Thank you for trying Sticky AMP!!

সেলিম চৌধুরী, মাহবুবা পারভীন, দৌলতুন্নাহার

শরীরের স্প্লিন্টার নিয়ে কারো লড়াই, কারো মৃত্যু

স্প্লিন্টারের আঘাতে ঝাঁজরা শরীর নিয়েই হেটে অনেক দূর এসেছিলেন সেলিম চৌধুরী। কেউ তাঁকে ধরে বাড়ি নিয়ে যায়। স্বজনেরা এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছোটেন। রাত পেরোলেও চিকিৎসা করাতে পারেননি। ওদিকে রক্ত ঝরতে ঝরতে শরীর সাদা হয়ে যাচ্ছিল। পরদিন ভোরের দিকে রক্ত দেওয়ার বন্দোবস্ত হয়।

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগের ওপর নৃশংস গ্রেনেড হামলা হয়। সে হামলার অন্যতম শিকার সেলিম চৌধুরী আহত অবস্থাতেই যন্ত্রণা বয়ে গত বছর মারা যান।

গত বছরের ১৬ নভেম্বর সেলিম চৌধুরী মারা যান। তাঁর স্ত্রী তাসলিমা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওনার তো শরীর খারাপই থাকত। চিকিৎসার উপরেই ছিল। কিন্তু শেষের দিকে এসে শরীর বেশি খারাপ হয়ে যায়। পরে শ্বাসকষ্ট নিয়ে তিনি মারা যান।’

‘ওনার তো শরীর খারাপই থাকত। চিকিৎসার ওপরেই ছিল। কিন্তু শেষের দিকে এসে শরীর বেশি খারাপ হয়ে যায়। পরে শ্বাসকষ্ট নিয়ে তিনি মারা যান।’
তাসলিমা আক্তার, সেলিম চৌধুরীর স্ত্রী

সেলিম চৌধুরী ব্যবসা করতেন। আওয়ামী লীগের কর্মী ছিলেন। দলীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যেতেন নিয়মিত।

২০০৪ সালের ২১ আগস্টের কথা স্মরণ করে তাঁর স্ত্রী তাসলিমা আক্তার বলেন, ‘সেদিন এক বন্ধুর সঙ্গে তিনি সমাবেশে যান। হামলার পর তাঁর সারা শরীর স্প্লিন্টারে ঝাঁজরা হয়ে যায়। গায়ের শার্ট, প্যান্ট রক্তে ভিজে যায়। কেউ একজন ধরে একটা গাড়িতে তুলে দেয়। ওই গাড়ি উনাকে নিয়ে নিকুঞ্জে বাসায় সামনে এনে পৌছায়। সেদিন অনেক হাসপাতালে ঘুরেছি, কেউ ভর্তি নিতে চায়নি। শরীর সাদা হয়ে গেছিল। পরে ভোরে বেসরকারি একটা হাসপাতালে নিয়ে রক্ত দিই। পরদিন ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করতে পারি।’

তাসলিমা জানান, হামলার পর সেলিম চৌধুরী চিকিৎসার জন্য অনেকবার ভারতে যান। পেটের স্প্লিন্টার তাঁকে খুব ভুগিয়েছে। কয়েকবার অপারেশন হয়। যন্ত্রণায় সেলিম রাতে ঘুমাতে পারত না।

সেলিম চৌধুরী ও তাসলিমার ঘরে দুই মেয়ে ও এক ছেলে। এখন থাকেন ধামরাইয়ে। হামলায় আহত হওয়ার পর সহায়তা পেয়েছেন জানিয়ে তাসলিমা বলেন, ‘দল থেকে নিয়মিত ভাতা দিছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনেক রকমের সাহায্য করছেন। এফডিআর করে দিছে। মিরপুরে ফ্ল্যাট দিছে। তবে যারা এই ঘটনা ঘটাইছে তাঁদের উপযুক্ত বিচার দেখে মরতে চাই।’

‘দল থেকে নিয়মিত ভাতা দিছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনেক রকমের সাহায্য করছেন।’
তাসলিমা আক্তার

চোখ হারানো দৌলতুন্নাহারের একটি পা-ও অচল:

এখনো যন্ত্রণায় কাতরান দৌলতুন্নাহার। গ্রেনেড হামলায় বাঁ চোখ হারিয়েছেন। ডান পা-ও অচল। দৌলতুন্নাহারের নিজ বাসাতেই এখন সময় কাটে। শারীর খারাপ থাকে প্রায়ই। তবুও শরীর ভালো থাকলে দলের কিছু কিছু অনুষ্ঠানে যাওয়ার চেষ্টা করেন।

দৌলতুন্নাহার প্রথম আলোকে বলেন, ‘পারিবারিকভাবেই আমরা আওয়ামী লীগ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। ২১ আগস্টের দিন মহিলা আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগর উত্তর থেকে সমাবেশে গিয়েছিলাম। আমি ওই ট্রাকের (মঞ্চের) কাছাকাছিই ছিলাম। হামলার পরে আমার কোনো জ্ঞান ছিল না। যখন জ্ঞান ফেরে দেখি হাসপাতালে। আমার পেট কাটা। নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে গিয়েছিল। বাঁ চোখটা নষ্ট হয়। বাম পা–ও অচল। ডান পায়ে ভর দিয়ে হাঁটতে পারি না। বাঁ হাতও ভাঙে। অনেক ক্ষতি হয় আমার শরীরের। ওই সময় নেত্রী (শেখ হাসিনা) দেশের বাইরে চিকিৎসার জন্য পাঠিয়েছিলেন। তাতে শরীরটা ধীরে ধীরে ঠিক হয়। এখনো শরীরের সেই কষ্ট নিয়েই বেঁচে আছি।’

ঢাকার পল্লবীতে স্বামী ও দুই মেয়েকে নিয়ে থাকেন দৌলতুন্নাহার। তিনি বলেন, ‘বয়স হচ্ছে তো, ব্যথাও বেড়েছে। রাতে প্রায়ই জ্বর আসে। কষ্ট পাই। এখনো চিকিৎসা নিতে হয়। প্রধানমন্ত্রী আমাদের জন্য অনেক করেছেন। উনি এখনো দেখে রাখেন।’ অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চান জানিয়ে এই ভুক্তভোগী বলেন, ‘যে-ই করুক না কেন, ফাঁসি চাই। আমাদের শরীরে স্প্লিন্টারের ব্যথা যতবার ওঠে ততবার ওদের ফাঁসি চাই।’

মরার আগে সাংসদ হতে চান মাববুবা

মাববুবা পারভীন শরীরের ভেতরে থাকা ১৮শ স্প্লিন্টার এখনও তাঁকে রাতে ঘুমাতে দেয় না। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পর রক্তাক্ত অবস্থায় পড়েছিলেন। মৃত ভেবে নেওয়া হয়েছিল লাশ ঘরেও। অনেক চিকিৎসার পরও এখনো ভালোভাবে হাঁটতে পারেন না। অন্যের সাহায্য ছাড়া দূরে কোথাও যাওয়া সম্ভব হয় না তাঁর।

তৎকালীন ঢাকা জেলা আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক মাহবুবা পারভীন ২১ আগস্টের ওই সমাবেশে সামনের সারিতেই ছিলেন। তিনি জানান, দলের সভাপতি শেখ হাসিনার বক্তব্য শেষ হতে না হতেই শুরু হয় গ্রেনেড হামলা। কিছু বুঝে উঠার আগেই মাহবুবার বাম পা, বাম হাত ও কোমর অবশ হয়ে যায়। এর আর কিছু মনে নেই তাঁর, জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।

মাহবুবা প্রথম আলোকে বললেন, শরীরের ভেতরে থাকা ১৮শ স্প্লিন্টার তাঁকে প্রতি মুহূর্তে সেই ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার কথাই মনে করিয়ে দেয়। বাইরে কোনো ক্ষত না থাকলেও স্প্লিন্টারগুলো শরীরের ভেতরে নড়াচড়া করায় যন্ত্রণা হয়। রাতে এই যন্ত্রণা আরও বেড়ে যায়। তাই ঘুমাতে পারেন না। ঘুমানোর জন্য প্রতি রাতে ঘুমের বড়ি খেতে হয়।

মাহবুবা বললেন, ‘এত কষ্টের মধ্যেও শান্তি পেতাম, মরার আগে যদি একবার সংরক্ষিত নারী আসনের সাংসদ হতে পারতাম।’

