Thank you for trying Sticky AMP!!

শুভ জন্মদিন নজরুলসংগীতশিল্পী ইয়াকুব আলী খান

ইয়াকুব আলী খান। ছবি: সংগৃহীত

ছোটবেলা থেকেই নজরুলসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত বড়ে গোলাম আলী খান সাহেব ও মেহেদী হাসানের গজলের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। ১৯৭৫ সালে তিনি ঢাকা সংগীত কলেজে ভর্তি হন। শান্ত-মারিয়াম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংগীতে মাস্টার্স করেন। বাংলাদেশ ও দেশের বাইরে অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেন।

তিনি হলেন সংগীতসাধক ইয়াকুব আলী খান। তাঁর জন্ম ১৯৫৬ সালের ১০ আগস্টে টাঙ্গাইলের নাগরপুরের কাজিরপাচুরিয়া গ্রামে।

সিটিসেল চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ড, নজরুল পুরস্কার, আর টিভি স্টার অ্যাওয়ার্ড-২০১৭ সহ এখন পর্যন্ত নানা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন ইয়াকুব আলী খান। ‘পাটিওয়ালা’ ও ‘কিরানা’ ঘরানার ওপর তালিপ্রাপ্ত হওয়ার কারণে দীর্ঘদিন শাস্ত্রীয় ও রাগসংগীতের ওপর বিরাট দখল ও অভিজ্ঞতা থাকার ফলে ‘মিরপুর ঘরানা’ নামে একটি নতুন আঙ্গিকের বাংলা সংগীতের ধরন তিনি চালু করেন।

নজরুল একাডেমিসহ সরকারি ও বেসরকারি নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইয়াকুব আলী খান ভারপ্রাপ্ত প্রধানের দায়িত্বে আছেন। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষক ও প্রশিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি মুক্ত আসরের আয়োজন আমিই নজরুলের ‘নজরুল সারথি’ অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে ছিলেন ১৭ জুলাই। সেখানে তিনি তাঁর জীবনকর্ম নিয়ে অনেক কথা বলেন। তাঁর সেই কথাগুলোর কিছু অংশ তুলে দেওয়া হলো।

ইয়াকুব আলী খান বলেন, একদম শিশু বয়সে যখন মায়ের কোলে ছিলাম, তখন থেকেই সংগীতপ্রীতির সূচনা। আমার মনে পড়ে তখন গান না শুনলে ঘুমাতাম না। আমার এক ভাবি ছিলেন, তিনি প্রতি সন্ধ্যায় আমাকে কোলে নিয়ে গান শুনিয়ে ঘুম পাড়াতেন। তিনি আর পৃথিবীতে বেঁচে নেই। যখন আমার একটু বুঝ হলো, তখন গান শোনার একমাত্র মাধ্যম ছিল গ্রামোফোন। আমার প্রতিবেশী দুই ভাই খুব শৌখিন ছিলেন, তাঁরা গ্রামোফোনে গান বাজালে আমি শুনে দৌড়ে চলে যেতাম। সেই শিশু বয়সে আমার সংগীতপ্রীতি এমনই ছিল যে আমি সেই বাসায় সারা দিন গিয়ে বসে থাকতাম। তারপর যখন একটু বড় হতে শুরু করলাম, গ্রামে একটা–দুটো করে রেডিও আসতে শুরু করল। যখন গ্রামোফোন রেকর্ডের গান শুনতাম, সেখানে আব্বাসউদ্দীনের নজরুলসংগীত ছিল, যা আমাকে বিশেষভাবে টানত। তাই পরবর্তী সময়ে যখন রেডিওতে গান শুনতাম, তখন কাজী নজরুল ইসলামের গানই আমাকে বেশি আকর্ষণ করত। সপ্তম–অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় আমার পাশের গ্রামে হিন্দুপ্রধান বসতি ছিল এবং সেখানে একটি হারমোনিয়ামের দোকান ছিল। পাশের গ্রামে গান-বাজনার আয়োজন হলে আমি সেখানে ছুটে যেতাম। হাইস্কুলে পড়ার সময় থেকেই আমার মাথায় চিন্তা এল হারমোনিয়াম বাজিয়ে প্রথাগতভাবে গান শেখার, তখন আমি হারমোনিয়াম কিনি একটা আর নিজে নিজে গান বাজিয়ে গাওয়ার চেষ্টা শুরু করি।

