Thank you for trying Sticky AMP!!

মুক্তিযোদ্ধা টাওয়ারে অবৈধ দখল

ঢাকার মোহাম্মদপুরে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নির্মিত ভবন ‘মুক্তিযোদ্ধা টাওয়ার–১’।

যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নির্মাণ করা ‘মুক্তিযোদ্ধা টাওয়ারে’ ৮৪টি ফ্ল্যাট বরাদ্দে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। তাঁদের দেওয়া ৩৩টি ফ্ল্যাটের মধ্যে ২৬টি ফ্ল্যাটই ১৩ জন দখল করে নিয়েছেন।

অন্যদিকে ৫১টি ফ্ল্যাট এখন পর্যন্ত বরাদ্দ দেওয়া হয়নি, কিন্তু তা-ও দখল করে বসবাস শুরু করেছেন। তাঁদের মধ্যে ১০ জনের নামেই সরকারি বাড়ি, ফ্ল্যাট ও জমি রয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, এঁদের মধ্যে অনেকে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা তো ননই, মুক্তিযোদ্ধাও নন।

জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বিষয়টি স্বীকার করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সবাইকে ডেকে শুনানি ও তদন্ত করেছি। এঁদের অনেকেই অনুমতি না নিয়ে টাওয়ারে জোর করে উঠে গেছেন। কেউ কেউ মাঝখানের দেয়াল ভেঙে দুটি ফ্ল্যাট জবরদখল করে নিয়েছেন। সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তৈরি করা এ টাওয়ারে মুক্তিযোদ্ধা নন এমন লোকও ঢুকে গেছেন। আমরা তাঁদের নোটিশ দিয়েছি ভবন ছাড়ার জন্য। স্বেচ্ছায় না ছাড়লেও অবৈধভাবে ফ্ল্যাট দখল করা ব্যক্তিদের উচ্ছেদ করার জন্য যা যা করতে হয়, তা করব।’

প্রসঙ্গত, ঢাকার মোহাম্মদপুরে গজনবী রোডে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে আবাসিক ও বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের জন্য এই টাওয়ার নির্মাণ করা হয়। এর নাম দেওয়া হয় মুক্তিযোদ্ধা টাওয়ার-১।

মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভবন নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার পরপরই মুক্তিযোদ্ধা টাওয়ারের ৮৪টি ফ্ল্যাটের মধ্যে ৩৩টি বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু এই ৩৩টি ফ্ল্যাটের ২৬টি দখল করে আছেন ১৩ জন। সব মিলিয়ে ৩৩ ফ্ল্যাট ২০ জনের দখলে আছে। কল্যাণ ট্রাস্ট বলছে, এর মধ্য ১৯ জনই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা নন এবং অনেকের বিষয়ে অধিকতর তদন্ত হচ্ছে। বাকি ৫১ টি ফ্ল্যাট কাউকে বরাদ্দই দেওয়া হয়নি। এই ৫১ ফ্ল্যাট বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের জন্য রাখা হয়। কিন্তু বরাদ্দ বা অনুমতি না নিয়ে ওই ৫১ ফ্ল্যাটও ৩৯ জন দখল করে আছে। তাঁরা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা কিনা তা নিয়ে এখন তদন্ত করছে মন্ত্রণালয়।

মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের কর্মকর্তা ও প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা প্রথম আলোকে বলেন, মুক্তিযোদ্ধা টাওয়ার নির্মাণের পরিকল্পনায় এই ভবনকে বিশ্রামাগার হিসেবে ব্যবহার করার কথা ছিল। পরে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার পুনর্বাসনের কথা চিন্তা করে ৩৩টি ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের অব্যবস্থাপনায় ধীরে ধীরে সব বেদখল হয়ে যায়।

মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আজহারুল হক প্রথম আলোকে বলেন, মাত্র নয়জন নীতিমালা অনুযায়ী এই টাওয়ারে থাকছেন। আর বাদবাকিদের ক্ষেত্রে নানা ধরনের অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। আজহারুল হক বিগত আমলে কল্যাণ ট্রাস্টের অব্যবস্থাপনার কথা উল্লেখ করে বলেন, এসব অব্যবস্থাপনার জন্য দায়ী কে, তা খুঁজে বের করতে কমিটি করা হয়েছে। কমিটি কাজ করছে।

 যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ

গত ১৯ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা টাওয়ারে সরেজমিনে গেলে দেখা যায়, দুটি ফ্লোর ইয়াবা ব্যবসা ও সেবনকারীদের আস্তানা হিসেবেও ব্যবহার করা হচ্ছে। ভবনের ক্লাবে চলছে বহিরাগতদের জুয়া খেলা। মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের অব্যবস্থাপনা ও অবহেলার কারণে এ অবস্থার তৈরি হয়েছে বলে মন্তব্য বলেছেন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা।

পাবনার কেয়াম উদ্দিন মোল্লার ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা আছে, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সন্দেহজনক মনে হওয়ায় তাঁর বিষয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। এই অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্বাধীনতার পর থেকে আমরা এখানে বসবাস করছি। এখন বর্তমান মন্ত্রী এসে এসব যা-তা বলছে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর উদ্দেশে তিনি বলেন, পারলে এ ভবনের সামনে আসুক। পুলিশও আমাদের ওঠাতে পারবে না। যাঁদের বাড়ি আছে তাঁদের কেন ফ্ল্যাট বরাদ্দ দিল কল্যাণ ট্রাস্ট? কল্যাণ ট্রাস্টের কর্মকর্তাদের এখন বিচারের আওতায় আনা উচিত। তবে তিনি স্বীকার করেন, টাওয়ারের অনেকেই দুটি করে ফ্ল্যাটে থাকছেন, এমনকি তিনি নিজেও।

