Thank you for trying Sticky AMP!!

রোহিঙ্গা গণহত্যা নিয়ে আইসিজের সিদ্ধান্ত আগামীকাল

রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগে মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) নিয়েছে গাম্বিয়া। ছবি: রয়টার্স

কাল বৃহস্পতিবারই হতে পারে মিয়ানমারের হিসাব মেলানোর দিন। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দীর্ঘ কয়েক দশকের জাতিগত নির্মূল অভিযান ২০১৭ সালের আগস্টে যে ভয়াবহ নিষ্ঠুরতার রূপ নিয়েছিল, তার ন্যায়বিচার পাওয়ার আশা এবার বাস্তব হিসেবে ধরা দিতে পারে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে গণহত্যাসহ সব ধরনের নিপীড়নের হাত থেকে সুরক্ষা দেওয়ার লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা চেয়ে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) কাছে গাম্বিয়া যে আবেদন করেছে, কাল সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করবেন ১৭ জন বিচারপতি।

অবশ্য এই সিদ্ধান্ত ঘোষণার তিন দিন আগে গত সোমবার মিয়ানমারের গঠিত একটি তদন্ত কমিটি বলেছে, ২০১৭-এর রোহিঙ্গা সংঘাতে যুদ্ধাপরাধ এবং গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন ঘটেছে। তবে সেগুলোতে গণহত্যার উদ্দেশ্য ছিল না। ইনডিপেনডেন্ট কমিশন অব ইনকোয়ারি (আইসিওই) গতকাল মঙ্গলবার দেশটির প্রেসিডেন্ট উইন মিন্ট এবং স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চির সঙ্গে দেখা করে তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদন পেশ করেছে।

ফিলিপাইনের রোজারিও জি মানালোর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের এই কমিটি বলেছে, ২০১৭-এর ২৫ আগস্ট থেকে ৫ সেপ্টেম্বর সময়ে রাখাইন রাজ্যে আরসা বিদ্রোহীদের সঙ্গে যা ঘটেছে, তা অভ্যন্তরীণ সংঘাত। এই সংঘাতে বিপুলসংখ্যক সেনাসদস্য জড়িত হয়ে পড়েন এবং গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন ও দেশটির নিজস্ব আইন লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। এই তদন্ত কমিটি জাতিসংঘ স্বীকৃত নয় এবং এর স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতার প্রশ্ন তুলে কমিটির অন্যতম সদস্য যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক সিনেটর ও গভর্নর বিল রিচার্ডসন পদত্যাগ করেছিলেন। মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আইসিজের সিদ্ধান্ত ঘোষণার কাছাকাছি সময়ে এই তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।

প্রায় সাত যুগ আগে সম্পাদিত গণহত্যা সনদের স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আদালতের শরণাপন্ন হয়েছে আরেকটি মহাদেশের ছোট্ট একটি রাষ্ট্র গাম্বিয়া। মিয়ানমার একটি জাতিগোষ্ঠীকে তার সব ধরনের মৌলিক নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে যে ধরনের পদ্ধতিগত বৈষম্য ও নিপীড়ন চালিয়ে এসেছে এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার নামে অব্যাহত হত্যা-ধর্ষণ-লুণ্ঠন ও বাস্তুচ্যুতি ঘটিয়ে চলেছে, তা থেকে সুরক্ষা দেওয়ার দাবিতেই এই আবেদন।

জাতিগত বৈষম্য, নিপীড়ন, হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও বাস্তুচ্যুতির মতো গুরুতর অপরাধগুলোর কোনোটিই অস্বীকারের উপায় খুঁজে পায়নি মিয়ানমার। তাই দেশটির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, যা ঘটেছে তাতে অপরাধ হলেও হতে পারে, কিন্তু সেসব অপরাধে গণহত্যার উদ্দেশ্য ছিল না। দেশটির পক্ষে সাফাই দিতে হাজির হয়ে শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কারজয়ী অং সান সু চি দাবি করেছেন, সন্ত্রাস মোকাবিলায় যেসব অপরাধ ঘটেছে, তাকে গণহত্যা বলা যায় না এবং নতুন করে গণহত্যার কোনো আশু ঝুঁকি নেই। সশস্ত্র বাহিনীর যাঁরা গুরুতর অপরাধ করেছেন, সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে মিয়ানমার সেগুলোর বিচার করবে। এই বিচারপ্রক্রিয়ার আন্তর্জাতিকীকরণ উচিত হবে না।