সংগীতসাধক ইয়াকুব আলী খান। ছবি: সংগৃহীত

ইয়াকুব আলী খান বলেন, স্বাধীনতার পর এ দেশে স্কুল–কলেজে সাংস্কৃতিক চর্চার একটা জোয়ার আসে আর আমি তখন স্কুল–কলেজে গান গাইতাম। এমনই এক আয়োজনে বাবার পুলিশ অফিসার বন্ধু আমার গান শোনেন আর বাবাকে বলেন, খাঁ সাহেব, আপনি মস্ত বড় ভুল করছেন। আপনি আপনার ছেলেকে ওস্তাদ রেখে গান শেখাচ্ছেন না কেন? আপনার ছেলে তো মস্ত বড় গাইয়ে হবে একদিন। সেই কথায় বাবা খুব প্রভাবিত হলেন। যদিও সেই সময় মুসলিম পরিবারগুলোতে গান–বাজনার প্রচলন কম ছিল। মা তো আমাকে শৈশব থেকেই উৎসাহ দিতেন সংগীতের ব্যাপারে। সেই সঙ্গে বাবাও এবার যুক্ত হলেন, বাড়িতে সংগীতের শিক্ষক হিসেবে রাখলেন বাবু পূর্ণ চন্দ্র সূত্রধরকে। আর এখান থেকেই প্রথাগত সংগীতের তালিম নেওয়া ও রাগসংগীত শেখা শুরু হলো। পরে স্বাধীনতার সময় আমার সংগীতশিক্ষক ময়মনসিংহের প্রবীর কুমার চ্যাটার্জির কাছে উচ্চাঙ্গ ও নজরুলসংগীতের পদ্ধতিগত তালিম নিই। সেই থেকেই নজরুলসংগীতের জগতে আমার প্রবেশ। রাগসংগীতের চর্চার পাশাপাশি পল্লিগীতি, ছায়াছবির গানও পাশাপাশি গাইতাম। এরপর স্কুলজীবন শেষ করে নাগরপুর কলেজে ভর্তি হই। কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে পেলাম ভূয়সী প্রশংসা। ১৯৭৫ সালে ঢাকা এসে সরকারি সংগীত কলেজে ভর্তি হয়ে পুরোদমে উচ্চাঙ্গ ও নজরুলসংগীত শেখা শুরু করি।

ইয়াকুব আলী খান আরও বলেন, সেগুনবাগিচায় শিল্পকলা একাডেমির দক্ষিণে ছোটখাটো জমিদার বাড়িতে ছিল ঢাকা মিউজিক কলেজ। ১৯৭৬ সালে সেখানে সংগীত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, আর আমি তাতে উচ্চাঙ্গসংগীত পরিবেশনের সুযোগ পেলাম। দৈনিক পত্রিকার প্রথম পাতায় আমার ছবি ছাপা হয়। আফসোস তখন এর গুরুত্ব বুঝিনি, তাই সংরক্ষণ করে রাখাও হয়নি। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ মেডিকেল শিক্ষার্থী ‘আশরাফ’, যিনি একজন নজরুলসংগীতশিল্পী ছিলেন, তাঁর স্মৃতির উদ্দেশে নজরুল একাডেমির তত্ত্বাবধানে ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ আয়োজিত দেশব্যাপী সব বয়সের জন্য উন্মুক্ত ‘আশরাফ স্মৃতি স্বর্ণপদক’ প্রতিযোগিতাটি অনুষ্ঠিত হতো। ১৯৭৯ সালে সংগীত মহাবিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থাতে প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে প্রথম স্থান অধিকার করি। ঢাকা শহরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও একাডেমি তখন আমায় সংবর্ধনা দিয়েছিল সাফল্যের জন্য। বাংলাদেশ টেলিভিশন তখন রামপুরায় কেবল শুরু হয়েছে। আমার সাক্ষাৎকার নেওয়া হলো। সাক্ষাৎকারের পরপরই বাংলাদেশ বেতারের একজন বড় কর্মকর্তা (সংগীতবিষয়ক অনুষ্ঠানের প্রযোজক) আমাকে ডাকলেন, যিনি টেলিভিশনে আমার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন তাঁর মাধ্যমে। তখন বেতারে অডিশন দেওয়া মানে মারাত্মক কঠিন ব্যাপার ছিল। আমি কয়েকবার অ্যাপ্লিকেশন দিয়ে চেষ্টা করলেও অডিশন দেওয়ার সুযোগই মেলেনি। আমাকে বলা হলো, আপনাকে নেওয়ার খুব ইচ্ছা আমাদের। আপনি একটি ফরমাল অডিশন দিয়ে বাংলাদেশ বেতারে তালিকাভুক্ত হয়ে যান। গানের ওস্তাদের কাছে অনুমতি নিয়ে অডিশন দিলাম। নজরুল ও উচ্চাঙ্গসংগীতে উত্তীর্ণ হলাম। পরে টেলিভিশনে আর নজরুলসংগীতে কোনো অডিশন দেওয়া লাগেনি। উচ্চাঙ্গসংগীতে অডিশন দিয়ে তালিকাভুক্ত শিল্পী হয়ে যাই। এভাবেই মিডিয়া জগতে আমার প্রবেশ।

ইয়াকুব আলী খান বলেন, আমি পরিবারে সবার ছোট ছেলে। আমাকে চিকিৎসক বানানোর জন্য বাড়ির বড়রা উঠেপড়ে লেগেছিল। মেডিকেলে ভর্তি না হয়ে হাতে সংগীত মহাবিদ্যালয়ে ভর্তির কাগজপত্র নিয়ে বাসায় হাজির হওয়া দেখে সেজ ভাই খুব মর্মাহত হলেন। বরাবরই সংগীত আমার নেশা, যা কালক্রমে পেশায় পরিণত হলো। জীবনের এতগুলো বছর খুব সুখ আর আনন্দে কেটেছে সংগীতকে নিয়ে।

এই গুণী শিল্পীর আজ জন্মদিন। তাঁকে আন্তরিকভাবে জানাই শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

*লেখক: মুক্ত বন্ধু, মুক্ত আসর