Thank you for trying Sticky AMP!!

মা দিবস মহিমান্বিত হোক ব্যক্তি মায়ের অর্জনেও

আমার মা একজন মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে ভারতের আগরতলায় উদ্বাস্তু হিসেবে আশ্রয় নেওয়া বাঙালি নারীদের প্রথম যে দলটি নার্স হিসেবে প্রশিক্ষণ নিয়েছিল, তিনি তাদের একজন। পুরো মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আম্মু আহত ও ক্ষতবিক্ষত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করেছেন। অথচ তখন তাঁর বয়স খুবই কম, মাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। আমার শাশুড়ি একজন অবসরপ্রাপ্ত মাদ্রাসাশিক্ষক। ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ করতেন না, তাই তিনি কখনো বোরকা গায়ে মাদ্রাসায় যাননি। তিনি স্কার্ফ বা আঁচল দিয়ে চুল ঢেকে রাখতেন। কুড়িগ্রামের মতো এত প্রত্যন্ত অঞ্চলে একজন মাদ্রাসার শিক্ষিকার পক্ষে এটা অনেক সাহসী একটা পদক্ষেপ ছিল বটে।

আমার সরকারি কর্মকর্তা দুই ফুফুর একজন তাঁর ৬ মাস বয়সী সন্তানকে আরেক বোনের কাছে রেখে জাপানে গিয়েছিলেন পড়তে। আরেক ফুফুর এমনও দিন গেছে, বাসায় গৃহসহকারী আসেননি, অথচ অফিসে যেতেই হবে। ছোট্ট দুই শিশুসন্তানকে সঙ্গে নিয়ে বস্তিতে গিয়ে গৃহসহকারীকে খুঁজে বের করে তারপর তাঁকে দুই শিশুসহ বাসায় রেখে তিনি অফিসে গেছেন। কাজের প্রতি এই অসাধারণ নিষ্ঠার কারণে আজ তারা দুজনই যে অবস্থানে পৌঁছেছেন, তা যেকোনো বিসিএস কর্মকর্তার সারা জীবনের স্বপ্ন। আমার খালা দাবা অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশের একমাত্র গোল্ড মেডেলিস্ট। আমার দুই কাজিনের জন্মের পর তিনি খেলা ছেড়ে দেন। কিন্তু সংগঠন ছাড়েননি। কাস্টমস অফিসার ছিলেন। অফিসের পর যেতেন স্টেডিয়ামে। সন্ধ্যার পর বাসায় ফিরে ঘরসংসারের সব কাজ করতেন। শুধু তা-ই নয়, ১২ ভাই-বোনের মধ্যে ১১তম ছিলেন, কিন্তু আমার নানা-নানু তাঁদের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই খালার কাছেই ছিলেন।

এতগুলো কথা লিখলাম শুধু একটি কারণে, মা মানেই শুধু শর্তহীনভাবে ভালোবেসে যাওয়া, নিজের সুখ বিসর্জন দিয়ে সন্তান পালা আর নীরবে পরিবারের দায়িত্ব পালন করে চলা একজন মানুষ নন। আমাদের মায়েদের নিজের ব্যক্তিপরিচয়ও আছে। জীবনের নানা বাঁকে তাঁদের সফলতা আছে। যুদ্ধ জয়ের গল্প আছে। চাকরিজীবী হওয়া মায়েদের সফলতাগুলো তাও কিছুটা চোখে দেখা যায়। গৃহবধূ মায়েদের অবদানকে তো আমরা গণনাতেই ধরি না। আমরা ধরেই নিয়েছি যে নারীমাত্রই সংসারের জন্য বেগার খাটবে আর সন্তান পালবে! আমরা ভুলে যাই বা স্বীকার করতে চাই না যে মা মানেই শুধু মাতৃত্ব নয়, তিনি একজন ব্যক্তিও বটে। আমাদের সমাজে একজন মা নিজের পরিচয়ে পরিচিত হতে চাইলে, সমাজে নিজের জায়গা তৈরি করতে চাইলে চারপাশের মানুষেরা তাই তাঁকে বারবার বাধা দিয়ে বলে, ‘তুমি খারাপ মা। তোমার সন্তান পালনের যোগ্যতা নেই।’

আসুন মা দিবসে (সম্প্রতি পালিত হলো) তাই শুধু মায়েদের আদর-স্নেহ-ভালোবাসার কথা স্মরণ না করে ব্যক্তি মায়ের অর্জনগুলোকেও সবার কাছে তুলে ধরি। মনে রাখবেন, প্রতিটি সন্তানেরই মনে হয় তার মায়ের মতো এত ভালো তাকে আর কেউ বাসে না, মায়ের মতো এত ভালো রান্না আর কেউ করতে পারে না। আমরা সবাই মায়ের শরীরের একটা অংশ, তাই মায়ের প্রতি আমাদের মধ্যে এক ধরনের অন্ধ ভালোবাসার অনুভূতি কাজ করবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই অনুভূতির বাইরে গিয়ে আপনি যদি আপনার মায়ের সাফল্যে গর্বিত হন, হোক তা তাঁর চাকরিক্ষেত্র বা সাংসারিক কোনো ভূমিকা, তাহলে শুধু তাঁর মাতৃত্বের গুণাবলিকে নয়, বরং ব্যক্তি হিসেবে মায়ের সেই অর্জনগুলোর কথাও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করুন। সেগুলোকে অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দিন।

মা বলতেই আমরা যে সর্বংসহা বা দুর্বল মানুষটিকে বুঝি, সেই ধারণা থেকে আমাদের অবশ্যই বের হয়ে আসতে হবে। আমি মাকে এত ভালোবাসি অথচ মা দিয়ে শুরু হওয়া গালি আমার ঠোঁটের আগায় থাকে, এটা খুব নিম্ন শ্রেণির মানসিকতা। এই গালিগুলোর উদ্ভবও কিন্তু হয়েছে সমাজে নারী তথা মাকে নিম্ন শ্রেণির মনে করার মানসিকতা থেকেই। একবার চিন্তা করে দেখুন, আমাদের অনেকেরই মা আছেন যিনি চাইলে পড়াশোনা করে অনেক বড় চাকরি করতে পারতেন, কেউ আছেন গায়িকা হতে পারতেন, কেউ হতে পারতেন লেখক কিংবা বিজ্ঞানী। মা দিবসে তাই শুধু মায়ের আদর আর রান্নার প্রশংসা না করে বা তাঁর সর্বংসহা মানসিকতার গুণগান না গেয়ে বরং আপনাকে পালতে গিয়ে তিনি যা হতে পারেননি, সেই আত্মত্যাগকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করুন আর প্রতিজ্ঞা করুন, আপনার কন্যা, স্ত্রী বা বোনকে শুধু মাতৃত্বের মধ্যে আটকে না রেখে তিনি যেন ব্যক্তি মানুষ হিসেবে নিজের একটি পরিচয় তৈরি করতে পারেন, সে বিষয়ে আপনি তাঁকে সর্বাত্মক সহায়তা প্রদান করবেন। তাই আজ থেকে মা দিবস হোক মাতৃত্ব নয় বরং মাকে ব্যক্তিমানুষ হিসেবে মহিমান্বিত করার একটি দিন।

*উপমা মাহবুব, লেখক এবং উন্নয়ন পেশাজীবী
m_upoma@yahoo.com