Thank you for trying Sticky AMP!!

মুন্ডি খেতে বান্দরবানে

টক ঝাল মুন্ডি দেখতে নুডলসের মতো, স্বাদে রয়েছে ভিন্নতা। বান্দরবানের মাআছার রেস্তোরাঁয় মুন্ডি খেতে এসেছেন একটি পরিবারের সদস্যরা l প্রথম আলো

আজ থেকে এক দশকের বেশি সময় আগের কথা। বান্দরবান শহরের উজানিপাড়ার মারমা বাজারে ঘুরতে ঘুরতে ঢুকে পড়েছিলাম ছোট্ট একটা খাবারের দোকানে। তখন সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। রেস্তোরাঁর ঠিক মাঝখানে গনগনে চুলায় চাপানো হাঁড়ি। সেখান থেকে বড় হাতার চামচ দিয়ে বাটিতে নুডলস নিয়ে, তাতে নানা মসলা যোগ করে গোল হয়ে বসা খেদ্দরদের দিকে এগিয়ে দিচ্ছিলেন একজন রাঁধুনি। মাটিতে আসন পেতে জাপানি কায়দায় সেবার সেই খাবারের স্বাদ নিয়েছিলাম। সুস্বাদু ওই খাবারই মুন্ডি।
কিছুদিন আগে বান্দরবানে গিয়ে আবার মুন্ডির খোঁজ। কিন্তু সেই রেস্তোরাঁটি খুঁজে পেলাম না। উজানিপাড়া আর মধ্যমপাড়ায় লোকজনকে জিজ্ঞাসা করে কয়েকটা মুন্ডির দোকান পাওয়া গেল। কিন্তু সেসবের কোনোটির সঙ্গেই অতীতের দোকানটির মিল নেই। এখন সব মুন্ডির দোকানে টেবিল-চেয়ার হয়ে গেছে। অনেকটা কফিশপ আর চীনা রেস্তোরাঁর মতো পরিবেশ। তবে সব বদলালেও মুন্ডির স্বাদ তো বদলায়নি।
বান্দরবানের মধ্যমপাড়ার পুরোনো রাজবাড়ির মাঠের পাশেই পাওয়া গেল একটি মুন্ডির দোকান। কোনো সাইনবোর্ড নেই। কিন্তু লোকজন হরদম ঢুকছে বেরোচ্ছে। সেখানে ঢুকতেই দেখা গেল কয়েক সারি টেবিলে খানাপিনায় ব্যস্ত লোকজন। একেবারে সামনের ক্যাশ কাউন্টারের পাশে লম্বা টেবিলে বড় পাতিল। সেখান থেকে ধূমায়িত নুডলস প্লেটে ঢালছেন একজন নারী। জানা গেল তিনি মাআছা রাখাইন। দোকানের মালিক।
রাখাইন নারী মাআছা নিজেই মুন্ডি রাঁধেন, নিজেই বাড়েন। পরিবেশনের জন্য আছে আরও কয়েকজন সহায়তাকারী। আট বছর ধরে এই ব্যবসা তাঁর। কক্সবাজারের মহেশখালীর গোরকঘাটার মেয়ে তিনি। স্বামীর বাড়ি বান্দরবানে। স্বামী মারা যাওয়ার পর সংসারের হাল ধরতে হয়েছে মাআছাকে। মুন্ডিটা তাঁর হাতে ভালোই হয়। তাই এই ব্যবসায় এসেছেন।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে। একের পর এক কাস্টমার আসছেন। প্লেটে প্লেটে মুন্ডি বাড়ছিলেন মাআছা। ব্যস্ততার সময় তখন। তাই হাত চালাতে চালাতে কথা বলছিলেন। ‘মুন্ডি সম্পর্কে আগে কিছু বলুন।’ এমন অনুরোধ শুনে হাসলেন। বললেন, এটা বার্মিজ (মিয়ানমার) ঐতিহ্যবাহী খাবার। চালের নুডলস সেদ্ধ করে তাতে গোলমরিচ, পাহাড়ি মরিচের গুঁড়া, পেঁয়াজ ভাজা, ধনেপাতা, চিংড়ি ও শুঁটকিসহ নানা মসলা পরিমাণমতো মেশাতে হয়। মিয়ানমারে এই খাবার লোকজন সকালের নাশতা আর দুপুরের খাবার হিসেবে খায়। মাআছার দোকানের মুন্ডি, মুন্ডি চাটনি ও স্যুপ খেতে পছন্দ করেন ক্রেতারা। সাধারণ মুন্ডি প্রতি প্লেট ১০ টাকা, মুন্ডি চাটনি ৩০ টাকায় বিক্রি হয়। প্রতিদিন হাজার-বার শ প্লেট মুন্ডি বিক্রি হয়। টাকার হিসাবে চার থেকে পাঁচ হাজারের মতো। তবে রাজপুণ্যাহ বা উৎসবের সময় দৈনিক বিক্রি ২০ হাজার টাকাও ছাড়িয়ে যায়।
মাআছার কাছ থেকে জানা গেল, মুন্ডির প্রধান উপাদান চালের নুডলস তৈরির প্রক্রিয়া মোটেই সহজ কাজ নয়। এ জন্য প্রথমে চাল ভিজিয়ে রাখতে হয়। এরপর চাল পিষে সেদ্ধ করে মণ্ড তৈরি করতে হয়। এই মণ্ড মেশিনে রেখে চাপ দিলে বেরিয়ে আসে মিহি নুডলস। তৈরি হওয়া এই নুডলস রোদে শুকিয়ে সংরক্ষণ করা হয়। অবশ্য এখন বান্দরবানের স্থানীয় বাজারেও চালের তৈরি নুডলস মেলে।
টক-ঝাল মুন্ডি সাধারণ নুডলসের মতো নয়। বান্দরবানের মারমা সম্প্রদায়ের লোকজন অতীতকাল থেকে এই খাবার খেতে অভ্যস্ত। মাআছার দোকানে স্থানীয় বাঙালিদের অনেককে দেখা গেল। তাঁদের একজন আরিফুল হক। জেলা পাসপোর্ট অফিসে কাজ করেন। বললেন, তিনি প্রায়ই মুন্ডি খেতে আসেন। খুব উপাদেয় আর ভেজালও নেই।
শহরের উজানিপাড়ায় আরও কয়েকটা মুন্ডির দোকান আছে। সেগুলোর বিক্রিও জমজমাট। বেশ ভালো ভিড় দেখা গেল রেঙ্গুন মুন্ডি হাউসে। এমন নামের পেছনের কারণ কী? রেঙ্গুন অর্থাৎ মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুনেই কি সবচেয়ে ভালো মুন্ডি মেলে? সেটা জানা না গেলেও মুন্ডি সেখানকারও ঐতিহ্যবাহী খাবার, এ কথা জানা গেল খাদ্য–বিষয়ক ব্রিটিশ লেখক অ্যালান ডেভিডসনের সি ফুডস অব সাউথ এশিয়া বই থেকে। ইন্টারনেট ঘেঁটে জানা গেল, মিয়ানমারে এই খাবার মুন্ট-ডি নামে পরিচিত।
ধোঁয়া ওঠা মুন্ডি খেতে হলে বান্দরবানে আসতেই হবে। বাসস্ট্যান্ড থেকে ১০ টাকা রিকশা ভাড়া খরচ করে চলে আসা যায় উজানিপাড়া। এরপর লোকজনকে জিজ্ঞেস করলেই দেখিয়ে দেবে মুন্ডির দোকান। সাধারণত বিকেল থেকে রাত আটটা পর্যন্ত খোলা থাকে দোকানগুলো।