Thank you for trying Sticky AMP!!

লোকজ শিল্পের দুই বিশ্বযাত্রী

বাংলার লোকজ কারুশিল্পের ধারাকে দেশের সীমানা ডিঙিয়ে বিশ্বদরবারে পরিচিত করিয়েছেন দুই শিল্পী। তাঁরা কেউ কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে শিল্পী হননি। বংশপরম্পরায় শিল্পনির্মাণের শৈলী মিশে আছে তাঁদের রক্তে। মুন্সিগঞ্জের শম্ভু আচার্য বাংলার পটচিত্র আর ধামরাইয়ের সুকান্ত বণিক কাঁসা-তামার শিল্পকে নতুন প্রাণ দিয়েছেন। তাঁরা প্রমাণ করেছেন, শিল্প-সংস্কৃতিতে বাঙালির আছে সমৃদ্ধ ঐতিহ্য। ১৯৯৯ সালে শম্ভুর পটচিত্র দিয়েই লন্ডনে বাংলাদেশ ফেস্টিভ্যাল উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ইংল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার। সুকান্তর প্রত্যয়, ধামরাইয়ের কাঁসা-পিতলশিল্পকে তিনি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেবেন।

কাঁসাশিল্প: সুকান্ত বণিকের একটি কাজ


কাঁসা-পিতলের সুকান্ত বণিক
ধামরাই রথখোলা মোড় পেরিয়ে সুকান্ত বণিকের পুরোনো বাড়িটির নিচতলার প্রায় সব কটি ঘর কাঁসা-পিতলের শিল্পকর্মে ভর্তি। পিতলের কলসি থেকে শুরু করে বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তির বিশাল সম্ভার সেখানে। আরও আছে ঘর সাজানোর বিচিত্র সব সামগ্রী। দুই ঘরের মাঝখানে রাখা টেবিলে বিশাল দুটি দাবার বোর্ড। সেটির ওপর সৈন্য, ঘোড়া, রাজা সবই পিতলের। শত বছরের পুরোনো এ বাড়িটিতেই কারখানা আর শোরুম। 

১০ এপ্রিল মঙ্গলবার ভরদুপুরে স্বাগত জানালেন কাঁসা-পিতলে কারুকাজের নকশাকার সুকান্ত। তিনিই কারিগরদের নির্দেশনা দেন। ‘এটি আমার পারিবারিক ব্যবসা। ২০০ বছরে প্রায় পাঁচ প্রজন্ম ধরে এ ব্যবসা করে যাচ্ছি’, বললেন সুকান্ত বণিক। বংশের পঞ্চম প্রজন্মের প্রতিনিধি তিনি। বারান্দায় এসে আশপাশের আরও অভিজাত কিছু পুরোনো ভবন দেখিয়ে বললেন, ‘এখানকার প্রায় সব বাড়িই হয়েছে কাঁসার ব্যবসার টাকা থেকে।’ একটা ঘরে এসে গোল একটি বাটি হাতে নিলেন সুকান্ত। একটি ধাতব বস্তু দিয়ে সেটির বাইরের গা ঘেঁষে চারপাশে ঘোরালেন। এতে একটি অদ্ভুত সম্মোহনী আওয়াজ সৃষ্টি হলো। এ পাত্রকে বলে জামবাটি (সিংগিং বোল)। ধ্যানের সময় এটি ব্যবহার করা হয়। পাত্রটি দেখিয়ে সুকান্ত বলেন, ‘এমন বাটি পরে আর তৈরি করা যায়নি। কারণ, এর কারিগর নেই। এ শিল্পের ওপর প্রথম আঘাত আসে ১৯৪৭ সালে, পরের ধাক্কা ১৯৭১ সালে। সব গুছিয়ে এরপর ১৯৭৮ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ব্যবসা মোটামুটি ভালো ছিল। ১৯৯০ সাল থেকে ব্যবসার অবস্থা আবার খারাপ হতে শুরু করে। এ সময়টাতে বদলে যেতে থাকে সবকিছু। কাঁসা-পিতলের জায়গা দখল করে নিয়েছে ফাইবার, স্টেইনলেস স্টিল, অ্যালুমিনিয়াম, সিরামিকের তৈরি বাসনপত্র। আধুনিকতার ধাক্কায় সংকট নেমে এসেছে কাঁসা-পিতলশিল্পেও। কারিগরেরা চলে গেছেন বিকল্প জীবিকার সন্ধানে। সুকান্ত জানালেন, ২০০৬ সালেও তাঁর কারখানায় শ্রমিকসহ কাজ করতেন মোট ২২ জন কারিগর। বর্তমানে আছেন মাত্র ছয়জন। এলাকার অনেক কারিগর পেশা বদল করেছেন সংকটে পড়ে।