সু চি অজুহাত দিয়েছেন, আদালতের যেকোনো অন্তর্বর্তী আদেশ পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া উদ্বাস্তুদের সম্ভাব্য পুনর্বাসনে বাধা তৈরি করবে। এই মানবিক সংকটে গাম্বিয়া সরাসরি কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত না হওয়ায় আন্তর্জাতিক আদালতের কাছে আসার কোনো অধিকার দেশটির নেই দাবি করে আবেদনটি খারিজ করারও অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি।

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রতি মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নৃশংসতা ও বৈষম্যমূলক রাষ্ট্রীয় নীতি যেমন অস্বীকারের উপায় নেই, তেমনই গণহত্যা সনদে স্বাক্ষরকারী হিসেবে গাম্বিয়ারও আন্তর্জাতিক আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার অধিকারও সনদেই নির্ধারণ করা আছে। মানবাধিকার ও আইনের শাসনের প্রবক্তারা তাই এই মামলার বিষয়ে উৎসাহী ও আস্থাবান। পাশ্চাত্যের বেশ কয়েকটি দেশ এই আইনি প্রতিকারের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে। কানাডা ও নেদারল্যান্ডসের পর গেল সপ্তাহে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী দেশটির পার্লামেন্টে এই আইনি প্রক্রিয়ার প্রতি সমর্থনের কথা জানিয়েছেন।

কোনো অন্তর্বর্তী আদেশ দেওয়ার আগে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে, এটি নিশ্চিত হওয়ার কোনো বাধ্যবাধকতা আন্তর্জাতিক আদালতের নেই। গণহত্যা সনদে স্বাক্ষরকারী কোনো রাষ্ট্র কোনো সংঘাতের ক্ষেত্রে কোনো জনগোষ্ঠীকে সম্ভাব্য গণহত্যা থেকে সুরক্ষা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে কি না, তা বিচারের ক্ষমতা আন্তর্জাতিক আদালতকে দেওয়া আছে। এই আলোকে বিষয়টি পুরোপুরি ১৭ বিচারপতির বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল।

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) সঙ্গে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) মৌলিক পার্থক্য হচ্ছে, আইসিজে কোনো ব্যক্তির বিচার করছে না, যেটি আইসিসি করে থাকে। অপরাধ সংঘটিত হয়েছে কি না, তা যাচাই করা বা তদন্তের কাজটি আইসিসির একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। কিন্তু আইসিজে কোনো তদন্ত করে না, বরং আন্তর্জাতিক চুক্তির বাধ্যবাধকতাগুলো কোনো দেশ মানছে কি না, সেটা নির্ধারণ করে এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়। আইসিজের সামনে এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে জাতিসংঘের তথ্য অনুসন্ধানী দলের প্রতিবেদনগুলো।

রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা ও তাদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে গাম্বিয়া যে ছয়টি অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপ নেওয়ার আবেদন জানিয়েছে সেগুলো হচ্ছে: রোহিঙ্গাদের গণহত্যাসহ সব ধরনের নিপীড়ন থেকে সুরক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করা, সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীসহ সব সশস্ত্র বাহিনী ও সংগঠনকে গণহত্যা সংঘটন ও গণহত্যার ষড়যন্ত্র থেকে নিবৃত্ত রাখা, গণহত্যার কোনো আলামত নষ্ট না করা, পরিস্থিতির অবনতি ঘটে এমন কোনো কিছু করা থেকে বিরত থাকতে বলা, এসব নির্দেশনা পালনের বিষয়ে মিয়ানমার এবং গাম্বিয়া চার মাসের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন পেশ এবং জাতিসংঘের তদন্তকারীসহ অন্যদের তদন্তের প্রয়োজনে আরাকানে ধ্বংসপ্রাপ্ত রোহিঙ্গাদের গ্রামগুলোতে অবাধ প্রবেশাধিকার দেওয়া।

আইসিজের সিদ্ধান্ত সব রাষ্ট্রের জন্যই মেনে চলার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে তার ব্যতিক্রমও ঘটেছে। কোনো রাষ্ট্র এই আদালতের সিদ্ধান্ত প্রতিপালন না করলে অপর পক্ষ বিষয়টি বাস্তবায়নের জন্য নিরাপত্তা পরিষদের শরণাপন্ন হতে পারে। মিয়ানমারের ক্ষেত্রে অনেকেরই সেই আশঙ্কা আছে। কেননা, নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো ক্ষমতার অধিকারী চীন ও রাশিয়া রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়ে মিয়ানমারকে প্রায় শর্তহীন সমর্থন দিয়ে চলেছে।