Thank you for trying Sticky AMP!!

ষড়যন্ত্রের শুরু জানুয়ারিতে

২৫ মার্চ কালরাতে অপারেশন সার্চলাইট নামক গণহত্যার যে অভিযান চালানো হয়, তার অন্যতম প্রধান টার্গেট ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি আবাসিক হল। ইকবাল হলের (সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ক্যানটিনের সামনে বেশ কয়েকটি মৃতদেহ পড়ে ছিল ২৭ মার্চ পর্যন্ত। ছবি: সংগৃহীত

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতের পর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ঢাকায় ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে যে সামরিক অভিযান চালায়, পাকিস্তানি জেনারেল এ এ কে নিয়াজির নিজের ভাষায় সেটা হালাকু খানের বাগদাদ হত্যাযজ্ঞকেও হার মানিয়েছিল। কিন্তু এ রকম একটি অভিযানের ষড়যন্ত্রের শুরুটা কবে?

পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তা ও বিভিন্ন গবেষকের বইপত্রে দেখা যায়, ১৯৭১ সালের মধ্য জানুয়ারি থেকেই পাকিস্তানি পক্ষ পূর্ব পাকিস্তান সংকটের একটি সামরিক সমাধান খুঁজতে শুরু করে।

মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা তাঁর ‘আ স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ওউন কান্ট্রি’ বইতে লিখেছেন, ’৭০-এর নির্বাচনের পরপর ১৯৭১ সালের ১২ জানুয়ারি জেনারেল ইয়াহিয়া ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে বৈঠক করেন। কোনো বিষয়েই তাঁরা একমত হতে পারেননি। ক্রুদ্ধ প্রেসিডেন্ট পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরেই লারকানায় জুলফিকার আলী ভুট্টোর বাগানবাড়িতে চলে যান। সেখানে জেনারেল আবদুল হামিদ খানও যোগ দিয়েছিলেন। ভুট্টোর এই বাগানবাড়িতে দুই দিন ধরে এই তিন নেতার মধ্যে যে আলোচনা হয়েছে, সেখানেই পাকিস্তানের ভাগ্য নির্ধারণ হয়ে গিয়েছিল বলে মন্তব্য করেছেন জেনারেল রাজা। তিনি লিখেছেন, বেশ কিছু বিষয়ে এই তিনজন যে একমত হয়ে গিয়েছিলেন এবং কিছু গোপন সিদ্ধান্ত নিয়ে নেওয়া হয়েছিল, তা পরবর্তী সময়ে তাঁদের আচরণেই বোঝা গেছে।

ব্রিটিশ লেখক ও গবেষক রবার্ট পেইন তাঁর ‘ম্যাসাকার : আ ট্র্যাজেডি অ্যাট বাংলাদেশ’ বইতে লিখেছেন, ’৭০-এর নির্বাচনের পর ডিসেম্বরেই আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। শেখ মুজিব অবিভক্ত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবেন, এটা সামরিক এলিটদের কাছে অসহনীয় চিন্তা ছিল। তখন থেকেই পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানে গোপনে অবাঙালি সেনাসমাবেশ শুরু হয়।

রবার্ট পেইন লিখেছেন, পূর্ব পাকিস্তানে একটা সর্বাত্মক গণহত্যা শুরুর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে যায় ১৯৭১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। ওই দিন সেনা সদর দপ্তরে বৈঠকে বসেছিলেন পাঁচ শীর্ষ সেনা কর্মকর্তা। এই পাঁচজন হলেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান, চিফ অব স্টাফ জেনারেল পীরজাদা, জেনারেল টিক্কা খান, জাতীয় নিরাপত্তা কমিশনের চেয়ারম্যান জেনারেল উমর খান এবং গোয়েন্দা শাখার প্রধান জেনারেল আকবর খান। সেখানেই তাঁরা গণহত্যার একটি নীলনকশা তৈরি করেন।

ভুট্টোকে তাৎক্ষণিকভাবে বৈঠকের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হয় এবং তাঁকে বলা হয়, এখন থেকে প্রেসিডেন্টের কথামতো চলতে।