সুকান্ত বণিক

মন্দা অবস্থায়ও হাল ছাড়েননি সুকান্ত। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর শেষে অন্য কোনো পেশায় না গিয়ে ঠিক করেন, পিতৃপুরুষের কাঁসা-পিতলই হবে তাঁর পেশা, নেশা ও ধ্যান। গৃহসজ্জামূলক প্রাচীন শিল্পকর্ম তৈরির দিকে গুরুত্ব দিলেন তিনি। ২০০১ সালে একটি সাংস্কৃতিক দলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল তাঁর। তখন বিদেশিদের নিজের কাজ দেখানোর সুযোগ পান তিনি। ২০০২ সালে মার্কিন দূতাবাস থেকে কাঁসা-পিতলশিল্প সংরক্ষণের জন্য ১৪ হাজার ৩০০ ডলার অনুদান পান তিনি। সেই টাকায় তৈরি হয় একটি তথ্যচিত্র। ২০০৭ সালে সুইজারল্যান্ডে সেটি প্রদর্শিত হলে সাড়া পড়ে যায়।
ধামরাইয়ে যে ছাঁচ তৈরি করে ভাস্কর্য তৈরি হয়, সেটিকে বলে লস্ট ওয়ার্কস পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে একটা ভাস্কর্য একবারই বানানো সম্ভব। সে কারণে প্রতিটি ভাস্কর্যই অনন্য ও অসাধারণ। সুকান্ত বণিক বলেন, কাঁসা-পিতলের তৈরি জিনিসপত্র একবার কিনলে তা ৩০-৪০ বছরের বেশি সময় ধরে ব্যবহার করা যায়।
ধামরাইয়ের কাঁসা-পিতলসামগ্রীর চাহিদা আছে ইউরোপে, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রে। বিদেশিদের মধ্যে বিভিন্ন আকৃতির বুদ্ধমূর্তি (যেমন জাপানি, নেপালি, ভারতীয়, ময়নামতির বুদ্ধ), ধর্মীয় ও পৌরাণিক চরিত্র, যেমন শিব, বিষ্ণু, রাধা-কৃষ্ণের মূর্তি-এসবের খুব চাহিদা।
বাড়িটার সংস্কার চলছে। এ শিল্প নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি সুকান্তের স্বপ্ন, বাড়ির একটা অংশে জাদুঘর করবেন, যেখানে স্থান পাবে ঐতিহ্যের গৌরব।
শিল্পী হাশেম খান প্রথম আলোকে বললেন, ‘সুকান্ত বণিকের চেষ্টা প্রশংসার যোগ্য। কাঁসা-পিতল আগে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত হতো। এটা আমাদের ঐতিহ্য। সচেতনভাবে এটাকে টিকিয়ে রাখা আমাদের সকলের কর্তব্য।’

