Thank you for trying Sticky AMP!!

যাত্রীরা পদে পদে ঠকছে, যখন-তখন বাস বন্ধ

ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান এড়াতে গতকাল রাজধানীতে বাস চলাচল কম ছিল। এতে দুর্ভোগে পড়ে যাত্রীরা। বিকেলে ফার্মগেট থেকে ছবিটি তুলেছেন সাজিদ হোসেন

মোটরযান আইন ও রুট পারমিটের (চলাচলের অনুমতি) শর্ত লঙ্ঘন করে ঢাকায় গতকাল সোমবার প্রায় ৪০ শতাংশ বাস ও মিনিবাস চলাচল করেনি। এতে দিনভর দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে সাধারণ যাত্রীদের। এভাবে ইচ্ছাকৃত বাস বন্ধ রাখার দায়ে রুট পারমিট বাতিলের বিধান রয়েছে।

বাড়তি মুনাফার জন্য বাস-মিনিবাসে নির্ধারিত সংখ্যার চেয়ে বাড়তি আসন সংযোজন করে অতিরিক্ত যাত্রী গাদাগাদি করেও বহন করা হচ্ছে, যা মোটরযান আইনের পরিপন্থী ও রুট পারমিটের শর্ত লঙ্ঘন। এতে পদে পদে মূলত যাত্রীরা ভোগান্তির পাশাপাশি আর্থিকভাবেও ঠকছে। কিন্তু এসব কারণে কোনো পরিবহনের চলাচলের অনুমতি বাতিল করার নজির নেই বলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সূত্রে জানা গেছে।

গত রোববার থেকে মোটরযান আইন মেনে সিটিং সার্ভিস বন্ধ করতে রাস্তায় নামেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। পরিবহনমালিক-শ্রমিক সূত্র বলছে, অভিযান এড়াতে মূলত তারা অনেক বাস-মিনিবাস চালায়নি। শুধু এবারই নয়, এর আগে যতবার সরকার অভিযান পরিচালনা করেছে, ততবারই বাস-মিনিবাস চলাচল কমে যায়।

গত ৫ মার্চ ২০ বছরের পুরোনো যানবাহন উচ্ছেদে বিআরটিএ, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ও মহানগর পুলিশ ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে। এতে প্রথম দিন থেকেই রাজধানীর সড়ক প্রায় বাসশূন্য হয়ে পড়ে।

গতকাল এ বিষয়ে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকায় অনিয়মই নিয়ম হয়ে গেছে। বাসমালিক-শ্রমিক কেউ আইন মানছেন না। এ জন্য যাত্রীরা পদে পদে ঠকছে। তিনি বলেন, ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান শুরুর পর প্রায় ৪০ শতাংশ বাস-মিনিবাস চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। তিনি যাত্রাবাড়ী, মিরপুর, উত্তরা ও টঙ্গী এলাকা ঘুরে এই ধারণা পেয়েছেন। তিনি বলেন, এসব এলাকায় সড়কের পাশে, পেট্রলপাম্পে এবং খোলা জায়গায় বাস-মিনিবাস থামিয়ে রাখতে দেখা যায়।

সরকারের প্রায় সব পরিবহন কমিটিতে মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের নেতারা সদস্য। বাস-মিনিবাসের চলাচলের অনুমতি দেওয়ার কমিটিতেও সরকারি কর্মকর্তাদের বাইরে একমাত্র মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা রয়েছেন। সব সময়ই সরকারপন্থীরা এই মালিক ও শ্রমিক সমিতিগুলোর নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন।

এই বিষয়ে মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, পরিবহনমালিক ও শ্রমিকনেতারা রাজনৈতিক আশীর্বাদপুষ্ট। পরিবহন কমিটিগুলোতেও তাঁদের প্রভাব প্রচুর। ফলে যাত্রীস্বার্থ রক্ষা হচ্ছে না। তিনি বলেন, ২০১৫ সালে ঢাকার বাস-মিনিবাস চলাচল কমিটিতে তাঁকে রাখা হয়েছিল। কিন্তু মালিক-শ্রমিক নেতাদের চাপে কোনো বৈঠকে অংশ নেওয়ার আগেই তাঁকে বাদ দেওয়া হয়।