ওই বৈঠকেই সিদ্ধান্ত হয়, আলাপ-আলোচনার নাটক সাজিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাদের ব্যস্ত রাখা হবে, তাঁদের এই ভাঁওতা দেওয়া হবে যে তাঁদের কোনো কোনো দাবি মেনে নেওয়া হতে পারে। আলোচনা চলাকালেই গণহত্যা শুরু করা হতে পারে বলে ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়।

রবার্ট পেইন লিখেছেন, ২২ ফেব্রুয়ারির ওই বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই ৩ মার্চ চট্টগ্রাম বন্দরে সোয়াত জাহাজে করে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র এবং এক রেজিমেন্ট বালুচ সেনা আনা হয়।

২২ ফেব্রুয়ারির ওই বৈঠকের কথা উল্লেখ করা হয়েছে জেনারেল রাও ফরমান আলীর লেখা ‘হাউ পাকিস্তান গট ডিভাইডেড’ বইতেও। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘আমরা বসে পড়ার পরপরই প্রেসিডেন্ট বললেন, আমি ওই বাস্টার্ডটার ব্যাপারে ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমি বললাম, স্যার, উনি এখন আর বাস্টার্ড নন। উনি জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি এবং এখন উনি গোটা পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করছেন।’

পাকিস্তানের একাধিক সেনা কর্মকর্তার বইতে ‘অপারেশন ব্লিটজ’ নামে একটি সামরিক পরিকল্পনার উল্লেখ আছে। পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক লে. জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খান পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য এই পরিকল্পনা তৈরি করেছিলেন।

জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা লিখেছেন, ১৯৭১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি তিনি তাঁর ব্রিগেডকে অপারেশন ব্লিটজ সচল করার জন্য প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশ দেন। ১ মার্চ দুপুরের পর কোনো এক সময় এটি কার্যকর হতে পারে বলে তিনি অফিসারদের জানিয়ে দেন। এর অংশ হিসেবে ২৭ ফেব্রুয়ারি খুলনা, ফরিদপুর, বরিশাল, বগুড়া, পাবনা, ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইলে সেনা পাঠানো হয়।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত অপারেশন ব্লিটজ বাতিল করে অপারেশন সার্চলাইটের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়। ১৬ মার্চ জেনারেল টিক্কা খান এই সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা করার নির্দেশ দেন জেনারেল রাও ফরমান আলী ও জেনারেল খাদিম হোসেন রাজাকে। ১৮ মার্চ সকালে জিওসির অফিসে জেনারেল রাজা ও জেনারেল রাও বিস্তারিত পরিকল্পনা করেন। এই পরিকল্পনা লেখার জন্য দুই জেনারেল হালকা নীল রঙের অফিশিয়াল প্যাড ব্যবহার করেছিলেন। লেখা হয়েছিল কাঠপেনসিল দিয়ে।

পাঁচ পৃষ্ঠার এ পরিকল্পনায় ১৬টি অনুচ্ছেদ ছিল। তাতে ১৬ জন ব্যক্তির নাম উল্লেখ ছিল, যাঁদের গ্রেপ্তার করতে হবে।

১৯ মার্চ জেনারেল টিক্কা খান অপারেশন সার্চলাইট অনুমোদন করেন। প্রস্তাব করা হয়েছিল, রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক চলাকালে সেখান থেকেই তাঁদের গ্রেপ্তার করা হবে। তবে শেষ মুহূর্তে প্রেসিডেন্ট এই অংশটি বাদ দিয়ে বাকি অংশ অনুমোদন করেন।

২৫ মার্চ মধ্যরাতের পর ইতিহাসের জঘন্যতম এক গণহত্যায় মেতে ওঠে সামরিক বাহিনী, যা ২৫ মার্চের কালরাত হিসেবে আমাদের কাছে বেশি পরিচিত। গত বছর থেকে দিনটি গণহত্যা দিবস হিসেবে বাংলাদেশে পালিত হয়ে আসছে।