কেয়াম উদ্দিন মোল্লা এই টাওয়ারের যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা পরিবার পুনর্বাসন বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতিও। তাঁর কাছে টাওয়ারে ইয়াবা ব্যবসা ও সেবনের বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, ‘বিষয়টি আমরা পুলিশকে জানিয়েছি। কিন্তু কিছু করে না।’ কারা এরা— জানতে চাইলে বলেন, আমাদের টাওয়ারের লোকও আছে, বাইরের লোকও আছে।’

বগুড়ার আবু শহীদ বিল্লাহ যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি দুটি ফ্ল্যাট দখল করে আছেন। জানতে চাইলে প্রথম আলোকে আবু শহীদ বলেন, ‘আমি মুক্তিযোদ্ধা, এসব তদন্ত করে কিছু পাবে না। কিন্তু অনেক অমুক্তিযোদ্ধা এই টাওয়ারে আছে, এটা ঠিক।’ তিনি স্বীকার করেন, টাওয়ারের দুটি ফ্ল্যাট তিনি দখল করে আছেন।

সিরাজগঞ্জের চাঁদ মিয়া বরাদ্দপ্রাপ্ত ফ্ল্যাটের পরিবর্তে অন্য একটি ফ্ল্যাট দখলে রেখেছেন। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা কি না, তদন্ত হচ্ছে। তাঁর নামে রূপনগরে আড়াই কাঠা জমি বরাদ্দ আছে। জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার রূপনগরের বাড়ি আমি কিনেছি।’ তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘৭২ সাল থেকেই আমাদের নিয়ে তদন্ত হচ্ছে। ’

 টাওয়ারে বসবাসরত মুক্তিযোদ্ধা ঢাকার দোহারের গোলাম মোস্তফা বীর বিক্রমের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি কাউকে ভয় পাই না। টাওয়ারে অনেক অমুক্তিযোদ্ধা আছে, এটা সঠিক।’ নীতিমালা মানা হয়নি মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘এসব অমুক্তিযোদ্ধার ব্যাপারে কেন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না, তা আমরা জানতে চাই।’ ক্ষোভ প্রকাশ করে গোলাম মোস্তফা আরও বলেন, ‘এই ভবনে ইয়াবা বিক্রি, খাওয়া, জুয়া সব চলে। এসব বন্ধ করতে সরকারের সহযোগিতা চাই।’

জানা গেছে, টাওয়ারে বসবাসরত ঢাকার বেগম বছিরন নেছা, মাগুরার ফুল মিয়া, যশোরের আবদুল মাজেদ, নোয়াখালীর তারেক উল্লাহ, যশোরের কালিপদ দাস, যশোরের ফজলুল করিম, মাগুরার চৈতন্য যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা কি না, তা তদন্ত হচ্ছে। নেত্রকোনার আবু ছিদ্দিক, নেত্রকোনার মাইনুল হক, নরসিংদীর সিরাজুল ইসলাম, সুনামগঞ্জের সহিদ আলী, নরসিংদীর আবদুর রহিমও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা বলে প্রমাণিত হয়নি মন্ত্রণালয়ের তদন্তে।

কুমিল্লার ফরিদ মিয়া যুদ্ধাহত প্রমাণ হয়নি। তাঁর নামে মিরপুরেও দুটি প্লট বরাদ্দ করা হয়েছে। চুয়াডাঙ্গার মনোয়ারা বেগম দুটি ফ্ল্যাট দখলে রেখেছেন। তাঁদের বিষয়ে তদন্ত হচ্ছে। খুলনার লিবিও কিত্তনীয়া দুটি ফ্ল্যাট দখলে রেখেছেন। তিনি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা কি না, তদন্ত হচ্ছে। মিরপুর সেকশন ১১-তে তাঁর একটি প্লট আছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সামসুদ্দিন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা কিন্তু বরাদ্দপ্রাপ্ত ফ্ল্যাটের পাশাপাশি আরেকটি ফ্ল্যাট দখলে রেখেছেন। তাঁর নামে সলিমুল্লাহ রোডে সরকারি বাড়ি রয়েছে। সুনামগঞ্জের সিরাজুল ইসলাম দুটি ফ্ল্যাট দখলে রেখেছেন। তাঁর নামে আজিমপুরে সরকারি বাড়ি আছে।

দখলকৃতদের মধ্যে লালমনিরহাটের শুকুর আলীকে পরিত্যক্ত সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা বোর্ড থেকে মিরপুরের একটি বাড়ি এবং সুনামগঞ্জের মান্নান আলীকে মিরপুরে বাড়ি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। যশোরের আবদুল লতিফকে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ঝিলমিল আবাসিক প্রকল্পে পাঁচ কাঠার প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

এ ছাড়া ভোলার শহীদুল্লাহ, মৌলভীবাজারের আনোয়ারা বেগম, ঝিনাইদহের সুরাইয়া পারভীন, যশোরের হামিদা মণ্ডল, কুমিল্লার হানিফ সরকার, জামালপুরের লাল মিয়া, যশোরের মতিউর রহমান, সুনামগঞ্জের আমীর মাহমুদ, নড়াইলের সেকান্দর আলীর বিরুদ্ধে রয়েছে নানা অভিযোগ। তাঁদের অনেককে যে ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তা না নিয়ে নিজেদের সুবিধামতো দুটি করে ফ্ল্যাট দখল করে রেখেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।