Thank you for trying Sticky AMP!!

রাজাকারের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধাদের নাম

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়

মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করায় ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনী হত্যা করেছিল বরিশালের আইনজীবী সুধীর কুমার চক্রবর্তীকে। তাঁর ছেলে আইনজীবী তপন কুমার চক্রবর্তী একজন গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রথম ধাপে রাজাকারের যে তালিকা প্রকাশ করেছে, তাতে তপন কুমারের নাম এসেছে। একই সঙ্গে আছে তাঁর মা প্রয়াত ঊষা চক্রবর্তীর নামও।

একইভাবে রাজশাহী, বরগুনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও বগুড়ায় কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতার নাম এসেছে, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে পরিচিত। এসেছে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার নামও। ফলে এই তালিকা নিয়ে ওই সব এলাকায় ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। অনেকে এই তালিকা সংশোধনের দাবি জানিয়েছেন।

গত রোববার একাত্তরের রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও স্বাধীনতাবিরোধী ১০ হাজার ৭৮৯ জনের নামের তালিকা প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের নথি পর্যালোচনা করে প্রথম ধাপে এই তালিকা প্রকাশ করা হয়।

তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বরিশাল সদর উপজেলা অংশে ১০৭ জন রাজাকারের তালিকা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে নগরের শ্রীনাথ চ্যাটার্জি লেনের বাসিন্দা ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সুধীর কুমার চক্রবর্তীর স্ত্রী প্রয়াত ঊষা রানী চক্রবর্তী ও তাঁর ছেলে মুক্তিযোদ্ধা তপন কুমার চক্রবর্তীর নাম রয়েছে।

তপন কুমার চক্রবর্তী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা খুবই লজ্জার বিষয়। দেশের জন্য যুদ্ধ করেছি। আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করে শহীদ হয়েছেন। অথচ এত বছর পর রাষ্ট্র আমাকে ও আমার মাকে রাজাকারের খেতাব দিল। এই লজ্জা, দুঃখ কোথায় রাখব?’

তালিকায় তপন কুমারের নামের পাশে একটি মামলা নম্বর রয়েছে। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কোনো মামলার কথা কখনো শুনিনি। এই কাল্পনিক মামলার নম্বর কোথা থেকে আবিষ্কৃত হলো, কারা করল—কিছুই বুঝতে পারছি না।’

উল্লেখ্য, তপন কুমার চক্রবর্তীর মেয়ে মনীষা চক্রবর্তী পেশায় চিকিৎসক এবং বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের বরিশাল জেলা শাখার সদস্যসচিব। মনীষা বলেন, এটা ভুল নয়, পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে।

রাজাকারের তালিকায় শহীদ পরিবারের দুই সদস্যের নাম আসার বিষয়টি গতকাল বরিশালে জানাজানি হওয়ার পর বিভিন্ন মহলে এ নিয়ে ক্ষোভ ও বিস্ময়ের সৃষ্টি হয়েছে। বরিশাল জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার মহিউদ্দিন মানিক বীর প্রতীক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এমন ঘটনায় বিস্মিত, লজ্জিত। আমরা চাই, এই তালিকা সংশোধন করে ওই পরিবারের সম্মান সুরক্ষা করা হোক।’

বরিশালের যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত মিহির লাল দত্ত ও তাঁর বাবা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ জিতেন্দ্র লাল দত্তের নামও এসেছে তালিকায়। রাজাকারের তালিকায় বাবা ও দাদার নাম আসায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মিহির লাল দত্তের ছেলে শুভব্রত দত্ত। তিনি বলেন, ‘আমার বাবা একজন ভাষাসৈনিক এবং যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। আমার দাদা ও এক কাকা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। আমার বাবা ও শহীদ দাদার নাম কীভাবে রাজাকারের তালিকায় এসেছে, সেটা আমার বোধগম্য নয়।’

বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলায় চারজনের নাম থাকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন মজিবুল হক। আমির হামজা ওরফে রুস্তম খাঁ ও খলিলুর রহমান ওরফে মানিক গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা। তাঁদের মৃত্যুর পর দুই পরিবার মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পাচ্ছে। কিন্তু তাঁদের নাম এসেছে তালিকায়। এ ছাড়া আমজাদ আলী নামের একজনের নাম এসেছে। তিনি মুক্তিযুদ্ধে না গেলেও আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছেন।

মজিবুল হকের ছেলে রেজাউল হক বলেন, ‘আমার বাবা পাথরঘাটায় মুক্তিযুদ্ধ সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি ছিলেন। তাঁকে ঘিরেই এখানে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে।’

পাথরঘাটার মুক্তিযোদ্ধা মনি মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, বরগুনা মহকুমা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান প্রয়াত খলিলুর রহমানের নাম এই তালিকায় নেই। তবে রাজাকারের তালিকায় এক নম্বরে নাম আছে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মজিবুল হকের। তাঁর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা খলিল ও আমির হামজার নাম আছে রাজাকারের তালিকায়, যা লজ্জার বিষয়।

বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার রাজাকারদের নামের তালিকায় সাবেক সাংসদ ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক কছিম উদ্দীন আহম্মেদ, সাবেক এমএনএ মজিবর রহমান, সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা মৃত ফরেজ উদ্দীন আহম্মেদ, আওয়ামী লীগ নেতা তাহের উদ্দীন সরদার, আওয়ামী লীগ নেতা মৃত মহসিন আলী মল্লিক, লাইব্রেরিয়ান মৃত হবিবর রহমান, আওয়ামী লীগ নেতা নজিবর রহমান, সান্তাহার কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক সহসভাপতি আবদুস শুকুরের নাম দেখে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন।

আদমদীঘি উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোরশেদ খান বলেন, তালিকায় এই উপজেলার আওয়ামী লীগের যেসব নেতার নাম এসেছে, তাঁদের নেতৃত্বে এই এলাকার মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অনুপ্রাণিত হয়েছিল। এর মধ্যে কছিম উদ্দীন ও মজিবর রহমান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক।

এদিকে রাজশাহী বিভাগের তালিকায় আইনজীবী গোলাম আরিফের নাম আছে। তবে তাঁর বিস্তারিত পরিচয় নেই। এই গোলাম আরিফ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান কৌঁসুলি (প্রসিকিউটর) গোলাম আরিফ টিপু কি না, সেই প্রশ্ন উঠেছে। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক আইনজীবী আবদুস সালাম ও মহসিনের নামও আছে এই তালিকায়। এ নিয়ে রাজশাহীতে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে।

রাজশাহী মহানগর মুক্তিযোদ্ধা সাবেক কমান্ডের আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, গোলাম আরিফ নামে রাজশাহীতে কোনো রাজাকার ছিলেন বলে তাঁদের জানা নেই। তাঁদের ধারণা, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর গোলাম আরিফের নাম লেখা হয়েছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় গোলাম আরিফ টিপু ভারতের মালদহে থেকে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বলেন, স্বাধীনতা–পূর্ব ও স্বাধীনতা–পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু রাজশাহীতে এসে একাধিকবার আইনজীবী আবদুস সালামের বাসায় আতিথেয়তা গ্রহণ করেছিলেন। ২৫ মার্চ আবদুস সালামের দুই ছেলে সেলিম উজ্জামান ও ওয়াসিম উজ্জামান, ছোট ভাই হাসানুজ্জামান, ছোট ভগ্নিপতি সাইদুর রহমান, তাঁর ভাগনিজামাই তৎকালীন এমএনএ নজমুল হক সরকারকে হত্যা করা হয়। আইনজীবী মহসিন মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের পানিপিয়া প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের ইনচার্জ ছিলেন। যুদ্ধের পর তাঁর স্বাক্ষরিত পত্রের মাধ্যমে পানিপিয়া প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযোদ্ধা সনদ সংগ্রহ করেন।

মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নান বলেন, যদু-মধুর নাম ভুল হতে পারে। গোলাম আরিফ টিপু, আইনজীবী আবদুস সালাম, আইনজীবী মহসিনের মতো পরিচিত মানুষের নাম ভুল হওয়ার কথা নয়। তাঁরা মনে করছেন, এটা ষড়যন্ত্রমূলক।

সরকারের ঘোষণা করা রাজাকারের তালিকায় নাম রয়েছে চট্টগ্রামের রাউজানের সরকারদলীয় সাংসদ এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরীর বাবা এ কে এম ফজলুল কবির চৌধুরীর। এ কে এম ফজলুর কবির চৌধুরী পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন। রাউজান উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার আবু জাফর চৌধুরী গতকাল রাউজানে বিজয় দিবসের এক অনুষ্ঠানে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় ফজলুল কবির চৌধুরী মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন। উনি রাজাকার ছিলেন না।

রাজাকারের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার নাম আসা প্রসঙ্গে গতকাল নানাভাবে চেষ্টা করেও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির প্রথম আলোকে বলেন, বরিশাল, রাজশাহীসহ কয়েকটি স্থানে কিছু নাম নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নামের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ পরিচয় দেওয়া হয়নি। একই নামে একাধিক ব্যক্তি থাকতে পারে। যেমন গোলাম আরিফ টিপুর বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই তাঁর নাম রাজাকারের তালিকায় থাকতে পারে না। তিনি বলেন, নির্মূল কমিটি মাঠপর্যায়ে বিষয়টি তদন্ত করবে। যদি প্রমাণিত হয়, ভুলভাবে কারও নাম যুক্ত হয়েছে, তাহলে তারা পুরো তালিকা প্রত্যাহার করতে বলবে। এ বিষয়ে ২০ ডিসেম্বর নির্মূল কমিটি সংবাদ সম্মেলন করবে বলেও জানান তিনি।

[তথ্য দিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী ও বরিশাল, প্রতিনিধি আদমদীঘি (বগুড়া), পাথরঘাটা (বরগুনা), রাউজান (চট্টগ্রাম)।]