Thank you for trying Sticky AMP!!

রাকিবের বাগানে ৭০ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ

নিজের জলজ বাগানে গাছ রোপণ করছেন রাকিবুল হাসান। সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার পঞ্চবটী এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো

শখের বশে বাগান করেন অনেকে। বাড়ির পাশে একফালি জমিতে বা ছাদে ফুল-ফল-সবজিতে  ভরিয়ে তোলেন। কখনো দু–একটি জলজ উদ্ভিদও হয়তো রাখেন। কিন্তু শুধুই জলজ উদ্ভিদ সংগ্রহের কথা শোনা যায় না খুব একটা।

ঢাকার পাশে নারায়ণগঞ্জে জলজ উদ্ভিদের এক বাগানের খোঁজ পাওয়া গেছে। যেখানে একটি-দুটি নয়, ৭০ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ রয়েছে। দেশ-বিদেশের নানা প্রান্ত থেকে জোগাড় করা হয়েছে এসব উদ্ভিদ। শুধু শাপলাই আছে ৪৪ প্রজাতির। বরফাচ্ছাদিত অঞ্চলের হার্ডি প্রজাতির শাপলাও আছে বাংলাদেশের গরম জল-হাওয়ায়। পাতার জন্য বিখ্যাত ভিক্টোরিয়া আমাজন লিলির মতো বিদেশি উদ্ভিদ যেমন আছে, তেমনি এই বাগানে রয়েছে ভেষজ গুণসমৃদ্ধ দেশীয় দুর্লভ জলজ উদ্ভিদ স্বর্ণকুমুদ।বছর চারেক ধরে তিলে তিলে বাগানটি গড়ে তুলেছেন রাকিবুল হাসান (৩৩)। শৌখিন এই যুবকের বাড়ি ফতুল্লার পঞ্চবটি গুলশান রোডে। বাড়ির উঠান ও ছাদজুড়ে তাঁর বিচিত্র এই বাগান।

শুরুটা যেভাবে

বিয়ের পরের বছর ২০১৫-এর কথা। রাকিব তখন গাজীপুরের একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। সে সময় ভেষজ গুণসম্পন্ন দেশি লাল শাপলার প্রতি আগ্রহ জন্মায় তাঁর। সে বছরই স্ত্রীকে নিয়ে কক্সবাজার ঘুরতে যান। সেখান থেকে স্ত্রীর পছন্দের নীল শাপলা জোগাড় করেন। তখন থেকে জলজ উদ্ভিদ জোগাড়ের নেশা পেয়ে বসে তাঁকে। শুরুতে বাড়ির লোকজন বিরক্ত হলেও একসময় বাবা ও স্ত্রী উৎসাহ দেন তাঁকে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উদ্ভিদ সংগ্রহ করে দিয়েছেন পরিচিত এক উদ্ভিদপ্রেমী।

ইট-কাঠ, কংক্রিটের এই নগরে জলাশয় কমছে। হারিয়ে যাচ্ছে চমৎকার সব উদ্ভিদ। এসব উদ্ভিদকে বাঁচিয়ে রাখা এবং ছোট্ট জায়গায় এসব উদ্ভিদ কীভাবে রাখা যায়, সেই চিন্তা থেকেই আজকের এই বাগান, বললেন রাকিব। দুর্লভ ও হারিয়ে যাওয়ার পথে এমন সব জলজ উদ্ভিদ বাঁচিয়ে রাখতে ও সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে চান তিনি।

কেন কথা রাখেনি বরুণা

বিশ্বসংসার তন্নতন্ন করে খুঁজে ১০৮টা নীল পদ্ম আনার পরও কথা রাখেনি সুনীলের বরুণা। ধর্মশাস্ত্র, সাহিত্য কিংবা রূপকথায় নীল পদ্মের অস্তিত্ব থাকলেও পৃথিবীতে এ উদ্ভিদটির অস্তিত্ব নেই বলেই দাবি জলজ উদ্ভিদ সংগ্রাহকদের। তাঁরা বলছেন, নীল শাপলাকেই অনেকে নীল পদ্ম ভেবে ভুল করে থাকেন। রাকিবের উঠানেও দেখা মেলে সেই নীল শাপলার। বাংলাদেশে তিন ধরনের শাপলা চোখে পড়লেও রাকিবের দাবি, তাঁর সংগ্রহে দুর্লভ গোলাপি শাপলাসহ সাত রকমের দেশি শাপলা রয়েছে। এ ছাড়া থাইল্যান্ড, মেক্সিকোসহ এশিয়া, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন দেশ থেকে সংগ্রহ করেছেন আরও ৩৭ প্রকারের শাপলা। তাঁর সংগ্রহে আছে দেশি-বিদেশি ছয় রকমের পদ্ম। চলতি বছরই ১০০ প্রজাতির শাপলা ও ২৫ প্রজাতির পদ্ম সংগ্রহের ইচ্ছার কথা জানালেন তিনি। এত কিছু আছে, সুনীলের নীল পদ্ম নেই কেন? এ প্রশ্নে সহাস্য উত্তর রাকিবের, ‘পৃথিবীতে নীল পদ্মের অস্তিত্ব নেই। সুনীল বরুণাকে নীল শাপলা এনে দিয়েছিলেন। তাই তো কথা রাখেনি বরুণা।’

