Thank you for trying Sticky AMP!!

মা-বাবার ভিক্ষাবৃত্তি, ইউএনওর কাঠগড়ায় সন্তানেরা

মা–বাবার আর কখনো যেন ভিক্ষার ঝুলি হাতে না নিতে হয়, সে বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. তৌহিদুর রহমান। কাটলা ইউনিয়ন মিলনায়তন, বিরামপুর, দিনাজপুর, ২৮ ফেব্রুয়ারি। ছবি: প্রথম আলো

দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলার কাটলা ইউনিয়নের দক্ষিণ হরিরামপুর গ্রামের বাসিন্দা জানো বালা (৬৫)। অনেক আগেই মারা গেছেন তাঁর স্বামী। জানো বালার তিন ছেলে। তিন ছেলেই বিভিন্ন গ্রামে কৃষি শ্রমিকের কাজ করেন। স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকে কোনো সন্তানই তাঁকে কাছে রাখেননি। বাধ্য হয়ে তাই অন্যের জায়গায় থাকেন তিনি। জীবন চালান ভিক্ষাবৃত্তি করে।

জানো বালার মতো একই অবস্থা ওই গ্রামের খির বালা (৭০) ও নিদ বালার (৬৩)। সন্তানেরা খোঁজখবর না নেওয়ায় তাঁরা ভিক্ষা করে জীবন চালান। বৃহস্পতিবার দুপুরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. তৌহিদুর রহমান কাটলা ইউনিয়ন পরিষদ মিলনায়তনে জানো বালা, খির বালা ও নিদ বালাকে তাঁদের সন্তানসহ ডাকেন। সেই সঙ্গে কাটলা ইউনিয়নে ভিক্ষা করেন এমন ২৫ জন নারী এবং চারজন পুরুষকে তাঁদের সন্তানসহ ডেকে পাঠান। এ ছাড়া দুজন ভিক্ষুকের কোনো সন্তান না থাকায় তাঁদের স্বজনসহ হাজির করা হয়।

সেখানে জানো বালা কান্নাজড়িত কণ্ঠে ইউএনও তৌহিদুর রহমানকে বলেন, ‘ছলের (ছেলের) বউরা কেউ দেখাপা পারে না বা (বাবা)। ওমার (তাদের) অত্যাচারে হামাক আলাদা করে দিছে। ছলগুলা কেউ খাওন–পরোন দেয় না। তাই এই বুড়া বয়েসেও ভিক্ষা করবা নাগে।’ একই অভিযোগ করেন খির বালা ও নিদ বালা।

জানো বালার সঙ্গে আসা ছেলে লক্ষ্মী কান্তের কাছে বৃদ্ধা মাকে ভরণপোষণ না দেওয়ার বিষয়ে জানতে চান ইউএনও। নিরুত্তর থাকেন লক্ষ্মী কান্ত। একইভাবে নিরুত্তর থাকেন খির বালার ছেলে উজ্জ্বল রায় ও নিদ বালার ছেলে কৃষ্ণ রায়।

দক্ষিণ কেশবপুর গ্রামের রহিমা খাতুন (৬২) এসেছিলেন ভাতিজা আলম মিয়ার সঙ্গে। ইউএনওকে রহিমা খাতুন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘খায়ে না খেয়ে চার ছলকে বড় করেচ্ছি। চার ছলের মধ্যে তিন ছলে ঢাকায় গার্মেন্টসে চাকরি করে। আরেক ছেলে ঢাকায় চালায় রিকশা। বড় ছেলের মেয়ের বিয়ের সময় হামার ভাগের জমিটুকু নিয়া বিক্রি করে দিছে। তা–ও ছলের কাছে হামার ঠাঁই হইল না।’ পরে ভাতিজার দেওয়া একটি ভাঙাচোরা ঘরে কোনো রকম ঠাঁই পেয়েছেন রহিমা। কিন্তু জীবন বাঁচাতে ভিক্ষার ঝুলি আর ছাড়তে পারেননি।

মা–বাবা, তাঁদের সন্তান ও স্বজনদের উদ্দেশে কথা বলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। কাটলা ইউনিয়ন মিলনায়তন, বিরামপুর, দিনাজপুর, ২৮ ফেব্রুয়ারি। ছবি: প্রথম আলো

হরিহরপুর গ্রামের আবুল কাসেম (৭৩) ছিলেন গ্রাম পুলিশ। বাবার চাকরির সুবাদে ছেলে নবাব আলী পেয়েছেন গ্রাম পুলিশের চাকরি। কিন্তু এখন বৃদ্ধ বাবার ঠাঁই হয়নি ছেলের সংসারে। তাই জীবনের ঘানি টানতে বাবার সঙ্গী হয়েছে ভিক্ষার ঝোলা।

এ সময় ভিক্ষুক মা–বাবাদের সঙ্গে আসা সন্তানদের কাছ থেকে জানতে চাওয়া হয় মা–বাবার খাবার, চিকিৎসাসহ আনুষঙ্গিক খরচের জন্য মাসে কত টাকা প্রয়োজন? সন্তানদের কাছ থেকে খরচের হিসাব নেওয়ার পর উপস্থিত ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নাজির হোসেনের সঙ্গে পরামর্শ করে সরকারের গৃহীত বিভিন্ন সুবিধাজনক প্রকল্পের আওতায় ওই মা–বাবাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ ছাড়া স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কিস্তিতে বেশ কিছু ভ্যানগাড়ি কিনে দেওয়ার উদ্যোগ নেন ইউএনও। সন্তানদের মা–বাবাদের প্রতি নৈতিক দায়িত্ব সম্পর্কে বোঝান তিনি। মা–বাবাদের সঙ্গে আসা সন্তান, স্বজনেরা তাঁদের মা–বাবা ও স্বজনদের আর ভিক্ষা করতে দেবেন না বলে প্রতিশ্রুতি দেন।

ইউএনও তৌহিদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মানুষ দিন দিন নৈতিক দায়িত্ব ও মূল্যবোধ থেকে দূরে সরে যাওয়ার কারণে পারিবারিক বন্ধন আলগা হয়ে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠিত সন্তান-স্বজন থাকার পরও বৃদ্ধ বয়সে মা–বাবারা নিঃস্ব হয়ে অমানবিক জীবন যাপন করছেন। ভিক্ষাবৃত্তির মতো পথও বেছে নিচ্ছেন। ভিক্ষাবৃত্তির জন্য আর্থিক অভাব নয়, নৈতিক শিক্ষা আর মূল্যবোধের অভাব। আর্থসামাজিক উন্নয়নে বর্তমান সরকার ব্যাপক কর্মসূচি ও প্রকল্প গ্রহণ করেছে। সেই সঙ্গে ভিক্ষুকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে ভিক্ষুকদের পুনর্বাসনে প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকারমূলক প্রকল্প রয়েছে। এর আওতায় অচিরেই তিনি বিরামপুরকে ভিক্ষুকমুক্ত করতে পারবেন বলে জানান।