‘এত কষ্টের মধ্যেও শান্তি পেতাম। মরার আগে যদি একবার সংরক্ষিত নারী আসনের সাংসদ হতে পারতাম।’
মাহবুবা পারভীন, ঢাকা জেলা আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের তৎকালীন মহিলাবিষয়ক সম্পাদক

সাভার পৌর এলাকার ব্যাংক কলোনিতে বাবার দেওয়া ছোট্ট এক টুকরা জমিতে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া অনুদান, স্বজনদের সহায়তা ও ধার করে দোতলা বাড়ি নির্মাণ করছেন মাহবুবা। এরমধ্যে বাড়ির দ্বিতীয় তলায় ছোট দুইটি ফ্ল্যাট এবং নিচতলায় একটি ছোট কক্ষ নির্মাণের কাজ শেষ করতে পেড়েছেন। দুই ছেলে নিয়ে তিনি বাড়ির একটি ফ্ল্যাটে থাকেন। এ ছাড়া রাজধানীর মিরপুরে একটি ফ্ল্যাট রয়েছে, যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিয়েছেন।

মাহবুবার স্বামী অবসরপ্রাপ্ত ফ্লাইট সার্জেন্ট এম এম মাসুদ ২০১৬ সালে মারা গেছেন। বড় ছেলে আসিফ পারভেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ আর ছোট ছেলে রোসাদ জোবায়ের নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে স্থাপত্যবিদ্যায় পাস করে চাকরি চেষ্টা করছেন।

Also Read: ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ধারাবাহিক হত্যাচেষ্টার চূড়ান্ত রূপ

সেলিনার খাতুনের শরীরটাই স্প্লিন্টার:

‘বোনের সঙ্গে হয়তো সেদিন আমিও মরে যেতাম। পানি খেয়ে ফিরে ভিড়ের মধ্যে খুব সামনে দাঁড়ানোর সুযোগ পাই নাই। তাই মরে যাই নাই। কিন্তু সারা গায়ে গ্রেনেডের স্প্লিন্টার লাগে।’ সারা শরীরে স্প্লিন্টার নিয়েই বেঁচে আছেন সেলিনা খাতুন। বললেন, ‘শরীরটাকেই স্প্লিন্টার মনে হয়। সারা গায়েই ব্যথা করে। মাথায় সমস্যা বেশি।’

১৯৯৫ সাল থেকে সেলিনা খাতুন রাজনীতিতে যুক্ত হন। ধানমন্ডি ৫১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। তিনি এখন খিলক্ষেত থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক। স্বামী ২০০০ সালে মারা যান। মেয়েকে নিয়ে থাকেন মিরপুরে থাকেন। দল থেকে ভাতা পান।

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার কথা স্মরণ করে সেলিনা খাতুন বলেন, ‘ধানমন্ডি আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিছিলে সেদিন বেলা ৩টায় সেখানে যাই বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে। ভিড় ঠেলে ট্রাকের ওপর যে মঞ্চ, সেটার কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করি। আইভি আপার পাশেই ছিলাম। সেদিন অনেক রোদ ছিল। রোদের মধ্যে দাঁড়ায়ে ছিলাম। বেশ পানির পিপাসা পায়। পরে একজন একটা দোকান দেখায়ে দিলে আমি পানি খেয়ে আসি। কিন্তু পরে ভিড়ের কারণে আইভি আপা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারি নাই। তিনজনের পেছনে ছিলাম। তখন দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার বক্তব্য একদম শেষের দিকে। এরমধ্যেই দক্ষিণ থেকে কী যেন এসে পড়ল আইভি আপার ওপর। কী হইলো আর কিছু মনে নাই। আমার বড় বোন সুফিয়া খাতুন সেখানে ছিলেন। আপা সেখানেই মারা যান। বোনের সঙ্গে হয়তো সেদিন আমিও মরে যেতাম।’

গ্রেনেড হামলার পর কে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয় তা মনে করতে পারেন না সেলিনা খাতুন। তিনি বলেন, ‘আমি জ্ঞান হারায়ে ফেলি। কারা যে হাসপাতালে নিল, কী হইলো, মনে করতে পারি নাই। টিয়ার গ্যাসে চোখ জ্বলছিল। আল্লাহ আমাকে বাঁচায়ে দেয়।’