এক বাড়িতেই পুরো পৃথিবী

সম্প্রতি রাকিবের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ছোট্ট উঠানে সারি সারি সাজানো জলভর্তি পাত্র। সেখানে ফুটে আছে চেনা–অচেনা বাহারি রঙের ফুল। একটি গাছের নাম স্বর্ণকুমুদ। গোলাকার হলুদ পাপড়ির দেশীয় এই ফুলের কন্দ ভেষজ গুণসমৃদ্ধ। শিকড়হীন গাঢ় হলুদ রঙের ছোট্ট দেশীয় ফুল ঝাঁজি দাম। নামের মতোই ঝাঁজালো, ব্যতিক্রমী এই ফুলের আচরণ। শিকড়ের পরিবর্তে পাপড়ির পাশেই থাকে খাড়া লোম। পানিতে ভেসে বেড়ানোর সময় পোকামাকড় লোমে আটকে যায়। একসময় সেসব পোকা হজম করে ফেলে ঝাঁজি দাম। আরেকটি উদ্ভিদের নাম ভিক্টোরিয়া আমাজন লিলি। দৈত্যাকার পাতার জন্য পৃথিবীখ্যাত এই গাছ। থালার মতো দেখতে পাতায় অনায়াসেই একটি শিশু বসে থাকতে পারে। আমাজন জঙ্গলের এই গাছের ফুল দেখতে দেশীয় শাপলার মতো। তবে আকৃতিতে বেশ বড়। এই ফুল ফোটার প্রথম রাতে সাদা ও দ্বিতীয় দিনে গোলাপি রং ধারণ করে। থাইল্যান্ড থেকে এই গাছ এনেছেন রাকিব। তিনি মনে করেন, কেউ চাইলেই নিজ বাড়িতে পুরো পৃথিবীর স্থান করে দিতে পারে জলজ উদ্ভিদ সংগ্রহের মাধ্যমে। উঠানের ৪ শতাংশ জায়গা ও বাড়ির ছাদ নিয়ে রাকিবের জলজ বাগান। সেখানে আরও দেখা মেলে, হলুদ ফুলের জল লজ্জাবতি, সাদা ও হলুদ চাঁদমালা, কাউয়া ঠুকরি, জলগোলাপ, হলুদ লেটুস, ওয়াটার পপিসহ থাইল্যান্ডের মাল্টি পেটাল পদ্মের।

নিজের জলজ বাগানে গাছ রোপণ করছেন রাকিবুল হাসান। সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার পঞ্চবটী এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো

আয়েরও পথ

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ শেষ করে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন রাকিব। এখন সেখানকার হিসাব ব্যবস্থাপক। দশটা–পাঁচটা অফিস শেষে বাড়ি ফিরে বাগান নিয়ে মেতে ওঠেন। শখের বসে জলজ উদ্ভিদ সংগ্রহ শুরু করলেও তা থেকে এখন আয়ও করছেন তিনি। দেশ–বিদেশ থেকে সংগৃহীত বীজ এবং কন্দ থেকে চারা উৎপাদন করে বিক্রি করছেন সারা দেশে। মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য জলের টবে উৎপাদন করছেন বিভিন্ন প্রজাতির গাপ্পি মাছ। এসব মাছ ছয় মাসেই পাঁচ–ছয় গুণ বেড়ে যায়। উৎপাদিত মাছ বিক্রি করেও আয় করেন তিনি। তাঁর মতে, প্রতিদিন ছয়-সাত ঘণ্টা রোদ থাকে, এমন জায়গায় চাইলেই জলজ বাগান করা যায়। নিজের সুস্থতা, বাড়ির তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, সৌন্দর্য ও অর্থনৈতিক লাভ—সব কটির জন্যই এই বাগান কার্যকরী।

রাকিবের স্ত্রী সায়মা আক্তার বলেন, ‘এগুলো মানতে একসময় কষ্ট হতো। এটা এখন আমারও শখে পরিণত হয়ে গেছে। জলজ বাগানটা এখন আর রাকিবের একার না, আমারও।’

অন্যদের ভাবনায়

রাকিবের জলজ বাগান থেকে প্রায়ই বিভিন্ন উদ্ভিদ সংগ্রহ করেন গাজীপুরের ওষুধ উৎপাদনকারী একটি প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশল বিভাগের প্রধান তসলিম আবেদ। নিজের প্রতিষ্ঠানের তাপমাত্রা এবং বায়ুর মান ঠিক রাখতে বিভিন্ন প্রকারের গাছ ও জলজ উদ্ভিদের ওপর নির্ভর করেন তিনি। বলেন, ‘এই গ্রীষ্মে কারখানার ছাদে মূলত জলজ উদ্ভিদ এবং নানা ধরনের গাছ ব্যবহার করে তাপমাত্রা ৫২ থেকে ৩৮ ডিগ্রিতে নামিয়ে এনেছি আমরা। এই উপায়ে প্রতি মাসে প্রায় এক লাখ টাকার বিদ্যুৎ বিল সাশ্রয় হচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির এই সময়ে বাড়ির তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের উপায় হতে পারে জলজ উদ্ভিদ।’

রাকিবের কর্মকাণ্ডের প্রশংসা করলেন নারায়ণগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিপ্তরের উপপরিচালক কাজী হাবিবুর রহমানও। বলেন, ‘জলাশয় ধ্বংসের কারণে জলজ উদ্ভিদগুলো হারিয়ে গিয়ে প্রকৃতি ও পরিবশকে বিপন্ন করে তুলছে। এ সময়ে রাকিবের এমন উদ্যোগ খুবই প্রশংসনীয়। তাঁর পাশাপাশি আরও কেউ যদি এসব উদ্ভিদ সংগ্রহ করে এবং ছড়িয়ে দেয়, তবে আমাদের পরিবেশ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আরও বাসযোগ্য হয়ে উঠবে।’