Thank you for trying Sticky AMP!!

মানুষ মুজিব

মুক্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীন দেশে ফেরার দিনটির স্মৃতিতে ১০ জানুয়ারি ২০২০ তারিখে প্রথম আলো একটি বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছিল। সেটি ছিল তাঁর জন্মশতবর্ষ উদ্‌যাপনে প্রথম আলোর এক বছরের পরিক্রমার সূচনা। সে বর্ষচক্র আজ পূর্ণ হলো। আজ রইল মুক্ত বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে দিল্লি থেকে তাঁর ফিরে আসার অন্তরঙ্গ স্মৃতি।

দেশে ফিরে আবেগাপ্লুত বঙ্গবন্ধু। ­­­দুই পাশে তাজউদ্দীন আহমদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম
সে সময়ে বাসসের বিশেষ প্রতিনিধি আতাউস সামাদ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একই বিমানে ফিরেছিলেন বাংলাদেশে। তাঁর সেই স্মৃতি ১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি বাংলাদেশ অবজারভার–এ প্রকাশিত প্রতিবেদন অবলম্বনে ছাপা হলো।

প্রতিবেদকেরা বহু রাজনীতিককে রাজনীতিক হিসেবেই দেখে থাকেন। কদাচিৎ তাঁদের মানুষ হিসেবে দেখার সুযোগ পান। বিশেষ করে, তাঁদের জীবনের সেসব বিশেষ মুহূর্তে, যখন তাঁরা আত্মপ্রকাশ না করে থাকতে পারেন না।

বাংলাদেশের বিদ্রোহী নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে এমন কিছু মুহূর্তে দেখার বিরল সুযোগ আজ আমি পেয়েছি। কারণ, দিল্লি থেকে ঢাকা আসার পথে আমিই একমাত্র সাংবাদিক হিসেবে তাঁর সঙ্গে ছিলাম। তাঁর বাড়ি ফেরার পথের যেকোনো অংশে একমাত্র সাংবাদিক হিসেবে তাঁর সঙ্গে থাকার এ স্মৃতি কখনোই ভোলার নয়।

শেখ মুজিব দিল্লিতে উড়োজাহাজে প্রথমেই সাক্ষাৎ করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদের সঙ্গে। এর কয়েক মুহূর্ত পর শেখ সাহেব নেমে এলেন। তাঁকে দেখে হতভম্ব হয়ে গেলাম। তিনি এতটাই শুকিয়ে গিয়েছিলেন যে মনে হচ্ছিল, তাঁর গায়ের ওভারকোট কঙ্কালের ওপরে ঝুলছে। তাঁকে যথেষ্ট বিষণ্ন লাগছিল।

তবে গার্ড অব অনার নেওয়ার সময় তাঁকে চৌকসভাবে স্যালুট দিতে দেখে আশান্বিত হলাম। আমার মনোবল আরও বেড়ে গেল যখন তাঁকে বিমানবন্দরে সেই পুরোনো তেজোদীপ্ত স্বরে আগের মতোই আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বক্তব্য দিতে শুনলাম।

নয়াদিল্লিতে বাকি কার্যক্রমগুলোর সময় তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের কোনো সুযোগ ছিল না। বিশেষ উড়োজাহাজটিতে তিনি আসার আগেই আমি উঠে বসলাম। আমি বাদ পড়তে চাইনি। উড়োজাহাজে ওঠার সময় বঙ্গবন্ধুর চলনভঙ্গিতে সেই পুরোনো আত্মবিশ্বাসই প্রতিফলিত হচ্ছিল। তারপরই ঘটনাটা ঘটে গেল। তিনি আমাকে উড়োজাহাজের ভেতরে আবিষ্কার করলেন। সোজা এগিয়ে এসে গভীরভাবে জড়িয়ে ধরলেন। ‘তুমি এখনো বেঁচে আছ।’ বারবার তিনি কথাটা বলছিলেন। তাঁর গলা ধরে আসছিল। পুরোনো একটি মুখ বাংলাদেশের অনেক পুরোনো মুখ তাঁর মনে ফিরিয়ে এনেছে। তিনি আবেগতাড়িত হয়ে পড়লেন।

আমাদের ১৬২ মিনিটের যাত্রায় তিনি বারবার আবেগতাড়িত হয়ে পড়লেন। দিল্লির স্মৃতি পেছনে ফেলে শেখ সাহেব দ্রুতই সামাদ আজাদের কাছে নিজের সহকর্মী ও বন্ধুদের খোঁজ নিতে শুরু করলেন। ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত বন্ধু যশোরের মশিউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের খবরটি শুনে তিনি কান্নায় ভেঙেই পড়লেন।