বাস চলাচল কমে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সাধারণ সম্পাদক খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ প্রথম আলোকে বলেন, যেসব বাসের ফিটনেস সনদ ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নেই, সেগুলো নামেনি। অবৈধ অ্যাঙ্গেল ও বাম্পার থাকা বাস-মিনিবাসও চলেনি। এটা সব সময়ই হয়। তবে এবারের অভিযান চলতে থাকবে। কেউ বাস না চালিয়ে পারবে না।

মোটরযান আইনে বাস-মিনিবাসের অনুমতির অন্যতম শর্ত হচ্ছে গাড়ি চলাচল নিয়মিত অব্যাহত রাখা এবং যাত্রীদের সঙ্গে চালক বা কন্ডাক্টরের আচরণ আপত্তিকর হওয়া যাবে না।

জানতে চাইলে বিআরটিএর প্রতিষ্ঠাকালীন কর্মকর্তা ও সাবেক উপপরিচালক আবদুর রব প্রথম আলোকে বলেন, বাস-মিনিবাসের চলাচল বন্ধ রাখতে হলে কর্তৃপক্ষকে আগে থেকে জানাতে হবে। আর হঠাৎ নষ্ট হলে সেটাও জানানোর নিয়ম। এর ব্যত্যয় ঘটলে তা অনুমতির শর্ত লঙ্ঘন করবে। এর সর্বোচ্চ শাস্তি অনুমতি বাতিল।

মোটরযান আইনে, বাস ও মিনিবাসের চলাচলের অনুমতির ক্ষেত্রে কমবেশি ৩০টি শর্ত পূরণ করতে হয়। এটি নিশ্চিত করার দায়িত্ব আঞ্চলিক পরিবহন কমিটির। জেলায় সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে এই কমিটি গঠিত হয়। আর ঢাকাসহ মহানগরে পুলিশ কমিশনার কমিটির নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন। এই কমিটিতে পুলিশ, বিআরটিএ, সরকারের অন্য সংস্থা ও মালিক-শ্রমিক সংগঠনের নেতারা থাকেন।

এ বিষয়ে সড়ক পরিবহন বিভাগের সচিব এম এ এন সিদ্দিক প্রথম আলোকে বলেন, যেসব বাস-মিনিবাস ইচ্ছাকৃতভাবে বসিয়ে রাখা হচ্ছে, সেগুলো খুঁজে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে নির্বাহী হাকিমদের। এসব বাসের চলাচলের অনুমতি বাতিল করে দেওয়া হবে।

যাত্রীরা শুধু ঠকছে

মোটরযান আইনে সিটিং সার্ভিস নামে কোনো ব্যবস্থা নেই। বাসে গাদাগাদি করে যাত্রী তোলারও নিয়ম নেই। কিন্তু যত্রতত্র যাত্রী উঠিয়ে আসনের প্রায় দ্বিগুণ যাত্রী বহন করা হচ্ছে। গত শনিবার থেকে সিটিং সার্ভিস বন্ধ হওয়ার পর সব বাসেই ঠাসাঠাসি করে যাত্রী তোলা হচ্ছে।

গণপরিবহনের অনুমতির শর্তে বলা হয়েছে, নির্দিষ্ট সময় বা মৌসুম এবং নির্দিষ্ট যানবাহন বাদে সব বাস-মিনিবাসে নির্ধারিত আসনের অধিক যাত্রী বহন করা যাবে না। তবে নিবন্ধনের শর্তের মধ্যে বলা আছে, যথাযথ কর্তৃপক্ষ চাইলে ১০ জন যাত্রী দাঁড় করিয়ে নিতে পারবেন। তবে বাসের মেঝে থেকে ছাদের উচ্চতা কমপক্ষে ছয় ফুট হতে হবে। আর মাঝখানের পথটি ১৮ ইঞ্চি চওড়া হতে হবে।

বিআরটিএর সূত্র বলছে, ঢাকার কোনো মিনিবাসই এত উঁচু নয়। এই নিয়ম বাসের ভেতরের স্থান দেখে ঠিক করে দেওয়ার কথা সরকারের। তবে তা করা হয় না।

