নিয়ে অনেক গাড়ি একে একে এখানে এসে থামল। আমরা গাড়ি থেকে নেমে অজু করে নির্ধারিত স্থানে গিয়ে নামাজ আদায় করলাম।

ইবনে বতুতার হজযাত্রার বর্ণনা থেকে জানা যায়, অনেক পথ পাড়ি দিয়ে একসময় কাফেলা প্রবেশ করল পবিত্র নগর মক্কায়, পাহাড়ঘেরা এক উপত্যকায়। আর এই পাহাড়গুলোর কারণে বাইরে থেকে চোখে পড়ে না হজরত ইব্রাহীম (আ.)-এর স্মৃতিধন্য এই শহর। হজ সম্পন্ন করার পাশাপাশি এখানে অনেক নতুন অভিজ্ঞতা হলো ইবনে বতুতার। হজের সময়ে হাজার হাজার মুসলমান পুণ্যার্থীর ভিড়ে রীতিমতো গমগম করে পুরো নগর। এ সময় অকাতরে দান-খয়রাত করেন হাজিরা।

হজ করার সূত্রে এখানে অনেক দিন কাটিয়ে দিয়েছিলেন বলে লিখে গেছেন ইবনে বতুতা। তাঁকে মুগ্ধ করেছিল এখানকার লোকদের বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ। তাঁদের পোশাক-আশাকও বেশ পরিচ্ছন্ন। আল্লাহর ঘরের কাছে থাকায় ইবনে বতুতার মনে জন্ম নিল আশ্চর্য এক অনুভব। তাঁর মনে পড়ে গেল মিসরের ইসকান্দারিয়া শহরের সেই দরবেশ বুরহানুদ্দিন ইয়াজের কথা। তিনি বলেছিলেন, হিন্দুস্তান, চীন প্রভৃতি দেশ ভ্রমণ করবেন বতুতা। আবার আল ফাওয়া শহরের অলিও এমনটাই বলেছিলেন। এই দুই ব্যক্তির কথা যেন রোমাঞ্চপ্রিয় ইবনে বতুতার মনের ভেতরে আস্তে আস্তে ডালপালা বিস্তার করা বিশ্বভ্রমণের ইচ্ছাটাকেও বাইরে বের করে আনল। অজানার পথে বেরিয়ে পড়ার তীব্র এক আকর্ষণ তাঁকে অস্থির করে তুলল। হজ শেষে সিদ্ধান্ত নিলেন ইরান-তুরান পার হয়ে আরও দূরের সব দেশ ভ্রমণের। বেরিয়ে পড়লেন তিনি। জন্ম নিল এক কিংবদন্তি।