Thank you for trying Sticky AMP!!

যে স্কুলে জাতপাতে ভেদ নেই

টাঙ্গাইল এসএসএস–পৌর আইডিয়াল হাইস্কুলের িশক্ষার্থীদের সমাবেশ। ছবি: কামনাশীষ শেখর

পূজা রানী হরিজন টাঙ্গাইলের এসএসএস-পৌর আইডিয়াল হাইস্কুলের শিক্ষক। প্রায় তিন বছর তিনি প্রাক্‌-প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পড়াচ্ছেন। নিজেও এই স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। পূজা বলছিলেন, ‘এই স্কুল না থাকলে আমার পড়াশোনা হতো না। স্কুল ছিল বলেই পঞ্চম শ্রেণি পাস করতে পারি। তা দেখে বাবা–মা উৎসাহ পান।’ পূজা যখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়তেন, তখন যৌনপল্লির অনেক শিশু পড়ত। তবে নানা কারণে অনেককেই যৌন পেশায় ফিরে যেতে হয়েছে। পূজা বর্তমানে একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে পড়ছেন। পাশাপাশি স্কুলে পড়াচ্ছেন। হেসে জানালেন, তাঁর স্বামী অষ্টম শ্রেণি পাস, তবে স্বামী স্বপ্ন দেখেন স্ত্রীকে উচ্চশিক্ষিত করবেন।
সুইপার কলোনির পাশেই অবস্থিত স্কুলটিতে হরিজন, রবিদাস, চৌহান, কান্দাপাড়া যৌনপল্লির শিশু, সাধারণ মুসলমান ঘরের শিশু—সবাই মিলেমিশে পড়ছে। এ স্কুলে বীণা খাতুনের মেয়ে পড়ছে অষ্টম শ্রেণিতে আর ছেলে পড়ছে পঞ্চম শ্রেণিতে। বীণা খাতুন বলেন, ‘হরিজন পরিবারের অনেক মেয়ে আমার মেয়ের বান্ধবী হয়ে গেছে। এখানে আমার মেয়ে বা ছেলে আর হরিজনের ছেলেমেয়ে এভাবে কেউ চিন্তা করে না।’
নব্বইয়ের দশকে হাঁটি হাঁটি পা পা করে স্কুলের যাত্রা শুরু হয়। টাঙ্গাইলের বেসরকারি সংগঠন সোসাইটি ফর সোশ্যাল সার্ভিস—এসএসএসের হাত ধরেই এ স্কুলের যাত্রা শুরু। বর্তমানে এই বিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪২৪। এদের মধ্যে ছেলে ২২৬ ও মেয়ে ১৯৮ জন। মুসলমান ও হিন্দু সম্প্রদায়ের ২২৮ জন শিক্ষার্থীর বাইরে ১৯৬ জনই হরিজন, রবিদাস, চৌহান সম্প্রদায় ও যৌনপল্লির মায়েদের সন্তান। ২০১৫ সালে স্কুলটি হাইস্কুল হিসেবে অনুমোদন পেয়েছে।
সম্প্রতি স্কুলটি ঘুরে দেখা গেল তিনতলা ভবনের লালচে ইটের ভবনটি সুন্দর করে সাজানো, ছিমছাম। প্লে গ্রুপ ও নার্সারি ক্লাসে ছোট ছোট লাল, সবুজ চেয়ার, টেবিল। দেয়ালে এই রংধনু তো আরেক জায়গায় পরি নেচে বেড়াচ্ছে। মিকিমাউস, অ, আ, এ, বি, সি সবকিছুই আছে দেয়ালে।
এই স্কুলের শিক্ষার্থীরা সরকারের কাছ থেকে বিনা মূল্যে বই পাচ্ছে। স্কুলের পক্ষ থেকে পাচ্ছে বই-খাতাসহ অন্যান্য সরঞ্জাম। পড়াশোনার পাশাপাশি এখানকার শিক্ষার্থীদের কারাতে শিখতে হয়। শুধু তাই নয়, গান, নাচ, ছবি আঁকা সব নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয় তাদের। জেলার শিশু একাডেমীর শিশুদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে পুরস্কার ছিনিয়ে আনছে এই স্কুলের শিক্ষার্থীরা। আর নেপাল থেকে কারাতে সোনার পদক আনা বা বাংলাদেশ দলকে প্রথম, দ্বিতীয় পুরস্কার এনে দেওয়া অনেকটা ডাল-ভাতের মতোই সহজ হয়ে গেছে তাদের।
