Thank you for trying Sticky AMP!!

সবজির গ্রাম সুনামগঞ্জের বেরীকান্দা

কেউ বসতঘরের চালার ওপরে, কেউ আবার বাড়ির উঠোনে, কেউবা বাড়ির সামনের উঁচু জমিতে চাষ করেছেন সবজি। চালকুমড়া, মিষ্টিকুমড়া, টমেটো, করলা, ঢ্যাঁড়স, শিম, ক্ষীরা, চিচিঙ্গাসহ নানা ধরনের সবজির গাছ শোভা পাচ্ছে প্রায় প্রতিটি বাড়িতে। একসময় অভাব-অনটনের মধ্য দিন কাটত যে গ্রামের মানুষের; সবজি চাষ করে সেই গ্রামের অর্ধেকের বেশি পরিবার এখন স্বাবলম্বী।

এই চিত্র সবজির গ্রাম হিসেবে পরিচিতি পাওয়া বেরীকান্দা গ্রামের। সুনামগঞ্জের ধরমপাশা উপজেলার সুখাইড় রাজাপুর উত্তর ইউনিয়নে পড়েছে গ্রামটি।

 উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এ উপজেলায় ১০টি ইউনিয়নে সবজি চাষের জন্য আবাদকৃত জমির পরিমাণ ৬২০ হেক্টর। আর সুখাইড় রাজাপুর উত্তর ইউনিয়নের ১৯টি গ্রাম মিলে ১১০ হেক্টর জমি রয়েছে। তার মধ্যে শুধু বেরীকান্দা গ্রামেই সবজি চাষ হয় ২৫ হেক্টর জমিতে। গ্রামের দুই শতাধিক পরিবারের মধ্যে দেড় শতাধিক পরিবার জড়িত সবজি চাষে।

দিনবদলের গল্পের শুরু

পেশায় দিনমজুর ছিলেন রহমত আলী (৫০)। মা–বাবা, স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে দুবেলা কোনোরকমে খেয়ে না খেয়ে চলত সংসার। নতুন ঘর তৈরির জন্য ২০০৫ সালে এক আত্মীয়ের কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা সহায়তা পান। এর ১০ হাজার টাকা দিয়ে টিনের ঘর করেন। ৫ হাজার টাকায় বাড়ির দক্ষিণ পাশে এক কিয়ার (৩২ শতক) জমি বন্ধক নেন। ১০-১২ হাজার টাকা খরচ করে সেই জমিতে টমেটো ও মরিচ চাষ করেন। সপ্তাহের পাঁচ দিন অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। আর দুই দিন নিজের জমিতে। প্রথম বছরই বিক্রি করে পান প্রায় ৩০ হাজার টাকার ফসল। দ্বিতীয় বছরে আরও এক কিয়ার জমি বন্ধক নেন। সেখানেও চাষ করেন মরিচ আর টমেটো। মৌসুম শেষ হতেই সেই জমিতে পুঁইশাক, ঢ্যাঁড়স, চালকুমড়া, ক্ষীরা, চিচিঙ্গাসহ অন্যান্য সবজি চাষ করেন। এরপর বছর ঘুরেছে আর জমির পরিমাণ বেড়েছে রহমতের। সবজি চাষের লাভের টাকা দিয়ে তিনি কিনেছেন তিন কিয়ার জমি। একটি চৌচালা টিনের ঘর, চারটি গরু আর চার কিয়ার বোরো জমি হয়েছে তাঁর। সংসারে এসেছে সচ্ছলতা।

রহমত আলী বলেন, ‘১৫-১৬ বছর আগে আমার কিছুই আছিইন না। আমার বউ মোমেনা বেগম ও সন্তানসন্ততি লইয়া খুউব কষ্ট কইর‍্যা সংসার চালাইতে অইতো। সবজি চাষে আমি সুহের মুখ দেখছি। এই হানকার কৃষি অফিসার (উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা) যেইভাবে পরামর্শ দিছইন হেইভাবে আমি সবজির চাষ কইর‍্যা লাভবান অইছি।’