শম্ভু আচার্যের অাঁকা পটচিত্র


পটচিত্রের শম্ভু আচার্য
সাড়ে চার শ বছর ধরে পটচিত্রের গৌরবময় ঐতিহ্যের ধারাকে বাঁচিয়ে রেখেছে মুন্সিগঞ্জের কালিন্দীপাড়ার ঠাকুরবাড়ির আচার্য পরিবার। আট পুরুষ ধরে এ শিল্পকে লালন করে চলেছেন তাঁরা। সেই বংশধারার নবম পুরুষ শম্ভু আচার্য। ৯ এপ্রিল সোমবার সকালে নিজের ঘরে বসে গাজীর পটে চূড়ান্ত কাজ সারছিলেন তিনি। সঙ্গে ছেলে অভিষেক আচার্য। কাজের ফাঁকে ফাঁকে কথা বললেন শম্ভু আচার্য।
১৯৭৭ সালের ঘটনা। সেবার কারুশিল্পবিশারদ তোফায়েল আহমেদ কলকাতার আশুতোষ জাদুঘরে দেখেন, একটি পটচিত্রের পাশে লেখা ‘উভয় বঙ্গের একমাত্র গাজীর পট’। তোফায়েল আহমেদ নিজেই অবাক-বাংলাদেশে কোনো পটচিত্রী আছেন, সেটা জানা ছিল না তাঁর। দেশে ফিরে তোফায়েল আহমেদ খোঁজখবর নিলেন। নরসিংদী গিয়ে জানলেন, সেখানে গায়েন দুর্জন আলীর কাছে গাজীর পট আছে। দুর্জন আলী জানালেন, এটি মুন্সিগঞ্জের সুধীর আচার্যের কাছ থেকে কেনা। সুধীর আচার্য হলেন শম্ভু আচার্যের বাবা। সেই থেকে আচার্য পরিবারের পটচিত্রের গৌরবের প্রচার শুরু।
শম্ভু বংশপরম্পরায় আঁকাআঁকিতে এলেও বাবার সঙ্গে সামান্য তফাত আছে ছেলের। বাবা আঁকতেন গামছায়, শম্ভু আঁকেন ক্যানভাসে। আঁকার ক্যানভাসটি বিশেষভাবে প্রস্তুত করেন নিজেই। ইটের গুঁড়া ও চক পাউডারের সঙ্গে তেঁতুলবিচির আঠা মিশিয়ে তৈরি হয় মিশ্রণ। এ মিশ্রণ মার্কিন কাপড়ে লেপে দিয়ে তৈরি হয় আঁকার জমিন। এর ওপরই চলে রেখা-রঙের খেলা। ইটের গুঁড়া, তেঁতুলবিচি, ডিমের কুসুম, সাগুদানা, বেলের কষ, মাটি, নীল, সিঁদুর, মশালের ধোঁয়া-এসব দিয়ে তৈরি হয় রং। আর তুলি বানানো হয় ছাগলের লোম দিয়ে।
২০০৬ সালে গ্যালারি কায়ার উদ্যোগে একটি কর্মশালা পরিচালনা করেছিলেন শম্ভু আচার্য, যেখানে তিনি এসব রঙের দ্রব্যগুণ ও পটচিত্র সম্পর্কে এ দেশের গুণী শিল্পীদের হাতে-কলমে শিখিয়েছিলেন। সেই কর্মশালায় অংশ নিয়েছিলেন প্রখ্যাত শিল্পী আমিনুল ইসলাম, কাইয়ুম চৌধুরী, মুর্তজা বশীর, সমরজিৎ রায়চৌধুরী, নিতুন কুন্ডু, হামিদুজ্জামান খান, কালিদাস কর্মকার প্রমুখ।

শম্ভু আচার্য

জাতীয় কারুশিল্প পরিষদের আজীবন সম্মাননা পেয়েছেন শম্ভু আচার্য।
শম্ভু আচার্য মূলত ঐতিহ্যবাহী পটচিত্রধারার চিত্রকে নতুন আঙ্গিকে ফুটিয়ে তুলেছেন। যেখানে বিলুপ্তপ্রায় লোকচিত্রধারা উপস্থাপিত হয়েছে নতুনভাবে। তাঁর ক্যানভাসে এখন উঠে এসেছে সমসাময়িক গ্রামীণ ও নাগরিক জীবন। ফুল, পাখি, জেলে, কামার, কুমার, তাঁতির সরল জীবন যেমন উঠে এসেছে, তেমনি বারবার এসেছে রাসলীলা, মহররম পর্ব, ময়ূরপঙ্খি, কৃষ্ণের নৌকাবিলাস।
শম্ভু আচার্যের পটচিত্র পৌঁছে গেছে ব্রিটিশ মিউজিয়াম, চীনের কুবিং মিউজিয়াম ও জাপানের ফুকুওকা মিউজিয়ামে। ইতিমধ্যে শিল্পী শম্ভু আচার্যের ছবি নিয়ে হয়েছে বেশ কয়েকটি একক প্রদর্শনী। প্রথমটি হয় ১৯৯৫ সালে ইন্দোনেশিয়ায়। ১৯৯৯ সালে লন্ডনে। প্রদর্শনী হয়েছে দেশে স্বনামধন্য গ্যালারিগুলোতে। ২০০৭ ও ২০০৮ সালে চীনে তাঁর ছবির দুটি প্রদর্শনী হয়।
শম্ভু আচার্য বলেন, ‘আমরা পারিবারিকভাবে এ ধারাকে টিকিয়ে রেখেছি। আমার তিন মেয়ে, এক ছেলে। তারাও পটচিত্র আঁকছে।’
শম্ভু আচার্যকে নানা সময় সহায়তা ও উৎসাহ দিয়েছেন নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, শম্ভু তাঁর পারিবারিক ঐতিহ্য ধারণ করে তাতে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি যুক্ত করেছেন। তিনি পটের ছবি আঁকেন ঐতিহ্য অনুসরণ করে, তবে বিষয় হিসেবে বেছে নেন আধুনিক জনজীবন।