স্কুলের শুরু থেকে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন আবদুস সবুর মিয়া। বর্তমানে স্কুলে নবম শ্রেণি পর্যন্ত চালু করা সম্ভব হয়েছে। ধীরে ধীরে এখানে একটি কলেজ হবে বলে সবাই স্বপ্ন দেখছে।
১৯৯৪ সালে বেসরকারি সংগঠন এসএসএসের দিকে প্রথম হাত বাড়িয়ে দেয় সেভ দ্য চিলড্রেন অস্ট্রেলিয়া। তেরে দেস হোমস নেদারল্যান্ডস শুরু থেকে এখন পর্যন্ত আর্থিক সহায়তা অব্যাহত রেখেছে। শুরুতে শহরের বটতলায় শুরু হয় দুটি ড্রপ ইন সেন্টার বা শিশুবিকাশ কেন্দ্র। তখন সুবিধাবঞ্চিত শিশুর সংখ্যা ছিল ৬০। কিন্তু একসময় অনুপস্থিতির সংখ্যা বাড়তে লাগল। যৌনপল্লির শিশুরা ঝরে যাচ্ছে এ সেন্টার থেকে। দ্বন্দ্ব-সম্প্রদায়গত। একসঙ্গে বসবে না অন্য শিশুরা। এভাবে ভাঙা–গড়ার মধ্য দিয়ে চলতে থাকে কার্যক্রম। একবার বটতলায় তো আবার খোলা আকাশের নিচে, আবার সব শিশু একসঙ্গে তো, আবার যৌনপল্লির শিশুদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা। ১৯৯৫ সালে একটি টিনের ছাপরাঘরে বর্তমান স্কুলটির আত্মপ্রকাশ ঘটে। ১৯৯৯ সালে স্কুলের অভিভাবকদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির প্রথম সভাপতি হন কানাই হরিজন। স্কুলের পরে শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের বাড়ি পরিদর্শনে যেতেন। পড়াশোনার গুরুত্ব বুঝিয়ে বলতেন। স্কুলের কলেবর বাড়তে থাকে। সমাজের উচ্চ বর্ণের মানুষ ‘নিম্নবর্ণের’ শিশুদের সঙ্গে নিজেদের সন্তানদের পড়াতে এক পা দু–পা করে এগিয়ে আসেন।
স্কুলটিতে হেলথ ফ্যাসিলেটর, লাইব্রেরিয়ান, মার্শাল আর্ট, গান, নাচ, তথ্যপ্রযুক্তি, নাটকের শিক্ষকসহ মোট শিক্ষক আছেন ১৯ জন। ১৫টি কম্পিউটার নিয়ে একটি সাজানো ল্যাব। এসএসএসের শিক্ষা ও শিশু উন্নয়ন বিভাগের পরিচালক আবদুল লতীফ মিয়া বললেন, ০.৫৩ একর জায়গায় স্কুল ভবনটি গড়ে উঠেছে। পৌরসভার জায়গা এটি। পৌরসভা স্কুল বানানোর অনুমতি দিয়েছে। নেদারল্যান্ডসের আরভিকেও নামক একটি সংস্থা স্কুল ভবন তৈরি করে দিয়েছে।
সাত মাস আগে স্কুলের প্রিন্সিপাল মো. ফজলুল করিম খান এ স্কুলের দায়িত্ব নিয়েছেন। বিভিন্ন জায়গায় ৪৩ বছরের শিক্ষকতা জীবনের অভিজ্ঞতায় প্রথম আলোকে তিনি বলেন, এই স্কুলে উচ্চবর্ণ-নিম্নবর্ণ বলে কোনো কথা নেই। সব শিক্ষার্থী সমান।

মানসুরা হোসাইন: সাংবাদিক।