এরপর তিনি আমার দিকে আবারও ফিরে পরিচিত মানুষদের খোঁজ নিতে শুরু করলেন। তাঁদের কেউ আমার পেশার, আবার কেউ আমার পরিচিত। আমি জানালাম শহীদুল্লা কায়সার, সিরাজুদ্দীন হোসেন, ড. আবুল খায়ের, মিস্টার ভট্টাচার্য (সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য), নাজমুল হক, নিজামুদ্দীন, ডা. ফজলে রাব্বী, জনাব আহাদ (আবদুল আহাদ), সায়ীদুল হাসান, মামুন মাহমুদ, ডা. আলীম চৌধুরী—তাঁরা সবাই চিরতরে হারিয়ে গেছেন। প্রতিটা নাম শোনার সময় তাঁর চেহারায় স্পষ্ট হয়ে উঠছিল অন্তর্বেদনা। তবে তাঁর খোঁজ নেওয়া কিছু মানুষের বেঁচে থাকার খবর দিতে পেরে আমি আর পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিঞ্চিৎ স্বস্তি পেয়েছিলাম।

একটু পর আবিষ্কার করলাম, আধবোজা চোখে তিনি আওড়াচ্ছেন, ‘ছায়া–সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট ছোট গ্রামগুলি।’ দুর্বিষহ স্মৃতির তাড়ার মধ্যেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে কিছুটা সান্ত্বনা দিয়েছিলেন। তবে বেশি সময়ের জন্য নয়। আমরা প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে চলে যাচ্ছিলাম। এর মধ্যে তাঁর প্রচণ্ড প্রাণশক্তিই বিচ্ছুরিত হচ্ছিল। তিনি উৎসাহ নিয়ে আমাদের বলছিলেন, ইয়াহিয়া খানের সামরিক ট্রাইব্যুনালে তিনি কীভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

তিনি বললেন, ‘আমি তাদের বললাম, আমি তোমাদের কাছে বিচার চাই না, কারণ তোমরা এটা দেওয়ার যোগ্য না। আমি সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃপা চাই।’ তিনি বলে চললেন, ‘খোদার ওপর আমার বিশ্বাস আছে। আমার কোনো ভয় নাই। আমি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত আছি, কিন্তু আমি জানি, আমার বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই।’ কিন্তু এই আনন্দময় মুহূর্তটি ক্ষণস্থায়ী হলো।

তিনি আবারও আমার দিকে ফিরলেন, ‘ওরা আমার বাড়ির কী করেছে? জ্বালিয়ে দিয়েছে?’ আমি জানালাম, তাঁর ধানমন্ডির বাড়িতে ডাকাতি হয়েছে। এখনো সেখানে বুলেটের চিহ্ন আছে। তবে বাড়িটি এখনো অক্ষত। সামান্য সংস্কার করলেই বাসযোগ্য হয়ে উঠবে। ‘কিন্তু ওরা আমার গ্রামের বাড়ির কী করেছে? পুড়িয়ে দিয়েছে?’ আমি হ্যাঁ–সূচক জবাব দিলাম। তিনি চুপ হয়ে গেলেন।

এই আলোচনায় বিরতি আসার পর আমি একটু স্বস্তি পেলাম। তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা শুরু করলেন। জানতে চাইলেন, মুক্তিবাহিনীতে তাঁর ছেলেরা কী ভূমিকা রেখেছে। ছেলেদের ভূমিকার কথা শুনে তিনি খুশি হলেন।

আবারও প্রাণবন্ত আলোচনা শুরু হলো। এবার তিনি তাঁর বিখ্যাত নির্দেশনাগুলো পুনরাবৃত্তি করার চেষ্টা করলেন, ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো...তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো।’ এবং ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ আমরা লঘু স্বরে বললাম, সেই একই কথা তাঁর পক্ষে পুনরাবৃত্তি তো সম্ভব নয়। তাঁর সেই বিখ্যাত উদ্দীপনা আবারও ফিরে এল, ‘কিন্তু আমার মানুষেরা তো আমার কথা শুনেছে। তারা যা কিছু ছিল, তাই নিয়েই লড়াই শুরু করেছে।’ উড়োজাহাজে আমরা যারা ছিলাম—পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ফারুক আহমেদ চৌধুরী, ড. কামাল হোসেন, গোলাম মাওলা, আমি আর লন্ডনের ভারতীয় হাইকমিশনের দুই কর্মকর্তা—সবাই আনন্দিত হলাম।

আতাউস সামাদ: প্রয়াত বিশিষ্ট সাংবাদিক