যাঁরা বাস-মিনিবাসে আসন পান, তাঁরাও পা সোজা করে বসতে পারেন না। বিআরটিএর আইন অনুসারে, যাত্রীবাহী বাস-মিনিবাসের আসনের হেলান দেওয়ার স্থান অন্য আসনের হেলান দেওয়ার স্থানের দূরত্ব হতে হবে ২৬ ইঞ্চি।

বিআরটিএ সূত্র বলছে, ঢাকার বেশির ভাগ বাসেই এই পরিমাণ ফাঁকা জায়গা নেই।

চলাচলের অনুমতির সময়, বাস-মিনিবাস কোথায় থামবে সেই স্থানও নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। কিন্তু তা মানা হয় না। কোমল পরিবহনের মিনিবাসের চলার পথ সায়েদাবাদ থেকে নারায়ণগঞ্জের আদমজী পর্যন্ত। মাঝখানে এই পরিবহনের বাস থামার কথা যাত্রাবাড়ী, শনির আখড়া ও চিটাগাং রোড। কিন্তু কাজলা, রায়েরবাগ, সাইনবোর্ড, সানারপাড়সহ আরও পাঁচ-ছয়টি স্থানে যাত্রী তোলে।

এ বিষয়ে সড়ক পরিবহন বিভাগের সচিব বলেন, ভ্রাম্যমাণ আদালতে নির্ধারিত স্থানের বাইরে বাস থামিয়ে যাত্রী তোলা হচ্ছে কি না, সেটাও দেখা হচ্ছে। আর যাত্রীদের আরাম নষ্ট করে আসন বৃদ্ধির জন্য প্রতিদিনই মামলা হচ্ছে।

গতকাল ঢাকায় পাঁচটি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হয়। এসব আদালতে সাড়ে তিন লাখ টাকার বেশি জরিমানা আদায় করা হয়। লাইসেন্স ছাড়া যান চালানোর দায়ে দুজনকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

বাসেরও সংকট

ঢাকা ও এর আশপাশে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বাস চলাচলের অনুমোদন রয়েছে। পরিবহনমালিকেরা বলছেন, যান্ত্রিক ত্রুটিসহ নানা কারণে এর প্রায় এক হাজার চলে না। যানজটের কারণে প্রায় সব বাসই দিনে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পাঁচবারের বেশি আসা-যাওয়া করে না। ফলে যত যাত্রী যাতায়াত করার সুযোগ রয়েছে, তা-ও অব্যবহৃত থাকে। এতে স্বাভাবিক ব্যস্ত সময়েও যাত্রীরা বাস পান না।

যানজট ও স্বাভাবিক সময়ে বাস চলাচলের একটি চিত্র পাওয়া যায় গত বছর প্রকাশিত ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণা প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, অপেক্ষাকৃত কম ব্যস্ত সময়ে শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে গুলশান ও গুলিস্তান হয়ে পোস্তগোলা পর্যন্ত ২২ কিলোমিটার দীর্ঘ পথে যানবাহনের গড় গতি ঘণ্টায় ২২ কিলোমিটার। আর ব্যস্ত সময়ে ঘণ্টায় ৯ কিলোমিটার।

এই গবেষণায় আরও এসেছে যে ঢাকায় প্রতি এক লাখ মানুষের জন্য ৩০টি বাস রয়েছে। অথচ দিল্লি, কলকাতা, বেঙ্গালুরু, হংকং ও লন্ডনের মতো মেট্রোরেল থাকা শহরে এর চেয়ে অনেক বেশি বাস চলে।

ঢাকার গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন গত বছর সব বাসকে একটি কোম্পানির আওতায় আনার উদ্যোগ নেয়। সরকারের ২০ বছরের পরিবহন পরিকল্পনাতেও এই পদ্ধতি চালুর সুপারিশ ছিল। উত্তর সিটি করপোরেশন এ বিষয়ে একটি সমীক্ষাও করে। এতে বলা হয়, এক কোম্পানির অধীনে এলে সব বিনিয়োগকারী বিনিয়োগের হার অনুযায়ী লাভ পাবে। এতে যানজটও কমবে। যাত্রী হয়রানিও কমবে। কিন্তু বিষয়টি এখনো আলোর মুখ দেখেনি।

আরও পড়ুন: 
বাস–মিনিবাসে নৈরাজ্য, মানুষের চরম দুর্ভোগ