অনুপ্রেরণা পেলেন অন্যরাও

রহমত আলীর সফলতার গল্প অনুপ্রাণিত করল গ্রামের অন্যদেরও। তাঁর দেখাদেখি হাওরাঞ্চলের উঁচু জমিতে সবজি চাষে ঝুঁকলেন গ্রামের অন্যরাও।

আট বছর আগে স্বামী মারা যান গ্রামের মুর্শেদা আক্তারের (৫৫)। স্বামীর মৃত্যুর পর সন্তানদের নিয়ে দুই চোখে অন্ধকার দেখছিলেন তিনি। শোক সামলে নেমে পড়েন জীবনযুদ্ধে। মায়ের রেখে যাওয়া এক কিয়ার জমিতে করলা, মরিচ ও টমেটো চাষ করেন। প্রথম বছরই লাভের মুখ দেখেন। 

 মুর্শেদা বলেন, ‘স্বামী মারা যাওয়ার পর ভাবছিলাম জীবন বোধঅয় এইহানেই শেষ অইয়া যাইবো। এখন কষ্টের দিন শেষে কিছুটা সুখের মুখ দেখছি। আমাকে দেখে গ্রামের আরও কয়েকজন নারী সবজি চাষ করে লাভের মুখ দেখেছে।’

গ্রামের কৃষক ইসমাইল মিয়ার (৪৫) স্থানীয় শাসকা হাওরে আট কিয়ার বোরো জমি রয়েছে। অকালবন্যায় হাওরে ফসলহানি আর ধান চাষে লোকসানের পর দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন তিনি। কয়েক বছর ধরে তিন কিয়ার জমিতে সবজির চাষ করছেন তিনি। সব মিলিয়ে সবজি চাষে দেড় লাখ খরচ হয়। বছর শেষে প্রায় চার থেকে সাড়ে চার লাখ টাকার মতো সবজি বিক্রি করেন ইসমাইল। এখন জমিতে ধান না হলেও সংসার চালাতে কোনো সমস্যা হবে না বলে জানালেন কৃষক ইসমাইল।

পাশে আছে কৃষি বিভাগ

সুখাইড় রাজাপুর উত্তর ইউনিয়নের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান জানান, বেরীকান্দা গ্রামে দুই শতাধিক পরিবার আছে। এর দেড় শতাধিক পরিবার হাওরের বোরো ধান আবাদের পাশাপাশি সবজি চাষকেই প্রধান হিসেবে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। কৃষকের বীজ সংরক্ষণ ও বপন পদ্ধতি, সার ও পানি ব্যবস্থাপনা এবং পোকামাকড় দমনে পরামর্শ দিয়ে থাকেন তাঁরা। সবজি চাষের মাধ্যমেই এই গ্রামবাসীর ভাগ্য এখন অনেক বদলে গেছে। সবজি চাষে লাভবান হওয়ায় এই ইউনিয়নের ১৯টি গ্রামের মধ্যে ১০টি গ্রামে সবজি চাষ ছড়িয়ে পড়েছে।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নাজমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, উপজেলাবাসীর কাছে গ্রামটি সবজির গ্রাম হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। সবজি চাষে লাভবান হওয়ায় ইউনিয়নের অন্য গ্রামগুলোতে তা ছড়িয়ে পড়েছে। বাণিজ্যিকভাবেই এগুলো এখানকার কৃষক উৎপাদন করছেন। এখানকার উৎপাদিত সবজি সুনামগঞ্জ, সিলেট, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে। কৃষি বিভাগ থেকে নিরাপদ সবজি চাষের জন্য কৃষকের বিভিন্ন পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।

সুখাইড় রাজাপুর উত্তর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফরহাদ আহমেদ বলেন, বেরীকান্দা গ্রামের প্রতিটি পরিবারই সবজিচাষি। ইউনিয়নের অনেক দরিদ্র পরিবারই সবজি চাষ করে ভাগ্যের চাকা বদলে দিয়েছে। এগুলো দেখে উপজেলার অনেক গ্রামের লোক সবজি চাষে উৎসাহী হচ্ছেন।